Skip to content
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

কেন? দ্বিতীয়াংশ

Screenshot_2022-07-10-10-02-24-87_680d03679600f7af0b4c700c6b270fe7
Dr. Aniruddha Deb

Dr. Aniruddha Deb

Psychiatrist, Writer
My Other Posts
  • July 10, 2022
  • 10:17 am
  • No Comments

ওগবুনাবালি

~দশ~

গাড়িতে যেতে যেতে ডাঃ চন্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে বাইশতলা বাড়িটা আবার দেখার চেষ্টা করলেন। হাসপাতাল বন্ধ হবার পরে ডাঃ সেন দেশে না ফিরলে এদিকে আসা হয় না। বহুদিনের পুরোনো ড্রাইভার বাসুদেবের নজর এড়াল না। বলল, “স্যার অনেক দিন আসেন না।”

অপসৃয়মান বাড়িটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমেরিকায় থাকেন এখন। আগে বছর বছর আসতেন — লকডাউনের পর থেকে আর আসেননি।”

ডাঃ সেন বাড়ি বিক্রি করে মেয়ের কাছে মিনেসোটা চলে যাবার আগে ফ্ল্যাটটা কিনে রেখেছিলেন ডাঃ চন্দ্রর প্রভূত আপত্তি সত্ত্বেও।

“কী দরকার, দাদা?” বার বার বলেছিলেন ডাঃ চন্দ্র। “ওটা ছাড়া আর বাড়ি নেই?”

ডাঃ সেন বলেছিলেন, “তিনটে কারণে কিনছি। এক, বাড়িটা যারা বানাচ্ছে, বিল্ডার হিসেবে তাদের নামডাক খুব। দুই, বাড়িটা একেবারে পশ্‌ সাহেবি শহর, আর শহরতলীর সংযোগস্থলে। ডাইনে গেলে গাড়িতে পনেরো মিনিটে শহরের সবচেয়ে ঝাঁ–চকচকে মল, আর ওদিকে, তিন মিনিট দূরেই — রেল স্টেশন — লোকাল ট্রেনে পনেরো মিনিটে মফস্বল। আর, তিন, যখন হাসপাতাল ছিল, তখন পনেরো বছর এখানে কাজ করেছি — মালিকানা বদলে ওই বদমাশগুলো আসার আগে অবধি আনন্দে, আর নতুন মালিক আসার পর, আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া অবধি — দুঃখে। এখন বিদেশ থেকে বেড়াতে ফিরলে এইখানেই আস্তানা থাকলে ভালোই লাগবে…”

ডাঃ চন্দ্র বলেছিলেন, “কিন্তু এই ফ্লোরে এই ফ্ল্যাটটাই কেন? একশো বারোটা ফ্ল্যাটের মধ্যে এটাই কিনতে হবে?”

“কেন হে, তুমিই তো বলেছিলে, ছ’তলায় সাউথ ইস্ট ফেসিং ফ্ল্যাট নিতে…”

“আমি তো ইয়ার্কি করেছিলাম।”

“মডার্ন মেডিসিনের ছাত্র হয়ে তোমার এত কুসংস্কার কেন, অশোক?”

এ যে সাধারণ সংস্কার নয়, বোঝাতে পারেননি ডাঃ সেনকে। পরে অবশ্য মানতে বাধ্য হয়েছেন, ফ্ল্যাটটা ডাঃ সেনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়নি। মিনেসোটা চলে যাবার বছর দুয়েক পরে পজেশন পেয়েছেন, তার পরে গৃহপ্রবেশে এবং বাৎসরিক ছুটি কাটাতে সব মিলিয়ে তিনবার দেশে এসেছেন, অন্তত সপ্তাহ তিনেক থেকেছেন, একবার মাস দেড়েক। কোনও অঘটন ঘটেনি কখনও। বার কয়েক ডাঃ চন্দ্র জানতেও চেয়েছেন, নবনির্মিত বহুতলে কোনও অবাঞ্ছিত দীর্ঘদেহ আফ্রিকানকে কেউ দেখেছে কি না। উত্তরে ডাঃ সেন হেসে বলেছেন, ওঁর মাথা তো অশোক চন্দ্রর মতো খারাপ নয়, যে সাধ করে নতুন প্রতিবেশীদের বিদঘুটে প্রশ্ন করে বেড়াবেন!

তবে এর মধ্যে যতবার ডাঃ সেন ফিরে এসেছেন, ততবার ডাঃ চন্দ্রর অস্বস্তি বেড়েছে। ওই বাড়িতে সিক্সথ ফ্লোরের একটা ঘরে বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু এবং তাঁর স্ত্রী সারা রাত কাটাচ্ছেন, এটা ডাঃ চন্দ্রর পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হয়নি।

কিছুই হয়নি প্রথম তিন বছর — তার পর থেকে তো আসা যাওয়া বন্ধই হয়ে গেল…

“এখন তো আবার প্লেন চলছে — এবার তো আবার আসতে পারবেন?”

বাসুর প্রশ্নে সচকিত হয়ে বললেন, “ভয় পাচ্ছেন। এখানে তো অসুখ কমার নাম নেই — আমেরিকাতেও খুব যে কমেছে, তা নয়…”

বাকি রাস্তাটা অতিমারির আলোচনাতেই কেটে গেল।

কয়েক দিন পরে ভোরে খাটের পাশের টেবিলে সাইলেন্ট মোডে রাখা মোবাইলটা যখন গোঁ–গোঁ করতে শুরু করেছিল, তখন ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু কম্পমান ফোন সরে গিয়ে নেল–কাটারটা ঠেলতে ঠেলতে কাচের জলের বোতলে ঠুনঠুন করতে শুরু করেছিল যখন, তখন চমকে উঠেছিলেন। সবে পাঁচটা বাজে। বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এখনও কালো। এত রাতে…

ডাঃ শেখর সেন।

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ফোন ধরলেন ডাঃ চন্দ্র। ওপার থেকে ডাঃ সেন জানতে চাইলেন, “বেশি তাড়াতাড়ি ফোন করেছি? আমার ধারণা ছিল তুমি ভোরে ঘুম থেকে ওঠো।”

ধারণাটা ঠিক। আর কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভাঙত ডাঃ চন্দ্রর। বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি নয়, দাদা। ঘুম ভাঙিয়েছেন, তবে নর্মাল টাইমের থেকে খুব বেশি আগে নয়। কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?”

“তুমি জানো না?”

কী জানেন না ডাঃ চন্দ্র? বললেন, “তেমন কিছু তো…”

“‘স্টেশন টাওয়ার্স’–এ দুর্ঘটনায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে — শোনোনি?”

শোনেননি। তা–ই বললেন।

ডাঃ সেন বললেন, “এই দেখো। আমি সুদূর আমেরিকায় বসে জেনে গেলাম… যাকগে… ব্যাপারটা এরকম… পাঁচতলার ফ্ল্যাটে এক দম্পতি থাকতে এসেছিলেন। দিন তিনেক আগে মাঝরাত্তিরে স্ত্রী বারান্দা থেকে পড়ে মারা যান। ফাউল প্লে–র চিহ্ন ছিল না, তবে বাড়িতে শুধু স্বামী আর বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছিল — ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্বামীকে সন্দেহ করা হচ্ছিল। কিন্তু কাল, মানে তোমার পরশু… রাতে, স্বামীও একই ভাবে ওই বারান্দা থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন। তখন বাড়িতে উনি একা–ই ছিলেন, তাই এই মৃত্যুটা আত্মহত্যাই সন্দেহ নেই। কাগজে নাকি বেরিয়েছে… দেখনি?”

কাগজ দেখেন কোথায় ডাঃ চন্দ্র? আজকাল তো সব খবর মোবাইলেই আসে — এবং সে সব ডাঃ চন্দ্রর ইচ্ছেমতো — রাজনৈতিক খবর, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবর, খেলাধূলা আর আন্তর্জাতিক নিউজ। কাগজ আসে সুধাংশুর জন্য। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

ডাঃ সেন বলছেন, “আমিও জানতাম না। এখানে তো আর দেশের সব খবর আসে না। তবে এই সেকেন্ড ডেথ্‌–টার পরে পুলিশ আশেপাশের সব ফ্ল্যাটে নাকি ঢুকেছে। ওপরের ফ্ল্যাটটাই আমার। তালাবন্ধ — কিন্তু একটা চাবি কেয়ারটেকারের কাছে থাকে… তো, কেয়ারটেকার আমাকে ফোন করেছিল অনুমতি চেয়ে। তাই জানলাম।”

“আপনার নিচের ফ্ল্যাট — মানে ফাইভ ‘বি’?”

“ঠিক। সেজন্যই তোমার কথা মনে পড়ল। তখন তো ছ’তলায় ছিল তোমার ভূত। একতলা নেমে গেল কেন?”

ডাঃ চন্দ্রর একটু বিরক্ত লাগল। ডাঃ সেন অবিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না যে হাসপাতালে তিনটে আর এখন এ বাড়িতে দুটো মৃত্যু হয়েছে। ছ’তলাই হোক, বা পাঁচতলা, হয়েছে সন্দেহ নেই। আগের মৃত্যুগুলোর একটার সঙ্গে আর একটার কোনও যোগাযোগ আছে কি না, কেউ জানে না। তেমনই জানা নেই এ দুটো মৃত্যু কেন, বা কী ভাবে হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই সেটা নিয়ে ডাঃ চন্দ্রর পেছনে লাগছেন ডাঃ সেন।

বললেন, “দাদা, আমার একটা উপকার করবেন? আপনার ফ্ল্যাটে আমাকে একটু ঢুকবার অনুমতি দেবেন?”

“কেন? কী হবে?”

“জানি না। তবে একটু যেতাম। আপনার আপত্তি না থাকলে…”

বুঝলেন টেলিফোনের ওপারে ডাঃ সেন একটু দোনোমনো করছেন। তারপরে শুনলেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। রাতও কাটাবে নাকি?”

ভাবলেন, বলেন, “কেন, আপনি তো রাতের পর রাত কাটিয়েছেন পর পর তিন বছর। তখন তো ভয় পাননি?” বললেন না। বললেন, “না। শুধু গিয়ে ঘুরে আসব। একটু জায়গাটার ‘ফিল’টা পেতে চাই — এই দুটো মৃত্যুর পরে।”

ডাঃ সেন বললেন, “বেশ। কেয়ারটেকারকে বলে দেব। ছেলেটা ইয়ং — ভালো ছেলে। সুমিত। ওখানেই থাকে, তবে অফিস টাইমেই যাওয়া ভালো। অফিস খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা, আবার সন্ধে ৬টা থেকে রাত ১০টা, মঙ্গলবার বাদে। আমি বলব তুমি আমার বন্ধু এবং পুলিশ ঢোকার পরে ফ্ল্যাটটা চেক করে আসবে।”

এর মধ্যে ডাঃ চন্দ্রর ঘর থেকে গলার শব্দ শুনেছে সুধাংশু। চা নিয়ে এল। হাত নেড়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “টিভির ঘরে দে। আসছি।”

সোফায় বসে সুধাংশুকে বললেন, “কাগজে তিন চার দিন আগে উঁচু বাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কেউ মারা যাওয়ার খবর বেরিয়েছে?”

সুধাংশুকে কখনও কাগজের খবর নিয়ে ডাক্তারবাবু কিছু জিজ্ঞেস করেছেন বলে ওর মনে পড়ে না। তবে অবাক হলো না। খ্যাপা ডাক্তারবাবুর চাকরিতে অনেক বছর হলো। বলল, “হ্যাঁ, ওই কোথায় উঁচু বারান্দা থেকে পড়ে একজন মেয়েছেলে…”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আর তার পরে ওনার স্বামীও একই ভাবে মারা গেছেন, সেটা?”

সুধাংশু বলল, “সে কাল টিভিতে কয়েছে। কাল ভোর রাতে। আজকের কাগজে পাব।”

হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে যেতে যেতে বললেন, “টিভিটা চালিয়ে দে। খবরের চ্যানেল করে দিস। আর ওই আগের দিনের কাগজটা এনে দে তো…”

টিভিতে ডাঃ চন্দ্র কেবল নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম এসবের সিনেমা দেখেন। সেট টপ বক্সের রিমোটটা ওঁর পরিচিত নয়।

বাংলা খবরের চ্যানেলে এখনও অনেকটা সময় জুড়েই আগের কয়েক দিনের দুটো মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চলছে। একটু দেখেই বুঝলেন, খবর কম, নাটক বেশি। টিভি বন্ধ করে মন দিলেন সুধাংশুর এনে দেওয়া তিন দিনের কাগজে। রোজই কিছু না কিছু খবর আছে, কিন্তু তথ্য বেশি নেই। সাত বছরের বিবাহিতা মণিমালা ঘোষ রাত তিনটে নাগাদ ‘স্টেশন টাওয়ার্স’ বহুতলের ছ’তলার বারান্দা থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন। সন্দেহ, তিনি আত্মহত্যা করেছেন, তারপরে স্বামীকে সন্দেহ করা হচ্ছে, তারপরে দু’জনের ব্যক্তিগত জীবনের নানা খুঁটিনাটি — যদিও তার সারমর্ম এই, যে তেমন কিছুই জানা যায়নি।

দু’জনে কিছুদিন আগেই এখানে থাকতে এসেছিলেন। তার আগে ছিলেন মুম্বাইতে।

তাহলে এতদিন সে বাড়িতে কে থাকত? এর আগে মৃত্যু হয়েছে ওই ফ্ল্যাটে?

ঘড়ি দেখলেন ডাঃ চন্দ্র। দেরি হয়ে গেছে। অন্যদিনে এতক্ষণে ডাঃ চন্দ্র বহুতলের কমপ্লেক্সের নিচে অর্ধেক মর্নিং ওয়াক সেরে ফেলেছেন। ওদিকে প্রকাশকে ফোন করার সময় এখনও আসেনি। ওরা দেরি করে ঘুমোয় — প্রকাশ তো বেশিরভাগ দিন অফিস থেকে ফেরেই রাত দশটার কাছাকাছি। ওদের খাওয়াও দেরি, ঘুমও দেরি। অফিসেও এগারোটার আগে যায় না। পুলিশের বড়োকর্তাদের এটাই আদত।

ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার প্রকাশ তরফদার যদি সতেরো–আঠেরো বছর আগে এখানে থাকতেন, তাহলে তখন অত সহজে হাসপাতালে ভূতুড়ে মৃত্যুর গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিতেন না ডাঃ চন্দ্র। হাজারটা ‘কেন?’র উত্তর পাননি ডাঃ চন্দ্র — সেটা আজও ওঁকে বিচলিত করে। মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেই প্রকাশকে ফোন করবেন।

খালি চায়ের কাপ নামিয়ে ট্র্যাক স্যুট আর ওয়াকিং শু পরতে গেলেন ডাঃ অশোক চন্দ্র।

~এগারো~

কফিতে চুমুক দিয়ে প্রকাশ বললেন, “বাঃ, বেশ কফি তো? বিদেশি? কোথায় পেলে?”

