১.
উঁচু পাহাড় কিংবা সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় না- আমরা ঠিক কতটা ক্ষুদ্র? এই বিস্তীর্ণ অরণ্য, বিপুল জলরাশি, সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীর কাছে একক মানুষ কী নগণ্য!!
হবে নাইবা কেন? প্রায় ৮০০০ মাইল ব্যাসের একটি গোলকের কাছে সামান্য ক’ফুটিয়া জীব..
চলুন, দৃষ্টি আরেকটু বাড়িয়ে ফেলা যাক..
আমাদের চোখের সামনেই সূর্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকে পুব দিগন্ত ভরে দিচ্ছে অপরিসীম লালে। সেই ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়া, সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বহু বহুগুণ বড়ো। সঠিকভাবে বলতে গেলে সূর্যের মধ্যে ১.৩ মিলিয়ন পৃথিবী ঢুকে যেতে পারে। হাঁ করে ভাবছেন নিশ্চয়ই – কত্ত বড়ো!!
তাহলে বলে দিই, এক একটি ছায়াপথে সূর্যের মতো ৩০০ মিলিয়ন তারার সমন্বয়। আর এই মহাশূন্যে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ছায়াপথের অপরিসীম রহস্য!! মাথা ঘুরছে কি? তাহলে আরেকটু সোজা করে বলা যাক- পৃথিবীর যত মরুভূমি আর সমুদ্র-সৈকত তাদের সম্মিলিত বালুকণা যদি এই বিপুল মহাশূন্য হয় তাহলে সূর্য তার একটি বালুকণারও সমান নয়!!
ক্ষুদ্রতা আর তুচ্ছতার বোধ অনন্তের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করে..
২.
অগ্নিগোলক ঠান্ডা হয়ে মাটি, জল, বায়ুর স্নেহময় কোলে মোটামুটি ভাবে ৫০ লক্ষ বছর আগে সৃষ্টি হ’ল আধুনিক মানুষ। বড্ড অসহায় বনবাসী মানুষ। ঝড়-বন্যা-অগ্নুৎপাত-ভূমিকম্পের সুতীব্র শক্তির সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল সামান্য ক’টি মেরুদন্ডী জীব। যারা বেঁচে রইলো তারা বুঝে গেল, ভয়ে নয়- প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া করতে হবে সামনা-সামনি। চোখে চোখ রেখে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো মানুষ। কৃষিকাজ শুরু হ’ল, আগুন জ্বললো, চাকা গড়ালো, নৌকো ভাসলো। নগর, সভ্যতা, বিজ্ঞান, ওষুধ.. অনন্তের সাথে যুঝতে শিখলো মানুষ।
তারপর কেটে গেল বহু বহু বছর..
৩.
কম প্রত্যাঘাত তো করেনি প্রকৃতি!! অগুনতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বাদই দিলাম। শুধু ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সামান্য ক’টি অতিমারীর কথাই যদি ধরি..
জাস্টিনিয়ানের প্লেগ- আনুমানিক ৫০ মিলিয়ন মৃত্যু, ব্ল্যাক ডেথ- ২০০ মিলিয়ন, গুটি বসন্ত- ৩০০-৫০০ মিলিয়ন, এইডস- ৩৬ মিলিয়ন। কলেরায় উজাড় হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। শুধুমাত্র ১৯১৮ সালের ফ্লু’তেই ২০-৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। হাম, অপুষ্টি, টিবি, দুর্ভিক্ষ, রক্তাল্পতা.. সংখ্যা কম পড়ে যায় হিসেবের ঘরে।
অগনিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ..
ইতিহাসের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া অসংখ্য মৃত্যুর কথা নয় বাদই দিলাম। বিশ্বযুদ্ধের টাটকা স্মৃতির পাতায় চোখ বোলানো যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১.৬ কোটি মৃত্যু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৫-৮ কোটি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে ২৫-৪০ লক্ষ। আর, এই সেদিনের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেই সংখ্যাটা ৩-৩০ লক্ষ। তারপর, প্রতিদিন.. প্রতি, প্রতিদিন..
৪.
মৃত্যুশোক আর অবর্ননীয় দুর্দশা কাটিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে মহাশূন্যের এই সামান্য জীব। অর্ধভুক্ত থেকে যে ‘অমৃতস্য পুত্রা’ পায়ে হেঁটে ৩৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে, তাকে আঘাত করা যায়, শেষ করা যায় না। করোনার মহামারীও শেষ হয়ে যাবে একদিন। তখনও মানুষ থাকবে, তখনও গান থাকবে, তখনও পড়ন্ত বিকেলের মায়ারোদ খেলা করবে শীর্ন নদীটিতে। হিরোরা থাকবে- কোদাল হাতে, গাঁইতি কাঁধে, স্টেথোস্কোপ গলায়, বই নিয়ে, বালি-সিমেন্ট মেখে।
কোনও এক দস্যি বিচ্ছু রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে.. দৈত্যদানোর সাথে যুদ্ধ করে রাজপুত্র-ই জেতে শেষমেশ।