ডাঃ চন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “একেবারেই না। নীলগিরি। মালিক–রা আমার চেম্বারের পাড়ায় একটা নতুন ক্যাফে খুলেছে। এখন ওদের কফিই খাই। নিয়ে এলাম তোমাদের জন্য এক প্যাকেট।”

কফি আর চা নিয়ে আরও কিছু আলোচনার পরে অশোক চন্দ্র বললেন, “হাসপাতালের মৃত্যুর ফাইলগুলো দেখেছ?”

প্রকাশ পাশে রাখা দুটো মোটা ফাইল দেখিয়ে বললেন, “দেখেছি। কোনও মৃত্যুর সঙ্গে কোনও মৃত্যুর সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়নি। এবং মৃত্যুর কারণও আলাদা।”

ঘাড় নাড়লেন ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “দু’জনের মৃত্যু ছ’তলার জানলা দিয়ে পড়ে। একজনের সম্ভবত হার্ট–অ্যাটাকে। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন তার আগে।”

ঘাড় কাত করে ভুরু তুললেন প্রকাশ। “আগে?”

বহু বছর আগের প্রশ্নগুলো আবার করলেন অশোক চন্দ্র। “প্রথমত, সিল করা জানলা দু’বার খুলে গেল কী করে? দ্বিতীয়ত, ওই ওয়ার্ড বয় সেই রাতে ওই ঘরে কী করছিল?”

প্রকাশ বললেন, “আরও একটা প্রশ্ন ছিল। করলে না?”

একটু অবাক হয়ে অশোক চন্দ্র বললেন, “কী প্রশ্ন?”

“ওই যেটা আগের বারে তুমি টিভিতে, কাগজে করেছিলে — ওই ঘরেই মিহির গুপ্তকে কেন বেড দেওয়া হয়েছিল?”

অশোক চন্দ্র হাসলেন। বললেন, “প্রশ্নটা জানো, উত্তরটা জানো না? তোমরা পুলিশরা সত্যিই খুব চালাক। সব আমাদের দিয়ে বলিয়ে নাও। আচ্ছা, ধরে নিচ্ছি জানো না। উত্তরটা হলো এই — যেদিন মিহির গুপ্তকে আই–টি–ইউ থেকে বের করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আগের দিনই হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা স্থির করেন, যে ‘অপয়া’ বদনামের হাত থেকে ঘরটাকে রক্ষা করতে ওটাতে পেশেন্ট রাখা আবার শুরু করা হবে যথাশীঘ্র সম্ভব। এবং তার পরেই মিহির গুপ্ত আর ওঁর পিসেমশাইয়ের আই–টি–ইউ থেকে বেরোন’র কথা, তাই ওঁদেরই কপালে জোটে ঘরটা। শেষ পর্যন্ত পিসেমশাইকে বাদ দিয়ে মিহির গুপ্তকে একাই ও ঘরে রাতে থাকতে যেতে হয় — সেটাও কপালেরই ফের। হাসপাতালের অধস্তন কর্মচারীরা তো মিহির গুপ্তর ইতিহাস জানত না, তাই ওঁকে ও ঘরে রাখতে দ্বিধা করেনি। একমাত্র ওঁদের ডাক্তার — শেখর সেন — সবটা জানতেন, কিন্তু ওনার আবার ভূতের নাম শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে, তাই উনিও কিছু বলেননি।”

“আর তুমি ভূতে বিশ্বাস করো বলে মনে করছ সবটাই ভূতের কারসাজি?”

ডাঃ চন্দ্র একটু রাগতস্বরে বললেন, “আমি ভূতে বিশ্বাস করি তোমাকে কে বলল, হে?”

আঙুল তুলে পরীর দিকে দেখালেন প্রকাশ। পরীও হেসে বললেন, “তোমার ছোটোবেলার ভূত দেখার গল্প বলেছি।”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “দাঁড়া, তোর হচ্ছে।” তারপরে প্রকাশের দিকে ফিরে বললেন, “ফাইলগুলো দেখতে পারি?”

প্রকাশ অল্প কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনের টেবিলে ফাইলগুলো নামিয়ে আস্তে করে ঠেলে দিলেন। ডাঃ চন্দ্র ফাইল দুটো কোলে তুলে নিয়ে একটা একটা করে খুলে দেখে বললেন, “সবকটা নেই।”

মাথা নাড়লেন প্রকাশ। বললেন, “ওই আফ্রিকানের ফাইলটা আনিনি। ওটা এখনও সেনসিটিভ ইস্যু। ওদের দেশের সঙ্গে আমাদের এখন নতুন সম্পর্ক স্থাপন হচ্ছে। জানো কি, সাব–সাহারান আফ্রিকাতে অনেক জায়গায় পেট্রোলিয়াম পাওয়া গেছে নতুন করে?”

জানেন। আন্তর্জাতিক নিউজে ওই দেশের নাম থাকলে মন দিয়ে পড়েন ডাঃ চন্দ্র। ফাইলগুলো উলটে দেখতে বেশিক্ষণ লাগল না। নামিয়ে রেখে বললেন, “আরও একটা কথা আছে। তুমি এগুলো দেখেছ?”

প্রকাশ হ্যাঁ বললেও, ডাঃ চন্দ্র বুঝলেন, কাজের চাপে আদ্যিকালের ফাইলের প্রত্যেকটা কথা পড়েননি প্রকাশ।

বললেন, “মিহির গুপ্তর ফাইলে হাসপাতালের সব নোট রয়েছে দেখলাম।”

প্রকাশ বললেন, “অরিজিনাল ফাইলটাই তো রয়েছে।”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “তাতে কিন্তু আমার নোট নেই।”

ভুরু কুঁচকে তাকালেন প্রকাশ। “তোমার নোট? তুমি মিহির গুপ্তর চিকিৎসা করতে?”

মাথা নাড়লেন চন্দ্র। “না। মিঃ গুপ্ত আমার পেশেন্ট ছিলেন না। কিন্তু যেদিন উনি যে রাতে মারা যান, সেদিন — মানে তারিখের হিসেবে আগের দিন — সকালে আমি ওনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমার নোট ফাইলে লিখেছিলাম। মনে আছে একটা আলাদা পাতায় আমার নোট ছিল। ডাঃ সেন একটা নতুন পাতার শুরুতে রেফারাল লিখেছিলেন, আর আমি সেই পাতায়, ডাঃ সেনের রেফারাল নোটের নিচে লিখতে শুরু করে, পাতা উলটে অন্যদিকের প্রায় পুরোটাই ভরে ফেলি। সেই পাতাটা নেই।”

“স্ট্রেঞ্জ!” ফাইলটা নিয়ে প্রকাশ পাতা উলটে নির্দিষ্ট জায়গাটা দেখে বললেন, “এই যে, এখানে — ভোর চারটের সময় মেডিকেল অফিসারের লেখা, রাত তিনটে পঁচিশ মিনিটে মিঃ গুপ্ত ছ’তলা থেকে পড়েছিলেন, তাহলে তার আগে… কই, সেদিন সকাল থেকে তো কোথাও তোমার হাতের লেখা নেই, বা কোনও রেফারালও লেখা নেই তোমার নামে…”

“তা–ই তো বললাম।”

“কিন্তু কেন?”

“তার মানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাতাটা সরিয়ে ফেলেছে।”

“কিন্তু কেন?”

“মিহির গুপ্ত আমাকে কী বলেছিলেন আমি সবিস্তারে লিখে রেখেছিলাম বলে…”

“কী সেটা?”

উত্তরে ডাঃ চন্দ্র নিজের পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করে প্রকাশকে দিয়ে বললেন, “সময় করে পড়ে দেখো। আমার সব নোট। মিঃ গুপ্তর বক্তব্যও রয়েছে। ঠিক হাসপাতালের ফাইলে যা লেখা ছিল তা না হলেও পরদিন সকালে, মিঃ গুপ্ত মারা গেছেন শুনে আমি সবটা লিখে রেখেছিলাম আবার, সুতরাং খুব তফাত নেই।”

“কিন্তু অরিজিনাল নোটগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই সরিয়েছে তুমি ঠিক জানো?”

মাথা নাড়লেন ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “আন্দাজ করছি। অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে চেয়ে। সে প্রশ্নগুলোও দিয়েছি তোমাকে।”

কাগজগুলোর পাশে আঙুল দিয়ে টেনে কতটা পুরু বোঝার চেষ্টা করলেন প্রকাশ। চন্দ্র বললেন, “অনেক কাগজ, কিন্তু অনেক লেখা নেই। বেশিরভাগ কাগজেই কয়েক লাইন করে লেখা। পড়তে দেরি হবে না।”

পরী সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। “সে সব পরে হবে। অনেক কাজের কথা হয়েছে, এখন দুজনে হাত ধুয়ে খেতে এসো, বাকি কথা ওখানে বলবে।”

খেতে বসে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “মণিমালার সম্বন্ধে কী জানতে পেরেছ? বলা যাবে?”

প্রকাশ বললেন, “বয়স উনত্রিশ। বিয়ে হয়েছে, সাত বছর মতো। হোমমেকার। এক ছেলে, বছর চারেক বয়েস। এসেছেন কিছুদিন আগেই — মাস চারেক। মুম্বাই থেকে। হাজবেন্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কোনও সমস্যা ছিল বলে জানা নেই। মানসিক অবসাদ টবসাদ, তোমার মতো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোনও হিস্ট্রি নেই। রাতে নাকি খেয়ে দেয়ে দিব্যি শুয়েছিলেন — ইন ফ্যাক্ট শোবার আগে হাজবেন্ডের গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে যাবার ব্যাপারে প্ল্যানও নাকি হয়েছিল শনি–রবির ছুটিতে। রাতে তিনটে নাগাদ ওপর থেকে পড়েন — বারান্দার নিচে গাড়ির পার্কিং — একটা গাড়ির ওপরে। ফলে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে, সিকিউরিটি ছুটে আসে। পোস্ট মর্টেমে দেখা যায় যে পতনজনিত আঘাতের ফলেই মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ।”

“শুরুতে কোনও কোনও কাগজে আর টিভি চ্যানেলে বলেছিল তোমরা ওর হাজবেন্ডকে সন্দেহ করছিলে?”

“ওরা তো পুলিশের বাড়া… এক একটা টিভি চ্যানেল এক একজন শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ বক্সি, ফেলুদা–দের চাকরি দিয়েছে। তারা সকাল থেকে বেচারার পেছনে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন নিয়ে ধাওয়া করেছে — আপনি কী করছিলেন? আপনি কি ঘুমিয়েছিলেন? আপনার পাশ থেকে আপনার বউ উঠে গেলেন, আপনি বুঝতেও পারলেন না?… এই সব। আজকাল আবার সঙ্গে জুটে যায় রিটায়ার করা পুলিশ অফিসার। চাকরি থাকলে যে কোড অফ কন্ডাক্ট মেনে চলতে হয়, অবসরের পরে তো তার বাঁধন থাকে না। তবে আমরা মোটামুটি শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে হাজবেন্ড আর যা–ই করুন, ঠেলে ফেলে দেননি।”

অবাক হয়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “কী করে?”

প্রকাশ বললেন, “সিসিটিভি আছে। ফ্ল্যাটের বাইরের করিডোর, আর ফ্ল্যাটওনার চাইলে ভেতরেও। এনাদের শুধু খাবার আর বসার ঘরে ছিল। সেখানে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত শান্তিই ছিল, কোনও ঝগড়া কথাকাটাকাটি জাতীয় কিছু হয়নি। বাচ্চাটা শুতে যায় রাত দশটার একটু আগে। তারপরে স্বামী–স্ত্রী টিভি দেখছিলেন। মণিমালা স্বামীর কোলে মাথা রেখে শুয়েও ছিলেন। এগারোটার একটু পরে বাচ্চাটা উঠে আসে, মা আবার ওকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে যান। স্বামী শুতে যান সাড়ে এগারোটায়। তারপরে সব চুপচাপ। এর পরে তিনটে তিন মিনিটে মণিমালা উঠে আসেন, অন্ধকারেও বোঝা যায় ওটা উনিই। ফ্রিজ খুলে জল খান, তারপরে যান বারান্দার দিকে। বারান্দাটা সিসিটিভি–র আওতার বাইরে, কিন্তু পড়ে যাবার ফলে নিচে গাড়িগুলোর অ্যালার্ম–এর আলো জ্বলা নেভা–টা দেখা গেছে। কয়েক মিনিট পরে নিচ থেকে এসে ঘণ্টি দেয়, তখনই প্রথম স্বামী শোবার ঘর থেকে বেরোন। তার আগে নয়। অর্থাৎ শোবার ঘরে রাত সাড়ে এগারোটা থেকে তিনটের মধ্যে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে কিছু সমস্যা হয়ে থাকলে তার ফলে মণিমালা সুইসাইড করতে পারেন, কিন্তু স্বামী অন্তত ঠেলে ফেলে দেননি।”

“আর হাজবেন্ড কী করে মারা গেলেন?”

“অরুণকিশোর ঘোষ। মাল্টিন্যাশনাল সফটওয়্যার কম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। মোটামুটি ব্রিলিয়ান্ট। প্রেম করে বিয়ে। ছেলে, মেয়ে দু’দিকের বাড়িতেই আপত্তি ছিল, তবে শেষ অবধি টেঁকেনি। উভয়পক্ষই একেবারে এঁড়ে বসেছিল। বিয়ের পরে পরেই দুজনে একসঙ্গে বম্বে, সেখানে আরও উন্নতি, তারপরে অ্যাপিল করে ট্রানসফার নিয়ে চলে আসেন মাস চারেক আগে। তখন থেকেই ওই বাড়িতে।”

ডাঃ চন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, “তার আগে ফ্ল্যাটটায় কে থাকত?”

প্রকাশ বললেন, “কেউ না। খালি ছিল। ফ্ল্যাটটা শুরু থেকেই ওদেরই। বা, বলা ভালো — মণিমালার। বাবা বিয়েতে দিয়েছিলেন — তবে মেয়েকে। জামাইকে নয়।”

পরী বললেন, “ওইটুকু বাচ্চা… ওর কী হবে?”

প্রকাশ কাঁধ ঝাঁকাতে গিয়ে থমকে গেলেন। বললেন, “আপাতত দাদু দিদিমার কাছে আছে। ওদের বাড়ি কাছেই। বয়েস হয়েছে, তবে পয়সাওয়ালা। লোক রেখে কাজ চালাতে পারবেন। ঠাকুর্দা ঠাকুমার বয়স বেশি না, তবে নিম্নবিত্ত। থাকেন গ্রামে — সেখানে বাচ্চাকে রাখা যাবে কি না…”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “কিন্তু মিঃ ঘোষের মৃত্যু হলো কী করে?”

“তিন দিন পরে সুইসাইড করলেন।”

“কী ভাবে?”

“অবাক হবার কিছু নেই — ওই একই ভাবে। ওই বারান্দা থেকেই লাফিয়ে পড়ে…”

অশোক চন্দ্র একটা হতাশ গলায় বললেন, “সুইসাইড–ই? সন্দেহ নেই তো?”

“একাই ছিলেন বাড়িতে। ছেলে তো দাদামশাই দিদিমার কাছে। সিসিটিভি–তে দেখা গেছে ওই একই সময়ে উঠে এসেছিলেন বারান্দায় — আশেপাশের লোক বলেছে আগের দু’দিন নাকি বার বার বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন — উঁকি মেরে দেখতেন কোথায় পড়েছিলেন মণিমালা। ওরা ভয় পেত উনিও না ওইরকমই করেন। কেউ নাকি বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েওছিলেন — ওনার হাবভাব ভালো ঠেকছে না। অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কথা বলেছিলেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে — কিন্তু কী করা উচিত সে নিয়ে একমত হতে পারেননি… আর…”

প্রকাশ থামলেন। হয়ত আশা করছিলেন অশোক কিছু বলবেন, কিন্তু ডাঃ চন্দ্রর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। ফলে প্রকাশই বললেন, “তবে এবারে সরাসরি বারান্দার নিচে গাড়িটা ছিল না। মাটিতে পড়েছেন। গাড়ির অ্যালার্ম বাজেনি। কেউ বুঝতে পারেনি। সিকিউরিটি রাউন্ড দেয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় — চারটের রাউন্ডে যার যাবার কথা, সে পরে স্বীকার করেছে ঠিকমতো চারদিক ঘুরে দেখেনি। বিল্ডিং–এর সামনে থেকে এদিক ওদিকে উঁকি দিয়েছে, আর পেছনে যায়ইনি। ফলে দেখতেও পায়নি।”

“হুঁ…”

“ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অন্য বাড়ির বারান্দা থেকে একজন দেখতে পেয়ে চেঁচামেচি করায় দেখা যায় ডেডবডি পড়ে আছে।”

বেরোবার সময় ডাঃ চন্দ্রর কী খেয়াল হলো, দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তোমার সঙ্গে দেখা হবে কি, ওই ফ্যামিলি লোকেদের?”

একটু অবাক হয়ে প্রকাশ বললেন, “কেন বলো তো?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমার অ্যাডভাইজ, কেউ যেন ও বাড়িতে আর না থাকেন।”

চন্দ্রকে বিদায় দিয়ে প্রকাশ আর পরী ঘরে ঢুকলেন, পরী বললেন, “এখনই শুতে যাবে, না একটা আফটার ডিনার কফি খাবে?”

প্রকাশ বললেন, “কফিটা দারুণ। এক কাপ খেলে হয়।”

পরী রান্নাঘরে গেলেন, প্রকাশ বসার ঘরে সোফায় বসলেন ডাঃ চন্দ্রের রেখে যাওয়া কাগজগুলো নিয়ে। একটু পরে পরী কফি নিয়ে এলে প্রকাশ অবাক হয়ে বললেন, “এ কী! এক কাপ কেন? তোমার জন্য বানাওনি?”

পরী মাথা নেড়ে বললেন, “না। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে সোফায় শুই।”

খানিকক্ষণ দুজনে চুপচাপ। প্রকাশ পড়ছেন, পরী শুয়ে। একটু পরে প্রকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজগুলো নামিয়ে রাখলেন। পরী জানতে চাইলেন, “কাজের কথা আছে কিছু?”

মাথা নাড়লেন প্রকাশ। “আরে, দূর, কেবল ফালতু ভূতুড়ে কথা। অবশ্য এ কথা ঠিক, অশোকদা কোথাও ভূত কথাটা বলেনি, কিন্তু ওই মিহির গুপ্ত নাকি আগে হাসপাতালে একজন বিরাট লম্বা আফ্রিকান দেখেছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির দিন সেই আফ্রিকান নাকি ওনার গাড়িতে ছিল মাঝরাতে। তিন–চার দিন পরে ওই ঘর থেকেই উনি খোলা জানলা দিয়ে পড়ে মারা যান — ঠিক ওই আফ্রিকানের মতো। আর পরে ওই ঘরে — তখন সেটা স্টোর রুম — একজন ওয়ার্ড বয়কে পাওয়া যায়, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিল। আর নানা রকম প্রশ্ন করে গেছেন — কেন জানলা খুলে গেল? কেন ওয়ার্ড বয় ছ’তলার ঘরে গেল, কোথা থেকে চাবি পেল… এই সব — এসব প্রশ্নের মানে আছে?”

“তুমি ওদের বলতে যাবে — ও বাড়িতে না থাকতে?”

“ক্ষেপেছ? কী বলব? যদি জিজ্ঞেস করে কেন? বলতে হবে, আমার বউয়ের সাইকিয়াট্রিস্ট দাদা মনে করেন বাড়িটা ভূতুড়ে।”

পরী কিছু বললেন না। অশোকদাকে দুজনেই পছন্দ করেন। পরী কিছু বেশিই করেন, তাই তর্ক করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ইচ্ছে করছিল না।

~বারো~

ন’দিনের দিন ভোর বেলা আবার ফোনের গোঙানিতে ঘুম ভাঙল ডাঃ চন্দ্রর। আবার কে? ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রকাশ। এত সকালে?

“অশোকদা, তোমাকে আগেভাগেই জানিয়ে দিই। নইলে তুমিই আবার আমাকে ফোন করবে…”

“কী হয়েছে?”

প্রকাশ বললেন, “তোমার ওই বাড়িটা — ‘স্টেশন টাওয়ার্স’ — ওতে আবার একটা অঘটন ঘটেছে।”

ডাঃ চন্দ্র কিছু বললেন না। প্রকাশ বলে চললেন, “অরুণকিশোরের মা।”

চমকে উঠে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “সে কী! ওনারা গ্রামে থাকতেন না? এখানে কী করছিলেন?”

প্রকাশ বললেন, “এসেছিলেন ছেলের জিনিসপত্র নিতে, এবং নাতি কোথায় থাকবে সে বিষয়ে আলোচনা করতে। কোথায় থাকবেন? দু’পক্ষই একটু প্রাচীনপন্থী, আর বিয়ে নিয়ে তো একটা মতবিরোধ ছিলই। ছেলের শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চাননি। তাই…”

“ইশ্‌শ্‌শ্‌শ্‌, তোমাকে আমি বলেছিলাম, ও বাড়িতে যেন কেউ না থাকে…”

ওদিক থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে বললেন, “প্রকাশ, তুমি ওদের বলোনি?”

প্রকাশ আমতা আমতা করে বললেন, “কী বলব, অশোকদা? ভূত–টুত বললে তো লোকে হাসবে!”

একটু অসহিষ্ণুভাবে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আরে, ভূত বলার কী দরকার? আমি লোককে বোঝাতে পারি না — যেটা বিশ্বাস করো না, সেটা বলতে যেও না। বোঝাতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা যে কিছু আছে, তা তো নিশ্চিত? না কি?”

এবারও কিছু বললেন না প্রকাশ। ডাঃ চন্দ্র বললেন, “যে কোনও কারণেই হোক, মণিমালা পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন। খুন সম্ভবত নয়, তবে আত্মহত্যা, না অ্যাক্সিডেন্ট তোমরা জানো না। তারপরে অরুণকিশোর। তিনি না হয় বউয়ের দুঃখে আত্মহত্যাই করেছেন। আর অরুণের মা–ও হয়ত ছেলের দুঃখে একই পথে গিয়েছেন। আপাতত এতটুকুই তো যথেষ্ট — নয় কি?”

প্রকাশ বললেন, “লোকে বলবে, অপয়া, বা ওরকম কিছু…”

বাচ্চাকে বোঝানোর সুরে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “বললে সেটাই বলবে। আগে দেখো — ওরা কিসে বিশ্বাস করে। তাহলে সেই সেন্টিমেন্টটা–ই ব্যবহার করে বলো — বাড়িটা বোধহয় অপয়া। ওটাতে আপাতত কেউ না থাকা–ই ভালো।”

“তারপর?”

“আবার কিসের পর?”

“কতদিন কেউ থাকবে না? তুমি তো বলছ ও বাড়িতে যত মৃত্যু হয়েছে, সবই একই কারণে।”

“আমি এ কথা কখন বললাম, প্রকাশ? পাঁচটা মৃত্যু একই কারণে — ওপর থেকে আছড়ে পড়ে। একটা বন্ধ ঘরে হার্ট অ্যাটাকে।”

“তা বলছি না। তুমি বলছ এর পেছনে একজন আফ্রিকান ভূত আছে।”

“মৃতদের মধ্যে মাত্র একজন আফ্রিকানের কথা বলেছিল, প্রকাশ। আর মাত্র একজন আফ্রিকান ছিল। এই রিসেন্ট তিনটে মৃত্যুর সঙ্গে আফ্রিকানের কোনও সম্পর্ক আছে কি? আমি জানি না। বলিওনি।”

“তাহলে তুমি কী বলছ, বলবে আমাকে?”

“আমার একটা অনুরোধ রাখবে?”

“কী?”

“ওই আফ্রিকানের ফাইলটা ভালো করে পড়ে দেখো নিজেই। দেখো কোনও লিঙ্ক পাও কি না।”

“তোমাকে বলেছি তো, খুব সিক্রেট ফাইল।”

“আমাকে দেখাতে হবে না। তুমি নিজে দেখো। তুমি ডেপুটি কমিশনার, পারবে না?”

কিন্তু কিন্তু করে প্রকাশ বললেন, “বেশ। দেখে জানাব।”

“আর একটা কথা আছে… তোমরা অরুণকিশোর মারা যাবার পরে আশেপাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে ঢুকে দেখতে চেয়েছিলে। এবারও কি তা–ই করবে?”

অবাক প্রকাশ বললেন, “সে তুমি জানলে কী করে?”

“ওপরে ছ’তলার সিক্স ‘বি’ ফ্ল্যাটটা আমার এক সিনিয়র দাদাস্থানীয় ডাক্তারের। আমেরিকাবাসী। বলেছিলেন একবার গিয়ে দেখে আসতে ওই ফ্ল্যাটে সব ঠিক আছে কি না। ওটাতেও তো পুলিশ ঢুকেছিল। আমি ভেবেছিলাম আজ যাব। কিন্তু আজ যদি তোমরা ওখানে থাক, তাহলে…”

“ঠিক বলেছ। আজ বরং যেও না। আমাদের কাজ মিটলে তোমাকে জানিয়ে দেব।”

ফোনটা নামিয়ে রেখে ডাঃ চন্দ্র ভাবলেন, এবারে ওই পাঁচ বছরের বাচ্চাটারই বা কী হবে, আর অরুণকিশোরের বিপত্নীক প্রৌঢ় বাবা–ই বা বাকি জীবনটা কী করে চালাবেন?

~তেরো~

দিন দুয়েক পরে টেলিফোন করে প্রকাশ বললেন, “আমাদের কাজ শেষ। আপাতত মণিমালার বাবা বলেছেন, ও ফ্ল্যাটে কাউকে ঢুকতে দেবেন না। রাতে থাকতে তো দেবেনই না। তুমি ঠিক বলেছিলে, আমাকে কিছু বলতে হয়নি। ওনারাই ঠিক করেছেন।”

“আফ্রিকানের ফাইল পেয়েছ?”

“পেয়েছি। দুটো দিন সময় দাও। কাজের খুব চাপ।”

প্রকাশকে তাগাদা দিয়ে লাভ নেই। চেম্বার শেষ করে ডাঃ চন্দ্র এলেন ‘স্টেশন টাওয়ার্স’–এ। সুমিতকে ডাঃ সেন বলে রেখেছিলেন বলে সিক্স ‘বি’–তে প্রবেশাধিকার পেতে দেরি হলো না। বরং “যাঁরা বাইরে থাকেন, চাবি এখানে রাখেন, তাঁরা তো প্রায়ই কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে ফ্ল্যাটের দেখাশোনা করতে বলেন। একমাত্র ডাক্তারবাবুই কোনও দিন কাউকে পাঠাননি। কেবল আমার কাছে চাবি পড়ে থাকে। আমার টেনশন থাকে — কখনও কিছু গোলমাল হলে আমার নামে না দোষ পড়ে…” অনুযোগ শুনতে হলো।

ডাঃ চন্দ্র নিচের তলার ফ্ল্যাটের কথা জানতে চাইলেন। “কী অদ্ভুত কাণ্ড, স্যার — দশ দিনের মধ্যে পর পর তিনজন মারা গেলেন — ওই একই ভাবে — ওই একই জায়গায় পড়ে!” অরুণকিশোরের মায়ের মৃতদেহ বেশিক্ষণ পড়ে থাকেনি। উনি পড়েছিলেন রাত আড়াইটের পরে। আর সিকিউরিটি তিনটের সময় রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখতে পায়। “চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আগের দু’বারেও রক্ত ছিল স্যার, কিন্তু মাসিমার বডি থেকে এত রক্ত…”

বাচ্চাটা কোথায় জানে না সুমিত। বোধহয় সরকারবাবু — মানে মণিমালা ম্যাডামের মা–বাবার বাড়িতেই। অরুণকিশোরের মা–বাবাকে চিনত না সুমিত। আগে কখনও আসেননি। এবারে এসেছিলেন জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করতে। কিন্তু সে তো হলো না। অরুণকিশোরের বাবা চলে গেছেন কোন আত্মীয়ের বাড়ি — সুমিত জানে না ঠিক। সরকারবাবু এসে ওই অবস্থাতেই বাড়িতে তালা দিয়েছেন।

এর আগে? না, ও বাড়িতে কেউ মারা যায়নি। ফ্ল্যাটটা তো খালিই ছিল। তাই মারা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না অবশ্য।

লিফট থেকে বেরিয়ে সুমিত নিজেই চাবি দিয়ে ডাঃ সেনের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল। ডাঃ চন্দ্র বুঝলেন ছেলেটা চাবি রেখে চলে যেতে ইতস্তত করছে — ওদিকে অফিস খোলা রেখে এসেছে, থাকতেও পারছে না… ডাঃ চন্দ্র তাই ভিডিও কল করলেন ডাঃ সেনকে। মিনিট খানেক কথা হতে না হতেই, সম্ভবত দুজনের বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথনের সুরে নিশ্চিন্ত হয়ে সুমিত চাবিটা ডাঃ চন্দ্রর হাতে দিয়ে চলে গেল।

কথা বলতে বলতেই সারা বাড়িটা ঘুরে দেখলেন ডাঃ চন্দ্র — ডাঃ সেন–ও দেখতে পেলেন। মনে হলো না পুলিশের ভেতরে আসার কোনও চিহ্ন রয়েছে বলে। ডাঃ সেন বললেন, “একটা বিষয় আমার অদ্ভুত লাগছে। সেটা হলো হাসপাতালে ছ’তলায় দুর্ঘটনা ঘটত। এখানে সেটা পাঁচতলায় নেমে গেল কেন?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ও, ওটা আমি এসেই বুঝেছি। সেটা আপনার হিসেবের ভুল। আপনি সিক্সথ ফ্লোরে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এটা ছ’তলা নয়। সাত–তলা। কারণ এখানে একতলাকে গ্রাউন্ড ফ্লোর বলা হয়। হাসপাতালে গ্রাউন্ড ফ্লোর ছিল না। মনে আছে, লিফটেও জি, বা শূন্য ছিল না? এক থেকে শুরু হত। আর ফ্লোরগুলো ফ্লোর ওয়ান, ফ্লোর টু… করে নাম দেওয়া ছিল। ফ্লোর জিরো ছিল না। তাই হাসপাতালের ফ্লোর সিক্স ছ’তলা, আর এ বাড়ির সিক্সথ ফ্লোর সাততলা। অর্থাৎ, ফ্ল্যাট ফাইভ ‘বি’ আসলে অকুস্থল। এ বাড়িরও ছ’তলা অভিশপ্ত প্রমানিত হলো।”

একটু অবাক, একটু হতাশ সুরে ডাঃ সেন বললেন, “তুমি বলতে চাইছ, আমার ফাইভ ‘বি’ কেনা উচিত ছিল?”

ডাঃ চন্দ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “দাদা, ভূত বিশ্বাস করি বলে আপনি আমাকে পাত্তা দেন না, কিন্তু আমি অত সহজে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারছি না। অন্তত এটা তো মানবেন, যে এই বাড়ির ওই জায়গাটা অজস্র অদ্ভুত মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত?

ডাঃ সেন বললেন, “ভায়া, যে কোনও বাড়িতেই অজস্র লোকের মৃত্যু হয়েছে। ‘স্টেশন টাওয়ার্স’–এ একশো বারোটা ফ্ল্যাট। সেখানে কত লোক আজ অবধি মারা গেছে খোঁজ নিয়েছ?”

“কিন্তু একটাই ফ্ল্যাট থেকে, বা একটাই বাড়ির একই পয়েন্ট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচজনের আর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ার জায়গা নেই, তখন হার্ট অ্যাটাকে — কজন মারা যায়? এমনকি বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি করার পরেও?”

ডাঃ সেনের ‘কো–ইনসিডেন্স… সমাপতন… নানা পাহাড়ি শহরে সুইসাইড পয়েন্ট থাকে’–মার্কা উত্তর শুনে ডাঃ চন্দ্র আর কথা বাড়ালেন না। পাহাড়ি শহরের সুইসাইড পয়েন্ট, আর শহরের ফ্ল্যাটবাড়ির বারন্দা এক হলো? অবিশ্বাসীদের চোখে আঙুল দিলেও তারা ভাবে হাওয়ায় চোখ জ্বলছে। এ–কথা সে–কথা বলে শেষ করলেন।

সাত–তলার ফ্ল্যাটে বেশিক্ষণ থেকে লাভ হবে না, ডাঃ চন্দ্রর মন বলছে, কিন্তু একবার চলে গেলে আর চট করে ফেরা হবে না — তাই যেতেও মন চাইছে না। আবার সারা ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখলেন। ছোটো–ই ফ্ল্যাট। ছোটো বসার ঘর, খাবার ঘর, আর একটা বেডরুম। রান্নাঘর, বাথরুম। বিদেশ থেকে তিন সপ্তাহের জন্য ঘুরতে আসা দম্পতির পক্ষে যথেষ্ট। তবে ফ্ল্যাটের তুলনায় বারান্দাটা বড়ো। এটা হয়ত আধখানা ফ্ল্যাট। চাইলে পাশের ফ্ল্যাটটা এক করে দেওয়া যেতে পারে — তাহলে বেশ বড়ো সাইজের ফ্ল্যাট হবে।

বারান্দায় গেলেন প্রায় ভয়ে ভয়ে। রেলিঙের কাছে না গিয়ে যতটা সম্ভব দূর থেকে নিচে উঁকি দিলেন। অনেকটাই উঁচু। ডাঃ চন্দ্রর উঁচু জায়গা থেকে সরাসরি নিচে তাকালে মাথা ঘোরে, তাই একঝলক দেখেই পিছিয়ে এলেন। কিন্তু কী একটা অদম্য ইচ্ছার টানে আবার এগিয়ে গেলেন এক পা। রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নিচে দেখা যায়, কিন্তু সেটা সরাসরি নিচে নয়। আবার শরীরটা ঝুঁকিয়ে তাকালেন সরাসরি নিচে।

তীক্ষ্ণ শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল।

ভয়ঙ্কর চমকে উঠেছিলেন। পেছু হটতে গিয়ে বারান্দার দরজার গায়ে ধাক্কা খেলেন। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। কোনও রকমে পা বাড়িয়ে দিয়ে জুতোর ওপর পড়তে দিলেন। তারপরে তুলে নিয়ে দেখলেন, কোথাও ভাঙে–টাঙেনি।

আবার বাজল কলিং বেল। এত তাড়াতাড়ি সুমিত ফিরে এল? খুব বেশি সময় তো কাটেনি? বাইরে দেখার ‘পিপ–হোল’ দিয়ে তাকিয়ে বুঝলেন সুমিত না। অন্য কেউ।

দরজা খুলে ছোটোখাট চেহারার ছেলেটাকে মনে হলো আগে দেখেছেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না। বললেন, “বলুন…?”

ছেলেটা বলল, “স্যার, আমি লিফটম্যান…”

লিফটম্যান? ও! সেইজন্য চেনা লেগেছিল। এই ছেলেটাই ছিল লিফটে — কিন্তু পরনে ছিল ছাই–রঙা উর্দি। এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরোনো, রং ওঠা টি–শার্ট, আর বার্মুডা পরে। বললেন, “ও, ডিউটি শেষ এখন?”

ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ, স্যার। যাবার আগে আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এলাম।”

দরজাটা পুরোটা খুলে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমি কিন্তু এখানে থাকি না। ফ্ল্যাট–মালিকের হয়ে দেখতে এসেছি কেবল। যা–ই হোক, ভেতরে আসুন।”

ছেলেটা বলল, “না, স্যার, এখানে না। এখানে সব সিসিটিভি–তে দেখা যায়। বাড়ির ভেতরটাও অফিসে দেখা যায় — কেবল ফ্ল্যাটের মালিক থাকলে তবেই বন্ধ করার নিয়ম। এমনি কিছু না, তবে সুমিতদা দেখতে পেলে আবার জিগেস করবে কেন গেছিলি। আমি স্যার বাইরে আছি — এই গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে গিয়েই ওষুদের দোকান, মনসা, তার গায়ে চায়ের দোকান। ওখানে আছি স্যার। আপনি আসবেন, দুটো কথা বলতাম…”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমার আর বেশিক্ষণ লাগবে না। আসছি। কী নাম আপনার?”

“বাবু, স্যার…” বলে ছেলেটা আর দাঁড়াল না। তরতরিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়েই।

ডাঃ চন্দ্র আর বেশিক্ষণ রইলেন না। আরও একবার ফ্ল্যাটের ভেতরটা চক্কর দিয়ে, সব দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে বেরোলেন। নতুন লিফটম্যান বার দুয়েক তাকাল, কিন্তু ‘নিচে যাবেন, স্যার?’ ছাড়া আর কিছু বলল না। ডাঃ চন্দ্রও কিছু বললেন না। শুধু মাথা নাড়িয়ে জানালেন, বিলক্ষণ — নিচেই যাবেন বটে।

অফিসে সুমিতকে চাবি দিয়ে বললেন, পরে দরকার পড়লে আবার আসবেন। সুমিতও আবার একগাল হেসে জানাল, ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণে কোনও ত্রুটি হচ্ছে কি না দেখার জন্য মালিক যদি কাউকে মাঝে মাঝে পাঠান, সেটা ভালো–ই হবে।

গেট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে বাঁ দিকে মা মনসা মেডিক্যাল হলের দিকে হাঁটা দিলেন। মনে পড়ল, একসময় কতবার রোগীদের বলেছেন, ‘এদিকে গেলে মনসা আছে, ওদিকে গেলে বড়ো বড়ো দোকান পাবেন।’ পুরোনো পাড়াটা একই রকম আছে।

মনসার পাশের গলির মুখেই চায়ের দোকান। একটু দূরে থাকতেই বাবু বেরিয়ে এল দোকান থেকে। সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করল একটু। তারপরে বলল, “আসলে আমি শুনলাম, আপনি সুমিতদাকে জিগেস করলেন, ওই ফেল্যাটে আর কেউ মারা গেছে কি না।”

ডাঃ চন্দ্রর সমস্ত মনোযোগ এবারে বাবুর ওপর।

ও বলে চলল, “বাড়ি তৈরির সময়ে একজন মরেছিল। রাজমিস্তিরি। একটা সময় কন্টাকটর রাতে কাজ শুরু করল, তাড়াতাড়ি শেষ করবে বলে। সে বড়ো বড়ো বাতি দিয়ে রাতকে দিন বানিয়ে দিয়েছিল। সাত দিন কাজের পরে একজন রাজমিস্তিরি ভারা থেকে পড়ে মারা গেল। তখন আবার ভয় পেয়ে রাতে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।”

“কোত্থেকে পড়ে গিয়েছিলেন রাজমিস্তিরি?” জানতে চাইলেন ডাঃ চন্দ্র। যদিও জানতেন কী উত্তর আসবে।

“ওই ছ’তলা থেকেই। দেওয়ালের কাজ হচ্ছিল…”

“তারপরে?”

ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তার আবার পর কী? পড়ে মরে গেল, পুলিশ–টুলিশ এল, গরিব মানুষ মরলে যতটা হইচই হয়, হলো। আর কী? তারপরে যেমনটা তেমন…”

“এই রাজমিস্তিরির মারা যাওয়ার ব্যাপারে আপনার কোনও ভুল হয়নি? তাহলে পুলিশকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব। এবং উনি যে ছ’তলাতেই কাজ করছিলেন, তা–ও শিওর?”

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার বাবা ছিল। সেইজন্যই আমি চাকরিটা পেয়েছি।”

~চোদ্দো~

“ছ’টা নয়, সাতটা মৃত্যু।”

প্রকাশ কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। বললেন, “কে বলল?”

“বাড়ি বানানোর সময় ভারা থেকে পড়ে গিয়ে একজন রাজমিস্তিরি মারা গিয়েছিলেন। পুলিশ কেস নিশ্চয়ই হয়েছিল — তোমাদের রেকর্ডে থাকবে। যেটা ইন্টারেস্টিং, তা হলো রাত্তির বেলা কাজ হচ্ছিল, এবং ছ’তলা থেকেই পড়েন। তারপরে রাত্তিরে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রকাশ বললেন, “অত বড়ো একটা বাড়ি থেকে কেউ পড়ে গেলে তো মারা যাবেই। আর কেউ মরেনি? বড়ো বাড়ি তৈরি করতে বাড়ি–প্রতি কতজন ভারা থেকে পড়ে মারা যায় তুমি জানো? তা বলে সেটাও…” বলতে বলতে থেমে হাত নেড়ে বললেন, “না। ইউ আর রাইট, টু মেনি ডেথ্‌স্‌। কিন্তু এবারে কী করবে?”

“আমার মনে হয় প্রথম মৃত্যুটা নিয়ে ভাবা উচিত। তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”

আবার তিনজনে প্রকাশের বসার ঘরে বসে কফি খাচ্ছেন। আজ প্রকাশ নিজেই ডাঃ চন্দ্রকে ডেকেছেন। ফাইলটা হাতে নিয়ে বললেন, “এনেছি। তোমাকে দেব না — কী কী জানতে চাও বলো…”

“যিনি মারা গেছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে কতটা বলতে পারবে?” একটা খাতার ওপর কলম বাগালেন ডাঃ চন্দ্র।

ফাইলটা খুলে প্রকাশ শুরু করলেন, “ভদ্রলোকের নাম আজুজি কোরাবুরু, ওরফে আদ্রিক চাইনিকভ।”

চমকে তাকালেন ডাঃ চন্দ্র। “মানে? একই লোকের নাম?”

একটু আমতা আমতা করে প্রকাশ বললেন, “তা–ই তো লেখা দেখছি।”

“একই লোকের নাম কী করে আফ্রিকান, এবং রাশিয়ান দুই–ই হয়?”

প্রকাশ বললেন, “আজুজি কোরাবুরু আফ্রিকান? আর অন্যটা রাশিয়ান?”

ডাঃ চন্দ্র জোর দিয়ে বললেন, “অবশ্যই। চাইনিকভ নামে রাশিয়ার ফুটবলার ছিল — একজন আর্টিস্টও ছিলেন বোধহয়। অত মনে নেই।”

পাশ থেকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে পরী বললেন, “ঠিক। চাইনিকভ সার্চ করলে গুগুল বলছে বটে — এই যে — গ্রিগরি চাইনিকভ, উদমুর্তিয়ার লোক।”

প্রকাশ বললেন, “ও, এখানে লোকটার একটা জীবনী আছে। ঠিক বলেছ। আজুজি কোরাবুরু। নাদেলে শহরের অনাথ বাচ্চা, অনাথ আশ্রমে থেকে রাশিয়ান এক দম্পতি নিয়ে যায় উদুমুর্তিয়ায় — পরবর্তীতে যেটা উদুমুর্ৎ রিপাবলিক হয়েছে রাশিয়ান ফেডারেশনে। সেখানে রাশিয়ান নাম দেয়, পড়াশোনা শেখায়। কলেজ পাশ করে ফ্রান্সে ডক্টরেট করে ফিরে যায় স্বদেশে। ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস জয়েন করে, এবং বিভিন্ন দেশে পোস্টিং–এর পরে আসে এখানে। ছবিও আছে।”

ফাইল থেকে কয়েকটা ছবি বের করে দিলেন প্রকাশ। পাশে–বসা পরীও ঝুঁকে পড়লেন দেখার জন্য। প্রথমটা পাসপোর্ট ছবির মতো — আবক্ষ। আজুজি কোরাবুরু সরাসরি তাকিয়ে ক্যামেরার দিকে। পরের কয়েকটা ছবির একটাতে কোরাবুরু একজন পরিচিত দেশী সিনেমা তারকার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। ছবিটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ চন্দ্র। তারপরে সিনেমা তারকার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এনার হাইট কত রে?”

ফোনের স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে পরী বললেন, “কম না। দাঁড়াও, গুগল করি… এই যে, পাঁচফুট এগারো ইঞ্চি।”

এবারে কোরাবুরুর দিকে আঙুল দেখিয়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “কিন্তু এখানে তো স্পষ্ট যে কোরাবুরু এনার চেয়ে বেশ খানিকটা বেঁটে…”

প্রকাশ বললেন, “ছবি দেখে বুঝতে হবে কেন? আমার কাছে তো রয়েছে। উচ্চতা ১৭৩ সেন্টিমিটার। তার মানে কত হলো?”

পরী বললেন, “পাঁচ ফুট সাত–আট ইঞ্চি মতো।”

ডাঃ চন্দ্রর কপালে এখন গভীর ভ্রুকুটি। কিছু না বলে চেয়ে আছেন ছবির দিকে। প্রকাশ বললেন, “কী হলো তোমার?”

সম্বিত ফেরার মতো চমকে বললেন, “না, সেরকম কিছু না… আর কী আছে? ওই সময়ে ও–ঘরে কে কে ছিল, সে খবর আছে কি?”

পাতা উলটে দেখে প্রকাশ বললেন, “কেউ ছিল না। ঘণ্টাখানেক আগে দু’জন দেখা করতে এসেছিল। তবে তাদের তো জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি দেখছি। ওরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নাকি সোজা এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেন ধরে দেশে ফিরে গিয়েছিল। ফলে… অবশ্য ওরা বেরিয়ে যাবার মিনিট পনেরো পরেও নার্স রোগীকে দেখেছে, তাই ওরা সাসপেক্ট ছিল না।”

“মিডিয়া অন্যরকম রিপোর্ট করেছিল — আমার ফাইলে দেখেছ?”

“আগেই বলেছি, মিডিয়ার শার্লক হোমস, ফেলুদা, আর ব্যোমকেশরা স্বচ্ছন্দে হিজিবিজি লেখে। যা হোক, ভিজিটর দুজনের নামও রয়েছে — চাই নাকি?”

অনেক রাত অবধি আজুজি কোরাবুরু ওরফে আদ্রিক চাইনিকভ সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে ডাঃ চন্দ্র ফিরে গেলেন নিজের বাড়ি।

~পনেরো~

রবিবার সকালে, শহরের অভিজাত এলাকার একটা বিখ্যাত ক্যাফেতে ডঃ চন্দ্র যখন ঢুকলেন, তখনও বেশি ভীড় হয়নি। চন্দ্রর মতে এই ক্যাফেটা এক বিদেশি দম্পতি চালান বলেই এখানে বিদেশিদের ভীড় হয় — নইলে ওদের খাবার, বা পানীয় কোনওটাই ‘বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানানোর মতো নয়’। ক্যাফে–টা এখনও খালি। এগিয়ে আসা কর্মচারীর “ওয়েলকাম টু দ্য ক্যাফে, স্যার”–এর উত্তরে অল্প মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “দোতলাটা খুলেছেন?”

ওটা সকালেই খোলা হয় না, একতলাটা ভর্তি হলে তবেই খোলা হয়। ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমার একজন গেস্ট আসবেন, আমরা ঘণ্টাখানেক, বা হয়ত ঘণ্টা–দুয়েক একটা গোপন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। সে সময়ের মধ্যে আপনাদের নিচেটা ভর্তি হবে না। কিন্তু আমাদের নির্জনে আলোচনা জরুরি। আজকের দিনের জন্য কি ওপরটা একটু আগে খোলা সম্ভব? তেমন হলে আমিই ম্যানেজার বা মালিককে রিকোয়েস্ট করতে পারি…”

ওয়েটার ডাঃ চন্দ্রকে চেনে। ভদ্রলোক প্রায়ই ওদের প্রিয় সায়েব–সুবো অতিথিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেন। এঁর জন্য মালিক বা ম্যানেজারকে ডাকার দরকার নেই। বলল, “আমি খুলে দিচ্ছি, স্যার। আপনি কি গেস্টের জন্য অপেক্ষা করবেন, না এখনই অর্ডার দেবেন?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “একটা কফি দিয়ে যান। আমার গেস্ট এসে আমার নাম বলবেন। আমার নাম জানেন তো?”

ওয়েটার জানে। বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। আসুন।”

যে ভদ্রলোক ঢুকে ওয়েটারকে বললেন, “এক্সকিউজ মি, ওয়ান ডাঃ চন্ডো ইজ ওয়েইটিং…” তাকে দেখে ওয়েটার অবাকই হল। এতদিন ডাঃ চন্দ্রকে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গেই আড্ডা দিতে দেখেছে। এরকম আবলুশ কাঠের মতো কেউ আসবেন সে ভাবেনি।

ওয়েটারদের অবাক হওয়া বারণ। সসম্ভ্রমে অতিথিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল দোতলায়। কফির অর্ডার নিয়ে ফিরে এসে রান্নাঘরে বলল, “আফ্রিকার লোক বেঁটেও হয়, জানতাম না!”

কফি নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখল, দুই ভদ্রলোক গভীর আলোচনায় মগ্ন। ডাঃ চন্দ্র বলছেন, “সো, আই থিঙ্ক সামথিং হ্যাপেন্ড, বিকজ অফ হুইচ সামবডি ওয়াজ অফেন সিন ইন দ্য হসপিটাল। বাট হি ওয়াজ নট আজিজি কোরাবুরু। অল দোজ হু স’ হিম সেড দ্যাট হি ওয়াজ ভেরি টল।”

কফি দেওয়ার ফাঁকে, এবং তারপরে অন্যান্য টেবিল সাজাতে সাজাতে সে আরও শুনতে পেল, কোরাবুরু লম্বা হতে পারেন না। এই ভদ্রলোকও ওই একই প্রজাতির লোক, এবং ওরা সবাই খুব বড়োজোর পাঁচ আট, বা ন ইঞ্চি লম্বা। অবশ্য সে প্রজাতির খুব কম লোকই বাকি আছেন। আফ্রিকায় তো প্রায় সবাইকেই জাতিবিলোপকারী গণহত্যায় মেরে ফেলা হয়েছে। খুব বড়োজোর কয়েক হাজার কোরাবুরু রয়েছেন এখন, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে…

পরদিন রবিবার। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রকাশ বললেন, “কী জানতে পারল?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আজুজি কোরাবুরু, ওরফে আদ্রিক চাইনিকভের আসল নাম কোরাবুরু না। কোরাবুরু কোনও ফ্যামিলি নাম, বা পদবি নয়। ওটা একটা প্রজাতির নাম। গণহত্যার ফলে আজ অতি সংখ্যালঘু। তবে আজুজি কোরাবুরুর মৃত্যু যতটা এথনিক ক্লেনজিং–এর, ততটাই ব্যক্তিগত শত্রুতার ফল। আজুজি মানে নাকি যে আস্তাকুঁড়ে জন্মেছে। ওর গোটা পরিবারের মৃত্যুর পরে ওকে নাকি ওরকম কোথাও পাওয়া যায়। আজুজি নাম রাখে অনাথালয়ের নার্স–রা। রাশিয়া গিয়ে নতুন নাম হওয়া সত্ত্বেও, বড়ো হয়ে ফ্রান্স ঘুরে নিজের দেশেই ফিরে আসে, বিদেশ মন্ত্রকে কাজ নেয় — এবং নতুন করে আবার পুরোনো আজুজি নামটাই কায়েম করে। তখনই চায়, ওর পদবি হবে ওর জাতির নামটাই — কোরাবুরু।”

“এ সব খবর তুমি ওদের দেশের ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে জানলে… কী যেন নাম বললে?”

মাথা নাড়লেন ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “ঙ্গোমস্তো। মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে আজুজি কোরাবুরু দেশে গিয়ে গ্রামে এক অতিপ্রাকৃত দৈবী খুনী পাঠান, গ্রামের মেয়র, আর তাঁর বাড়ির সবাইকে খুন করার জন্য। কোথা থেকে জানতে পেরেছিলেন, ওই মেয়র–ই নাকি ওনাদের পুরো পরিবারকে মারেন। এই খুনি নাকি একদিন রাতের অন্ধকারে মেয়রের ঘুমন্ত পরিবারকে শেষ করে দেয়। মেয়র, তাঁর স্ত্রী, বোধহয় পাঁচজন ছেলের বউ, চার জন ছেলে, নাতি–নাতনি — সবাইকে।”

“গ্রামের মেয়র হয়?” জানতে চাইলেন প্রকাশ। “আর অতিপ্রাকৃত দৈবী খুনীটা কী বস্তু?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমাদের দেশের গ্রামে হয় না। মোড়ল, পঞ্চায়েত প্রধান, বা গাঁওবুড়া, বিভিন্ন ভাষায় আলাদা নাম। ওদের দেশেও সেরকম কোনও নাম থাকতে পারে, সাহেবদের বোঝার জন্য ওরা ইংরেজিতে মেয়র বলে… আর সবাইকে মেরে ফেলা কেন? প্রতিশোধ। তবে ঙ্গোমস্তো বললেন, সাধারণত দুর্বল জাতি সবল জাতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না। পড়ে পড়ে মার খায়। ফলে আজুজি যেটা করেছেন, সেটা পারিবারিকভাবে নিজের পরিবারের হত্যার বিরুদ্ধে হলেও, ওটা ওদের কাছে গণহত্যার প্রতিশোধই হয়েছে। ওই একই ভাবে আজুজিকে মেরে ওরা–ও প্রতিশোধ নিয়েছে।”

“কে নিয়েছে? ওই মেয়রের পরিবারের সবাই তো মারা গেছে।”

“সবাই না। পরে জানা গেছে, এক ছেলে মারা যায়নি। সেদিন সে কপাল করে ওখানে ছিল না। কোনও কাজে গেছিল গ্রামের বাইরে। পরদিন ফিরে দেখে কেউ বাকি নেই। সে–ই প্রতিশোধ নেয়।”

“এখানে এসে আজুজিকে মেরে যায়?”

মাথা নাড়লেন ডাঃ চন্দ্র। “না। তুমি নিজেই বলেছ, সেদিন ভিজিটররা চলে যাবার পরে হাসপাতালে নার্স ওনাকে জীবিত দেখেছে। আর তা ছাড়া, সে লোকটা দেশ ছেড়ে আসেনি।”

“তাহলে? ওই অতিপ্রাকৃত দৈবী খুনী?”

ডাঃ চন্দ্র দু’হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপরে বললেন, “সমস্যা হলো এই, যে… এ ব্যাপারটা তোমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার বাইরে চলে যাবে। এই দেখো…”

পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে স্ক্রিন আনলক করে বললেন, “এটা দেখো।”

প্রকাশ আর পরী ঝুঁকে পড়লেন। একটু পরে প্রকাশ বললেন, “কী এটা? রাক্ষস, না ভূত, না পুতুল, না মানুষ?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “এই দেখো, রেগে যাচ্ছ! ওসব কিছুই না। এটা সম্ভবত একটা মূর্তি। আমাদের দেশের হলে বলতাম ঠাকুরের মূর্তি। এটা আফ্রিকার একটা প্রজাতির মৃত্যুর দেবতার মূর্তির ছবি। ওগবুনাবালি।”

পরী ফোনে ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বললেন, “বলছে আফ্রিকার একটা বিশেষ প্রজাতির গড অফ ডেথ। কোরাবুরুদের কথা বলেনি তো?”

মাথা নাড়লেন ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “ওগবুনাবালি, এবং ওরকম নামের অনেক দেবতা কাছাকাছি প্রজাতির মানুষের কাছে আরাধ্য। কোরাবুরুদের কাছেও। মেয়রের ছেলে গ্রামের ওঝার কাছে যায়…” প্রকাশের দিকে চেয়ে বললেন, “ওরা ওঝা বলে না, অন্য কিছু দাঁতভাঙা নাম। আমি দু’চারবার জিজ্ঞেস করেও আয়ত্ত করতে পারিনি। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছি। সেই ওঝা ওগবুনাবালিকে আহ্বান করে।”

পরী বললেন, “এখানে বলেছে, ওগবুনাবালি রাতের অন্ধকারে গিয়ে মানুষকে মেরে আসে। যারা খারাপ লোক তাদেরই কেবল।”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ওটা অন্য একটা প্রজাতির মানুষের বিশ্বাস। কোরাবুরুরা বিশ্বাস করে, ওগবুনাবালি নিজে কাউকে মারেন না। প্রতিভূ পাঠান। তিনিই কাজটা করেন। তার নাম ওগাম্বুনালি। এটা তাঁর ছবি।”

এবার ছবি দেখে প্রকাশ বললেন, “এ তো বেশ মানুষ মানুষ দেখতে। মানে ওই যমরাজের মতো ভয়াল মুখ, বা হাতে লম্বা তরোয়াল নেই।”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ইনি মানুষের বেশে পৃথিবীতে ঘোরেন। ওগবুনাবালির নির্দেশে মানুষকে জীবদ্দশা থেকে মুক্তি দেন। ওগবুনাবালিকে যদি কেউ বলে, ওমুককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দাও, ওগবুনাবালি এঁকে পাঠিয়ে দেন।”

প্রকাশ হেসে বললেন, “আর এই ইনি পৃথিবীতে এসে কোরাবুরুর শত্রু ওই মেয়রের সপরিবারকে মেরে ফেললেন? তারপরে কোরাবুরুকে মারলেন? ভালো বলতে হবে! এপক্ষেও খেলছেন, ওপক্ষেও। পুরো সুপারি কিলার! তাহলে হাসপাতালে অন্য লোক মারছিলেন কেন? এখন কেন স্টেশন টাওয়ার্স–এ হানা দিয়েছেন? ওই এক আজুজি কোরাবুরু ছাড়া তো কেউ আফ্রিকানই নয়?”

মাথা নেড়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ওই হাসপাতালের তিন জন নার্স, আর চার–পাঁচজন স্টাফ রাতে হাসপাতালে একটা লম্বা, কালো আফ্রিকান লোককে দেখেছে…”

কথা কেটে প্রকাশ বললেন, “দাঁড়াও, ওটা ওই আজুজির প্রেতাত্মা বলেছিলে তো?” বলে খেয়াল করার ভঙ্গীতে বললেন, “ও, লম্বা…”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “এক্স্যাকটলি। বলিনি কখনও, কিন্তু আমিও ভাবতাম আজুজির প্রেতাত্মা। কিন্তু সেদিন আমরা দেখলাম, আজুজি কোরাবুরুর উচ্চতা বেশি নয়। ওদিকে মিহির গুপ্ত বলেছিলেন, উনি যে আফ্রিকানকে দেখেন, উনি তার কোমরের হাইটে। মিহির গুপ্ত বাঙালিদের তুলনায় বেশ লম্বা। ছ’ফুটের বেশি। আজুজির কোমরের হাইটে নন। তখনই আমার সন্দেহ হয়, খোঁজ করে পুরোনো হাসপাতালের চারজন নার্স, অ্যাটেন্ডেন্টকে ছবিটা দেখাই। সকলেই চারজন আফ্রিকানের ছবির মধ্যে থেকে ওগাম্বুনালির ছবি দেখিয়ে বলেন ইনিই সেই লোক, যিনি হাসপাতালে এখানে ওখানে ঘুরতেন। আমি তখন পড়াশোনা করতে শুরু করি। জানতে পারি কোরাবুরু প্রজাতির আর একজন এখন এখানে পোস্টেড। তিনিই ঙ্গোমস্তো। দেখলাম আজুজির কথা জানেন, এবং আমার সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি। উনিই এসব বলেছেন। ওগাম্বুনালি বিভিন্ন লোককে বিভিন্নভাবে মারেন। কাউকে মুক্তি দিতে, কাউকে শাস্তি দিতে। শাস্তিমূলক পদ্ধতিটা কী জানো?”

দুজনেই চেয়ে রইলেন ডাঃ চন্দ্রর দিকে।

“দশাসই চেহারা ধারণ করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হাতে তুলে নিয়ে অনেক উঁচু থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলে মারেন।”

খানিকক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপরে প্রকাশ বললেন, “তাহলে, তুমি বলছ, ওই ওগাম… কী যেন, সে–ই সবাইকে ধরে ধরে আছড়ে মেরে ফেলছে একানড়ের মতো? কিন্তু কেন?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আমি না, এ সবই ওই ঙ্গোমস্তোর কথা। ওর বক্তব্য, এই, যে শুরুতে ওগাম্বুনালিকে লাগাম ছাড়া অনুমতি দিতে হয়। এবং তারপরে তাকে আবার দমন করতে হয়। তাকেই করতে হয়, যে আহ্বান করেছে। যে কারণেই হোক, এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা করা হয়নি। উনি এখানে রয়েই গেছেন, আর সুযোগ পেলেই মানুষ মারছেন। ওপর থেকে ফেলে।”

মাথা নাড়লেন প্রকাশ। “তোমার হাসপাতালের ওই ওয়ার্ড বয়?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ঙ্গোমস্তোর বক্তব্য, ওকে ওপর থেকে ফেলার কোনও উপায় ছিল না বলে ওগাম্বুনালি অন্যভাবে মেরেছেন। কিন্তু আমি ধরে নিচ্ছি ওটা এই সিরিজের বাইরের মৃত্যু হতেও পারে। কেন যে লোকটা ওই ঘরে গেছিল, তা তো জানা যাবে না, তবে এমন হতেই পারে, কিছু চুরি টুরি করতে গেছিল এবং হার্ট অ্যাটাক হয়েই মারা গেছে — আগে–পরে কোনও রহস্য–ই নেই… কিন্তু…”

“আর বাকিদের ওই ওগুম্‌ খুন করেছে — এ কথা তুমি বিশ্বাস করো? আর আমাকেও বিশ্বাস করতে বলছ — তাই তো?”

ডাঃ চন্দ্র কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন প্রকাশের দিকে। তারপরে বললেন, “মিঃ সরকার — মণিমালার বাবা — আমাকে এক কথায় ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে দেবেন। অবশ্য তুমি পুলিশের বড়োকর্তা, তুমি চাইলেও পাবে। আগামী তিন মাস ওই বাড়িতে একা রাতে থাকতে পারবে, রোজ?”

প্রকাশ আর পরী মুখ তাকাতাকি করলেন। কেউ কথা বললেন না। ডাঃ চন্দ্র একটু পরে বললেন, “আমিও তা–ই ভেবেছিলাম। এখন অবধি একজন বাদে কেউ সে বাড়িতে থাকতে চায়নি। অথচ সবাই আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে — আমি নাকি ভয় পেয়েছি, উদ্ভট জিনিসে বিশ্বাস করি — এই সব…”

পরী বললেন, “কে থাকতে চেয়েছে?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আরে সে এক খ্যাপা ডাক্তার — শেখর সেন — মিহির গুপ্তর ডাক্তার ছিলেন। আগের দিন বললাম না, ভূতের কথায় হাসে…?”

ডাঃ চন্দ্র চলে যাবার পরে পরী জানতে চাইলেন, “এবারে কী করবে?”

প্রকাশ বললেন, “জম্পেশ করে মাংস–ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দেব। অনেক দিন পরে কোনও কাজ ছাড়া রোববার পেয়েছি।”

পরী অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু অশোকদা যে বলে গেল…”

প্রকাশ বললেন, “সে নিয়ে আমি কী করব, বলবে? আমি তো পুলিশ। আমি আফ্রিকার কোন দেশের যমরাজ আর তার যমদূতের পেছনে দৌড়ব?”

পরী হেসে বললেন, “তা না হয় না দৌড়লে। কিন্তু আর কিছু কি করার নেই?”

প্রকাশ বললেন, “কী করা যায়?”

পরী বললেন, “তুমি অনেক বছর আগে একজন তান্ত্রিককে চিনতে না?”

প্রকাশ ভেতরের ঘরে যাচ্ছিলেন। থমকে ফিরে তাকালেন পরীর দিকে।

~ষোলো~

শিবশম্ভু ঠাকুরের সঙ্গে ডাঃ অশোক চন্দ্রর দেখা হলো প্রায় দু’সপ্তাহ পরে। প্রকাশকে অনেকগুলোই ফোন করতে হয়েছিল ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। শেষে জানা গেল সামান্তার বিখ্যাত কালীমন্দিরে সাধুবাবা রয়েছেন গত তিন মাস এবং থাকবেনও আরও কয়েক দিন। ঠাকুরের অনুমতি পেয়ে ডাঃ চন্দ্র রওয়ানা দিলেন সামান্তাভিমুখে।

হিমালয়ের পাদদেশে ছোট্ট শহর সামান্তা — শীতের শুরুতে কালীমন্দিরে পুজো দিতে দিক–বিদিকের লোক আসে — তখন হয়ত বড়োজোর হাজার দেড়েক মানুষের সমাগম হয় — নইলে শহর না হয়ে হয়ত গ্রামই থেকে যেত। ইরিগেশনের ইনস্পেকশন বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রকাশ। ধর্মশালার অভাব অবশ্য ছিল না, যদিও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা অতি প্রাচীন।

যেদিন পৌঁছলেন, সেদিনই শিবশম্ভু ঠাকুর এসে দেখা করলেন। মানুষটাকে দেখে তান্ত্রিক বলে মনেই হয় না। প্রকাশ বলে দিয়েছিলেন, শিবশম্ভু সংসারী তান্ত্রিক। পোশাক আশাক, চলাফেরা, কথাবার্তা, সবই সাধারণ মানুষের মতো। তবু, উনি নাকি বিখ্যাত তান্ত্রিক। অবধূত।

ইনস্পেকশন বাংলোর বসার ঘরে বসে চা আর পকোড়া খেতে খেতে সরাসরি তুই সম্বোধন করে বললেন, “আমাকে প্রকাশ বলেছে, সমস্যাটা কী। তবে এর সমাধান আমি করতে পারব না। তোকে যেতে হবে এখানকার সিদ্ধবাবার কাছে। কিন্তু এখন বাবা শবসাধনায় ব্যস্ত। রোজ সন্ধেবেলা সাধনার ছেদ হয়। তখনই দেখা করতে হবে। উপঢৌকন নিয়ে যাবি। ভুল যেন না হয়।”

“কী নিয়ে যাব?” এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “তোর সঙ্গে যে বড়ো বোতলটা আছে, সেটাই যথেষ্ট।”

স্কচের বোতলটার সম্বন্ধে প্রকাশকেও বলেননি। কিন্তু অবাক হলেন না। এসব ঘটনা আরম্ভের পর থেকে ক্রমে ক্রমে অবাক হওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন ডাঃ চন্দ্র।

সন্ধেবেলা রিকশ করে কালীমন্দিরে পৌঁছলেন। কাঁধে ব্যাগের মধ্যে ভারি বোতল। সূর্য ডুবেছে সবে। নদীতীরে শ্মশান। একটা চিতা নিভে এসেছে। মন্দিরের বাইরে চোয়াড়ে চেহারার কয়েকটা ছেলে বসে ছিল, ডাঃ চন্দ্রকে দেখে আঙুলে তুড়ি দিয়ে সবে বলেছে, “এ, মন্দির বন্ধ্‌, চল্‌, আব্‌ ফোট্‌ ইঁহাসে…” সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে দু’জন সাধু বেরিয়ে এসে হাত তুলে ওদের থামতে বলে ডাঃ চন্দ্রকে হাত নেড়ে ডাকলেন। ছেলেগুলো চুপ করে গেল। মন্দিরের বাইরে জুতো খুলতে হবে — ডাঃ চন্দ্র হাওয়াই চপ্পল খুলে রেখে খালি পায়ে ভেতরে গেলেন সাধুদের সঙ্গে।

মন্দিরের ভেতরে কালীমূর্তির পাশ দিয়ে সরু একটা করিডোর ধরে ক্রমে গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন কোথাও পৌঁছলেন। একটা কণ্ঠস্বর জানাল, এবারে সিঁড়ি নামতে হবে। একেবারেই আন্দাজে, এক হাতে বোতল, অন্য হাতে কাঠের রেলিং ধরে হাতড়ে হাতড়ে নামলেন। একটু যেতে না যেতেই ধোঁয়ার গন্ধ। যত নামেন তত বোঝেন ধোঁয়ার ঘনত্ব বাড়ছে। শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। খাড়া কাঠের সিঁড়ি — আগে বুঝলে পেছন ফিরে মইয়ের মতো করে নামতেন, ভয় হচ্ছে পা হড়কে পড়লে কতদূর যেতে হবে কে জানে। আগে আগে অন্তত একজন সন্ন্যাসী। পড়লে সোজা ওঁর ঘাড়ে। অবশেষে নামা শেষ হলো। সামনে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ওপারে একটা মৃদু আলো… আর সেই সঙ্গে পুজোর গন্ধ। ঘী, ফুল, পাতা, গাঁজা, মিলে মিশে একাকার — আর তার সঙ্গে আর একটা গন্ধ। পচা।

ডাঃ চন্দ্রর মনে হলো — শবসাধনা!

অবশ্য যেখানে যেতে হলো, সেখানে সে সব কিছুই নেই। একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে দুটো মিটমিটে এল–ই–ডি বাল্‌বের আলোয় অন্তত জনা বিশেক সন্ন্যাসী চারপাঁচটা ছিলিমে গাঁজা খাচ্ছেন এবং প্রবল গর্জনে শিবের নাম করছেন। গাঁজার ধোঁয়ায় ঘর ভরপুর। ডাঃ চন্দ্রর মনে হলো অন্তত পাঁচ ছ’জন সন্ন্যাসিনী। সাত আটজনের পরনে কোনও বস্ত্র নেই। তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন মহিলা। ডাক্তার তিনি, উলঙ্গ নরদেহ অপরিচিত নয়, তবু অস্বস্তি হলো।

যাঁদের শরীরে কাপড় রয়েছে, তাঁদের সকলেরই পরনে পট্টবস্ত্র। গলায় আর কবজিতে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো। প্রায় সকলেরই মাথায় জটা — পুরুষদের গালে দাড়ি। ডাঃ চন্দ্র যাওয়ামাত্র হইচই কমে গেল।

এঁদের মধ্যে প্রধান কে, সে তাঁর বসার ভঙ্গী আর অন্যদের ঘিরে থাকা থেকেই বোঝা যায়। রোগা, ছাইমাখা এক বৃদ্ধ সাধু। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। কাপড় তো দূরের কথা, একটা রুদ্রাক্ষও নেই সারা শরীরে। কিন্তু উনি তো চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। কী করবেন এখন ডাঃ চন্দ্র? এক লহমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখলেন পাশে এসে দাঁড়ালেন শিবশম্ভু। চোখের ইশারা করলেন। ডাঃ চন্দ্র এগিয়ে এসে ব্যাগ থেকে টিচার্স হুইস্কির বড়ো বোতলটা বের করে সামনে ধরলেন।

অর্ধনিমীলিত চোখ তুলে বাবা বললেন, “খোলকে দে।”

ছিপি–খোলা বোতলটা হাত থেকে নিয়ে সরাসরি গলায় ঢাললেন এক চুমুক। মুখ বিকৃত করে একবার লেবেলটা দেখে নিলেন। তারপরে ঢকঢক করে প্রায় এক পোয়া বোতল খালি করে পাশে বসা সন্ন্যাসীর হাতে দিলেন। ডাঃ চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে গর্জন করে বললেন, “বোল্‌…”

ডাঃ চন্দ্র ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ব্যাপারটা একটু বলতেই হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বাংলাতেই বল না হয়।”

থতমত খেয়ে ডাঃ চন্দ্র চুপ করলেন। চোখ খুলে তাকিয়ে বাবা বললেন, “বাঁড়ুজ্জে বামুন রে শালা। বল, বাংলাতেই বল।”

মাতৃভাষায় বলতে পেরে ডাঃ চন্দ্র নিশ্চিন্তে সবটাই বললেন গুছিয়ে। কথাটা কিছুটা এগোতে না এগোতেই মৃদু কথার গুঞ্জন কমে নিথর নিরবতা ছেয়ে ফেলেছিল। শেষ হতে হতে টিচার্স–এর বোতলটা আবার ফেরত এসে গিয়েছে বাঁড়ুজ্জের হাতে। এখনও অর্ধেকের মতো হুইস্কি বাকি রয়েছে। এতজন সন্ন্যাসী মিলে এইটুকুই খেলেন? সে কি প্রধানের প্রতি সম্ভ্রমবশত, না কি কাঁচা হুইস্কি সবাই খেতে পারেন না বলে? ডাঃ চন্দ্র কথা শেষ করলেন। ঘরটা এখন নিস্তব্ধ। গাঁজার ধোঁয়া পাক খাচ্ছে দুটো অল্প আলোর বাল্‌বের চারিপাশে। সন্ন্যাসী মাথা নিচু করে বসে আছেন। জেগে আছেন, না ঘুমিয়ে? কেউ কোনও কথা বলছে না। গাঁজার ধোঁয়া মাথায় ঢুকে একটু মাথা ঝিমঝিম করছে ডাঃ চন্দ্রর। অনেকদিন পরে এতটা গাঁজার ধোঁয়া মাথায় গেল। হোক না তা সেকেন্ডারি স্মোক। এতটায় নেশা হতে বাধ্য।

হঠাৎ মাথা তুলে সন্ন্যাসী বললেন, “শালা, বিদেশি দেবতার মৃত্যুদূত! এমনটা তো কখনও শুনিনি! কেয়া? কভি সুনা?”

সকলেই মাথা নাড়লেন। না। কেউ শোনেননি। হুইস্কির বোতলটা আবার মুখে তুলে ঢকঢক করে খেতে শুরু করলেন। এবারে যখন মুখ থেকে নামালেন, তখন সামান্যই বাকি আছে। একবার তাকিয়ে দেখে বোতলটা বাড়িয়ে দিলেন ডাঃ চন্দ্রর দিকে। বললেন, “লে, পরসাদ লে…”

ডাঃ চন্দ্রর গা–টা গুলিয়ে উঠল। অন্তত জনা বিশেকের মুখে দেওয়া বোতলটা নিয়ে তখনও হাতে ধরা ছিপিটা লাগালেন। তারপরে খেয়াল হলো, বন্ধ বোতলটা ভক্তির ভাব করে মাথায় ঠেকিয়ে আবার ব্যাগে ভরে নিলেন। সন্ন্যাসী আবার ততক্ষণে মাটির দিকে চেয়ে রয়েছেন।

শেষে আবার মুখ তুলে বললেন, “ভাবতে হবে। এক কথায় হবে না। কাল আসিস।”

হাত নেড়ে বোঝালেন চলে যেতে। তারপরে হাত বাড়ালেন, কেউ একটা হাতে ছিলিম দিল। পিঠে মৃদু ঠেলা খেয়ে চন্দ্র বুঝলেন এবার যেতে হবে।

হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি উঠে আবার বাইরে এলেন ডাঃ চন্দ্র। শ্মশানে চিতাটা একেবারেই নিভে গেছে। যে ছেলেগুলো ঢোকার সময় ফোট্‌ বলেছিল, তারা–ই এখন উঠে দাঁড়াল। মুখে সম্ভ্রম। একটু দূরে রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করছে। পা বাড়িয়েছেন, একটা ছোকরা ছুটে এসে বলল, “আপকো বুলা রহা হ্যায়…”

ফিরে দেখলেন, মন্দিরের দরজায় শিবশম্ভু।

“কাল আবার একই সময়ে আসতে পারবি?”

পারবেন। পারতে তো হবেই। বললেন, “আমার কাছে তো নিয়ে আসার মতো আর কিছু বাকি নেই।”

শিবশম্ভু বললেন, “আসব প্রথম দিন এনেছিস, তা–ই যথেষ্ট। কাল আনতে হবে না। সম্বিদা আনিস।”

আসব? মানে? আন্দাজে বুঝলেন আসব মানে মদ, বা সুরা। কারণবারি। কিন্তু সম্বিদা?

মুখের ভাব দেখে বুঝলেন শিবশম্ভু। বললেন, “গঞ্জিকা।”

অসহায় বোধ করলেন ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “বাবা, এখানে সে কোথায়…?”

শিবশম্ভু বললেন, “তোকে ভাবতে হবে না।” শ্মশানের ছেলেগুলোর দিকে দেখিয়ে বললেন, “কাল তুই যখন আসবি, তখন ওরা তৈরি রাখবে। তুই ওদের দু’হাজার টাকা দিয়ে দিস।”

ইনস্পেকশন বাংলাতে ফিরে বোতলটা আবার ভরে রাখলেন সুটকেসে। এখানে কিছু করবেন না। বাড়ি ফিরে ফেলে দেবেন।

পরদিন কিছু করার নেই, বসে বসে তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে পড়াশোনা করলেন। তন্ত্রের প্রকারভেদ, দেহাত্মবাদ, তান্ত্রিক এবং ভৈরবী, নানা প্রকারের তন্ত্রসাধনা — পড়তে পড়তে মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে কী মনে হলো, আজুজি কোরাবুরুর অতীত নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলেন। ইন্টারনেটে একটু ঢুকতেই, এমন ডুবে গেলেন, যে বাংলোর রাঁধুনি–কাম–বেয়ারা যখন এসে বলল, “খানা লাগা দুঁ, সাব?” তখন চমকে বললেন, “পাঁচ মিনিট… না, দশ মিনিট। ম্যায় নাহা–কে আতা হুঁ।”

খেতে খেতেই ফোন এল পরীর। ডাঃ চন্দ্র বললেন, “না, এখনও সমাধান হয়নি কিছু। বিদেশি অপদেবতার বিরুদ্ধে লড়াই হয়ত সহজ নয়। কিন্তু আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছি। আজুজি কোরাবরু রাশিয়াতে কোথায় গিয়েছিলেন মনে আছে?”

পরীর মনে নেই। ডাঃ চন্দ্র মনে করালেন — উদুমুর্তিয়া। এখন যেটা ফেডারেশনে উদুমুর্ৎ রিপাবলিক। “জানিস, রাশিয়ার অন্যতম দেশ, যেখানে নানা রকম প্রাচীন বিশ্বাস, কুসংস্কার এখনও আছে। লোকে বিশ্বাস করে অপদেবতার প্রভাবে মানুষ নানা রকম অসুখে ভোগে — সামান্য ভুল-ভাল চিন্তা থেকে শুরু করে নানা রকম মানসিক সমস্যা, কথা বলতে না পারা, বেশি কথা বলা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে!”

পরী একটু অবাক হয়ে বললেন, “তো? তোমার এখনকার কাজের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “কাজের সঙ্গে হয়ত নেই, কিন্তু আজুজি কোরাবুরুর ভাগ্যের কথাটা ভাব। বেচারা ছেলেটা একটা ব্যাকওয়ার্ড আফ্রিকান দেশ থেকে আর একটা ব্যাকওয়ার্ড সমাজে গিয়েছিল। একটা এনলাইটেন্ড সমাজে যদি যেতে পারত, তাহলে হয়ত এ সব আধিভৌতিকে বিশ্বাস করত না — তাহলে হয়ত এখনও বেঁচে থাকত, এত মৃত্যুও হত না আর আমাকে এইভাবে কাপালিকদের পেছনে ঘুরে বেড়াতে হত না।”

একটু কিন্তু কিন্তু করে পরী বললেন, “এই লজিকটা খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে তোমার মুখে। তুমি নিজে আধিভৌতিক, প্যারানর্মাল, অপদেবতা, ভূত — এসব বিশ্বাস কর। নিজেই ছুটে বেড়াচ্ছ। আর দোষ দিচ্ছ কোরাবুরুর ভাগ্যের?”

একটু হেসে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “সবই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর রে, মেয়েটা। এই দেখ, আমি বিশ্বাস করি বলেই ঘুরছি। তোর বরটা বিশ্বাস করে না, তাই ওর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এল না। তেমনই কোরাবুরু যদি বিশ্বাস না করত, তাহলে ও ওগাম্বুনালিকে ডাকত না। ও না ডাকলে ওই মেয়রের ছেলেও ডাকত না। সবই বিশ্বাস রে, সবই বিশ্বাস। শুধু তর্কেই বহুদূর!”

ওপারে খিলখিল হাসির সঙ্গে শুনলেন, “তর্কে কোথায়? তোমার বিশ্বাসের ফলেই তো তুমি এখন বহুদূর গেছ, আরও বহুদূরের ভূত তাড়াতে — তাহলে দেখো — বিশ্বাসেই বহুদূর!”

“ধ্যাৎ,” বলে ফোন রেখে হাত ধুতে গেলেন ডাঃ চন্দ্র।

~সতেরো~

সরকারমশাইয়ের কেতাদুরস্ত গালচেপাতা বসার ঘরে নরম সোফায় বসে ডাঃ চন্দ্র সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, “আহা! কতদিন পরে এমন সিঙাড়া খেলাম!”

উৎসাহিত হয়ে সরকারমশাই বললেন, “বলুন, কেমন অপূর্ব স্বাদ নয়? মশাই, এসব তো এদিকে পাওয়াই যায় না, সব সেই সামোসা! হাতে ধরতে অ্যাত্তোবড়ো, তারপরে কামড়ে গণ্ডারের চামড়ার মতো খোলস! আমি মহিমের সিঙাড়া ছাড়া খাই–ই না। আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে যায় বলে একটা ব্যবস্থা করিচি। মহিমের দোকানে আমার বলা আছে। আমার ওদিকে যাওয়া লাগলে ফোন করে দিই, যতগুলো বলি, ততগুলো বানিয়ে রাখে, ভাজে না। আমি নিয়ে আসি। বাড়িতে গিন্নি নিজে হাতে ভাজেন। আজ অবশ্য আপনি আসবেন বলে ড্রাইভার পাঠিয়ে আনিয়ে নিয়েচি…”

“শুধু সিঙাড়া আনতে গাড়ি গেল! সে তো কম করে পঁচিশ কিলোমিটার যাওয়া আসা!”

একটু লজ্জা পেয়ে সরকারমশাই বললেন, “সে হোকগে যাক! আপনি তো আমার জন্য সেই কতদূর গেলেন, রেলগাড়ি করে। আমার আর পয়সাকড়ি দিয়ে কী হবে বলুন, ডাক্তারবাবু, ওই একটা মাত্র মেয়ে ছিল…”

ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন সরকারমশাই। ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ওরকম বলবেন না। যাঁর যখন চলে যাবার তিনি তখন যাবেন। সে অমোঘ নির্দেশ কি আমরা টলাতে পারি? তবু আপনার তো নাতি রয়েছে। তাই না? এখনও আপনার কাছেই আছে?”

ঘাড় নাড়লেন সরকারমশাই। বললেন, “দোতলায় রয়েচে। একা হয়ে গেল যে। দুই বুড়োবুড়ির সঙ্গে… মা–বাপ চলে যাওয়া যে কী কষ্টের… একটা সমবয়সী ছেলে দত্তক নেব ভাবচি। তাহলে দুজনে একসঙ্গে বড়ো হবে — কেমন হবে বলুন তো? অরুণের বাবা বলছেন, ওঁদের এক দূরসম্পর্কের ভাইপো আছে। খুবই গরিব। তার ছেলে এই পাঁচ–সাত বছর বয়েস হবে। তাকে নিতে পারি। ছেলের মা–বাবা রাজি হয়ে যাবে। কী বলেন, ভালো আইডিয়া না?”

কথাটা আর এগোল না, সরকারগিন্নি ঘরে ঢুকলেন এক থালা সিঙাড়া নিয়ে। চারটে সিঙাড়া ডাঃ চন্দ্রর প্লেটে দিতে উনি লাফিয়ে উঠলেন, খানিকটা সময় গেল, “আরে, আরে… এ কী, এ কী!” এবং “খাও তো… এই তো ছোটো ছোটো চাড্ডি সিঙাড়ায়…” বলতে, তারপরে চা খেতে খেতে ডাঃ চন্দ্র পরবর্তী কার্যপদ্ধতি জানালেন।

“সবসুদ্ধ চারজন তান্ত্রিক আসবেন। বিদেশি অপদেবতা তো, যদি তন্ত্রের নিয়ম না খাটে? প্রথমে ফ্ল্যাট শুদ্ধিকরণ করবেন। সেটুকুতেই হলে আর ভাবনা থাকত না, কিন্তু একটা সম্ভাবনা আছে, সে অপদেবতা বাইরেও ঘুরতে পারেন। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের অন্তত একজন সেরকম বলেছিলেন। তাই বাইরেও একটা যজ্ঞ করতে চান ওনারা।”

“কবে আসবেন?”

“বলেছেন, এখন ওঁদের প্রতিপ্রায়ণম্‌ চলছে। সেটা শেষ হতে আরও এক মাস। তারপরে যোগাড়যন্ত্র করে আসতে হবে। এখানে ওঁরা চাইছেন…” বলে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, “মিদ্দানগরের কালীমন্দিরে যজ্ঞ করতে চান। মিদ্দানগরের কালীমন্দির চেনেন কি? আমি নাম শুনিনি। ফিরে এসেও খুঁজে পাচ্ছি না। ম্যাপেও নেই, কেউ বলতেও পারছে না।”

সরকারমশাই–ও চেনেন না। ডাঃ চন্দ্র বললেন, “তাতে সমস্যা নেই অবশ্য — ওনারা এসে আমাকে ফোন করবেন। তখন জেনে নেব। মিদ্দানগর থেকে ওনাদের তুলে আনতে হবে।”

হাত নেড়ে সমস্যাটা নস্যাৎ করে সরকারমশাই বললেন, “গাড়ি পাঠিয়ে দেব। পুজোর যোগাড়যন্ত্র কি ওনারাই করবেন?”

“সবটাই। শুধু বলেছেন, বাড়িটা যথাসম্ভব খালি করতে। কারণ এরকম পরিস্থিতিতে প্রায়ই দেখা যায় অপদেবতারা হাতের কাছে যা পায় তা–ই ভাঙাভাঙি, ছোঁড়াছুঁড়ি করতে থাকে। তাতে উপস্থিত মানুষের আঘাত লাগতে পারে।”

আলোচনা সেরে বেরোবার সময় ডাঃ চন্দ্র সরকারমশাইকে বললেন, “নাতির জন্য সঙ্গী চাইছেন ভালো কথা। কিন্তু ভালো করে খবর নিয়ে নেবেন। যে বাচ্চাটা আসছে, তার মা–বাবার হদিস যদি থাকে, আর গরিব মা–বাবা যদি জানে বাচ্চা কী রকম বাড়িতে মানুষ হচ্ছে, তার ফল অনেক সময় ভালো না–ও হতে পারে।”

গাড়িতে উঠে স্বগতোক্তি করলেন, “বুড়োর মাথায় বুদ্ধি দিয়ে এলাম। এবার ভাবুক।”

~আঠেরো~

প্রায় মাস তিনেক পরে এক দিন ঘুম–ভাঙা সকালে স্টেশন টাওয়ার্স–এর গেট দিয়ে যারা ঢুকল তাদের দেখে বাসিন্দাদের চোখ ছানাবড়া। সঙ্গে সরকারমশাই রয়েছেন, এবং আগে থেকেই জানানো ছিল, যে সিক্স ‘বি’ ফ্ল্যাটে পুজো–আচ্চা, যাগ–যজ্ঞ হবে। তবে তার জন্য যে বহু লটবহর সঙ্গে, হাতে ডম্বরু আর লোহার ত্রিশূল নিয়ে পাঁচ জন জটাজুট এবং লাল পট্টবস্ত্রধারী কাপালিক, এবং একজন কেবলমাত্র ছাই–মাখা উলঙ্গ সন্ন্যাসী আসবেন তা তো জানা ছিল না। ছোটো ছোটো বাচ্চারা তখন স্কুল যাবার জন্য বেরিয়েছে। মায়েরা হাত দিয়ে তাদের চোখ ঢাকলেন, কেউ আবার অ্যাবাউট টার্ন হয়ে ফিরে গিয়ে বাড়িতে বাচ্চার বাবার ওপর হামলে পড়লেন, “এ কীরকম অসভ্যতা! সোসাইটির মধ্যে… এরকম চললে তো এখানে থাকা দায় হবে…”

রিপোর্ট গেল ম্যানেজিং কমিটিতে। সেক্রেটারি প্রেসিডেন্টকে ফোন করলেন, “কী করা উচিত?”

প্রেসিডেন্ট বললেন, “একটু অপেক্ষা করে দেখো…”

ততক্ষণে সন্ন্যাসীরা ফ্ল্যাট সিক্স ‘বি’–তে ঢুকে সকলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেছেন। সারা বাড়ির নানা ফ্ল্যাটের লোকেরা বারান্দা থেকে উঁকিঝুঁকি মারলেন, কিন্তু আগেও দেখা গেছিল, এখন আবারও প্রমাণ হলো, যে কেউ–ই অন্য কারওর ফ্ল্যাটের ভেতরটা দেখতে পান না।

দুপুর নাগাদ ডাঃ চন্দ্র এলেন, সঙ্গে শিবশম্ভু। সুমিত ছুটে এসে আড়চোখে শিবশম্ভুকে দেখে নিয়ে ডাঃ চন্দ্রকে বলল, “স্যার, স্যার… বাড়িতে পুজো হবে?”

ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ঠিক কী হবে তা তো জানি না ভাই, ঠাকুরমশাইরা সিদ্ধান্ত নেবেন।”

সুমিত বলার চেষ্টা করছিল যে পুজো করা জরুরি, কারণ ফ্ল্যাট–টায় হয়ত নজর–টজর লেগেছে — কিন্তু তার জন্য বস্ত্রহীন সন্ন্যাসীর কি কোনও দরকার ছিল? ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে দুজনে উঠে গেলেন ফ্ল্যাট সিক্স ‘বি’–তে।

জোগাড়–যন্ত্র প্রায় শেষ। বাড়ি এখন পুরোটাই খালি। কোনও আসবাব, যন্ত্র, কিছুই নেই। এমনকি দেওয়ালে গাঁথা তাকগুলো পর্যন্ত খুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারমশাই বলেছিলেন, “আলো–পাখাগুলো থাক?” কিন্তু মাথা নেড়েছিলেন ডাঃ চন্দ্র। বলেছিলেন, “ওনারা কাপালিক। শ্মশানে আর মন্দিরে থাকেন। আরাম চাইবেন না। আর আলো তো নয়ই। ভাঙলে কাচ ছড়াবে চারিদিকে।”

এখন জানতে চাইলেন, “আলো লাগবে না? রাতে পুজো করবেন তো?”

মাথা নাড়লেন নগ্ন সন্ন্যাসী, বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “অমাবস্যা আজ। আজ এখানে কেবলমাত্র যজ্ঞের আগুনের আলো–ই থাকবে। সেটাই যথেষ্ট।”

ওগাম্বুনালি আর ওগবুনাবালি অমাবস্যা বোঝে? কে জানে? বললেন, “আমি আপনাদের যজ্ঞ দেখার অনুমতি নিতে এসেছি।”

মাথা নাড়লেন সন্ন্যাসীরা। সিদ্ধি না হলে এ যজ্ঞ দেখা যায় না। তা ছাড়া, কী বিপদ হতে পারে, সে সম্বন্ধে তাঁরা ওয়াকিবহালও নন। তবে শিবশম্ভু সিদ্ধ তান্ত্রিক। তিনি যদি…

শিবশম্ভু বললেন, “আমি থাকব।”

বিকেলে চেম্বারে যেতে যেতে ডাঃ চন্দ্র ফোন করলেন মিনেসোটায়। ডাঃ সেনকে জানালেন, রাতটা ওঁর বাড়িতেই কাটাবেন। সুমিতের কাছ থেকে চাবি নিয়েই বেরিয়েছেন স্টেশন টাওয়ার্স থেকে।

চেম্বার শেষ করে বেরিয়ে দেখলেন রিসেপশনিস্ট আর বাসুর সঙ্গে বসে গল্প করছে সুধাংশু, সঙ্গে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। বললেন, “তুই আবার এখানে কেন?”

সুধাংশু বলল, “তুমি রাতে খাবে না বললে, তাই খাবার নে এলাম।”

ডাঃ চন্দ্র হাত বাড়িয়ে বললেন, “বেশ, টিফিন ক্যারিয়ারটা দে আমাকে।”

মাথা নেড়ে টিফিন ক্যারিয়ার আগলে সুধাংশু বলল, “সে হবে না। খাবার বেড়ে দেবে কে?”

“আমি খাবার বেড়ে নিতে পারি না?”

সুধাংশু চুপ। বাচ্চাদের বোঝানোর ভঙ্গীতে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “শোন, আমি কাজে যাচ্ছি। হয়ত সারা রাতই কাজ করতে হবে। তুই ওখানে গিয়ে করবি কী?”

ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল সুধাংশু। তারপরে বলল, “কাজ না, বিপদ। আমি জানি। আমি সেখেনে তোমাকে একা যেতে দেব না।”

“বিপদ? তোকে কে বলল এসব কথা?”

আঙুল তুলে বাসুকে দেখিয়ে সুধাংশু বলল, “ও বলেছে, আমিও টেলিফোনে তোমার কথা শুনেছি। ওই যে বাড়ি থে’ মানুষ পড়ে মরে যাচ্ছে, সে বাড়িতে যাবে তুমি।”

টেলিফোনে অনেকটা কথাবার্তাই ডাঃ চন্দ্র সেরে নেন গাড়িতে যেতে যেতে। স্বাভাবিকভাবেই বাসু সবই শুনতে পায়। আর বাড়িতে তো সুধাংশু স্বয়ং উপস্থিত। বিড়বিড় করে বললেন, “এর চেয়ে বিয়ে করলেই তো হত!”

একটা শেষ চেষ্টা করলেন। বললেন, “আমার কিছু হলে আমার কেউ নেই। তোর দেশে পরিবার আছে। তুই কেন…”

এবারে টিফিন ক্যারিয়ারটা বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে মাথা নাড়ল সুধাংশু।

স্টেশন টাওয়ার্সে গাড়ি থেকে নেমে ডাঃ চন্দ্র বাসুকে বললেন, “ফিরে যা। রাতে গাড়ি লাগবে না। শোন, গাড়ি গ্যারেজ করে বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। কাল যত তাড়াতাড়ি পারবি হাজির হবি এখানে। এসে ফোন করবি। বুঝলি?”

ঘাড় নাড়ল বাসু। ডাঃ চন্দ্র খেয়াল করলেন বেশি রাতে কমপ্লেক্সে যাঁরা পায়চারি করেন তাঁরা মন দিয়ে দেখছেন। লোকের অযথা কৌতুহল এড়াতে দ্রুতপায়ে লিফটে উঠলেন সুধাংশুর সঙ্গে। লিফটম্যানকে বললেন, “সিক্স।”

লিফটম্যান একবার ডঃ চন্দ্র আর একবার সুধাংশুকে দেখে নিল, সুধাংশুর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার দেখে বলল, “রাতে থাকবেন, স্যার?”

ডাঃ চন্দ্র দেখলেন, বাবু। সংক্ষেপে বললেন, “হ্যাঁ ভাই। থাকব।”

“ফাইভ ‘বি’তে পুজো হচ্ছে?”

“হুঁ।”

“আমার আজ নাইট ডিউটি, স্যার। কোনও দরকার হলে জানাবেন।”

ডাঃ চন্দ্রর বেশি কথা বলার ইচ্ছে নেই। বললেন, “জানাব।”

“আমার ফোন নম্বরটা…” বাবুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে অস্ফূটে থ্যাঙ্ক ইউ বলে লিফট থেকে বেরোলেন।

ডাঃ সেনের ফ্ল্যাটে ঢুকে সুধাংশু বলল, “কই, পুজো কোথায়?”

ছ’তলা, সাত–তলার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। সুধাংশুর খাবার গরম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডাঃ সেনের রান্নাঘরটা ওর চেনা। বড়ো পার্টিতে সাহায্য করতে আসতে হয়।

দরজায় ঘণ্টা বাজল। কে? সুমিত? দরজা খুলে অবাক। বাসু।

“তুই এখানে কী করছিস?”

হতভম্ব ডাঃ চন্দ্রর পাশ কাটিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বাসুদেব বলল, “আজ আপনাকে রাতে একা থাকতে দেব না আমি আর সুধাংশুদা।”

“তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? বাড়িতে কী বলেছিস?”

“বলেছি স্যার ডিউটি দিয়েছে। রাতে ফিরব না। আপনি থাকতে না দিলে দরজার বাইরে শুয়ে থাকব।”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সুধাংশু বলল, “আপনে যা–ই বলেন…”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “তোদের কী বলি, কে জানে। যা–ই হোক, সাবধানে থাকবি, নিচে যাবি না। আমাকে পুজারীরা বলে দিয়েছে বার বার করে।”

“এখন পুজো হচ্ছে?” বারান্দার দিকে পা বাড়াল বাসু।

“জানি না। কেউ বারান্দায় যাবি না। বারান্দার দরজা–ই খোলা হবে না।” বারান্দার কাচের দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন ডাঃ চন্দ্র। তারপরে খেয়াল হলো, জানতে চাইলেন, “গাড়িটা কোথায় রাখলি? রাস্তায়?”

কপট রাগ দেখিয়ে বাসুদেব বলল, “হ্যাঁ, রাস্তার মাঝখানে রেখে এসেছি, না তো কী? এখানে ভিজিটর কার–পার্ক আছে। আগেও ভেতরেই গাড়ি রেখেছি। আপনি দেখেননি।”

সুধাংশু জিজ্ঞেস করল, “খাবার দেব?”

“দে… তোদের জন্যেও এনেছিস তো?”

খেয়ে ডাঃ চন্দ্র বসার ঘরের সোফায় বসলেন। বললেন, “আমি রাতে এখানেই থাকব। দরকার পড়লে এখানেই গড়িয়ে নেব…”

রাত দশটা নাগাদ মোবাইল বাজল। শিবশম্ভু।

“জানিয়ে রাখি — কঠিন লড়াই। আমরা পেরে উঠছি না। সারা বাড়ি হাড়গোড় আর রক্তের ছোপে ভর্তি।”

“হাড়গোড়? রক্ত…? কেউ আহত হয়েছেন?”

“না না। সব সে–ই আনছে — এ বড়ো ভয়ানক শত্রু রে। সামলান’ কঠিন। ছ’জন সন্ন্যাসী হাবুডুবু খাচ্ছে। আমিও এবারে আসনে বসব। তোকে বলার কথা এই, যে কোনও ভাবেই কাল সকালের আগে কেউ যেন এ ফ্ল্যাটের দরজা না খোলে। সূর্য উঠবে সকাল পাঁচটা দশ মিনিটে — তারও অন্তত আধঘণ্টা পরে — মানে পাঁচটা চল্লিশ। তার আগে হলে ও যদি আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিমান হয়, তাহলে হয়ত দরজা খুললে বাইরেও বেরিয়ে যেতে পারে…” শিবশম্ভুর গলা ছাপিয়ে এক প্রবল হুঙ্কার শোনা গেল। আতঙ্কিত ডাঃ চন্দ্র বললেন, “সাধুবাবা, ও কী?”

গলা তুলে শিবশম্ভু বললেন, “ওরই চিৎকার। এতক্ষণ জিনিসপত্র ছুঁড়ছিল, রক্তে চারিদিক ভাসিয়ে দিচ্ছিল — এবার চেঁচাচ্ছে।”

এক লহমা ফোন কান থেকে সরালেন। এত জোর চিৎকার বাইরে থেকেও ওপর তলায় শুনতে পাওয়া উচিত — কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। ফোনে শিবশম্ভু বললেন, “এই চিৎকারে কথা বলা যাবে না। আমি যাই, যজ্ঞে বসি… মনে রাখিস, কাল সূর্যোদয়ের পরেই যেন কেউ আসে…”

সারা রাত সোফায় ঠায় বসে রইলেন ডাঃ চন্দ্র। নিচে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। সরকারমশাই দুটো চাবির সেট দিয়েছিলেন। তার একটা সন্ন্যাসীদের কাছে, আর অন্যটা ডাঃ চন্দ্রর পকেটে। কিন্তু এখন যাওয়া যাবে না। আগে এই প্রেত বাইরে বেরিয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ দাপটই ওই একটা ঘরের মধ্যেই। ওই ঘর থেকেই কাপালিকরা তাকে বিদায় করার চেষ্টা করছেন। পরের যজ্ঞটা সাবধানতার জন্যই করা হবে।

আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও সারা সন্ধে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। মানতে বাধ্য হলেন, যে কাপালিকরা এসেছিলেন যখন তখন তাঁদের দেখে যতটা খারাপ লেগেছিল, এখন তাঁদের কার্যকলাপ যা–ই হোক, শান্তিপূর্ণই বটে।

ঘরের মধ্যে কী তুফান চলছে, তা কেউ জানতে পারল না।

আকাশ ফর্সা হলো, সাততলার দক্ষিণ–পুবমুখো ফ্ল্যাটের বারান্দার দরজার ওপারে সূর্য উঠল দিগন্তে। বর্ষার মেঘাবৃত আকাশে তাকে দেখা গেল না, কিন্তু ডাঃ চন্দ্রর ফোনে সময় যখন পাঁচটা দশ, পনেরো, কুড়ি করে তিরিশ পেরিয়ে চল্লিশ, তখন সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। সঙ্গে ড্রাইভার বাসু। সুধাংশু ঘুমিয়ে পড়েছে ভোর রাতে। বাসু গাড়ি থেকে রেঞ্চটা নিয়েই এসেছে! বাগিয়ে নিয়ে আগে আগে নামল। ডাঃ চন্দ্র বোঝানোর চেষ্টা করলেন না, যে ওতে কোনও লাভই হবে না। পাঁচতলায় পৌঁছে বললেন, “ব্যাস, অনেক হয়েছে। এবারে তুই এখানে দাঁড়া।” বাসু তর্ক করে কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডাক্তারবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।

ফাইভ ‘বি’–র দরজায় ঘণ্টা দিলেন ডাঃ চন্দ্র। ভেতর থেকে কারও সাড়া পেলেন না। একটু অপেক্ষা করে আবার ঘণ্টা বাজালেন। সাড়া নেই। কিছুক্ষণ পরে তৃতীয়বার ঘণ্টা বাজিয়ে ভাবছেন, এবারে সাড়া না পেলে কি সরাসরি দরজা খুলে ঢুকবেন — চাবি তো রয়েইছে, না দরজা ধাক্কিয়ে নাম ধরে ডাকাডাকি করবেন? এমন সময় বাঁ কাঁধের পেছনে খুট করে শব্দ শুনে বুঝলেন ফাইভ ‘এ’ ফ্ল্যাটের দরজা খুলেছে।

কেউ বেরোল না। আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে বুঝলেন, দরজাটা খুব অল্প খুলে ভেতর থেকে কেউ ওঁকে নজর করছেন। এবারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। পকেট থেকে চাবি বের করলেন।

সাবধানে খুললেন দরজাটা। ওপর তলার মতোই ঢুকেই বসার ঘর, আর সে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া, আরও ভেতরে, খাবার ঘর। সবটাই খালি ছিল, ওখানেই মাটিতে যজ্ঞাগ্নি জ্বালান হয়েছিল।

সমস্তটাই এখন সারা ড্রইং–কাম ডাইনিং রুমে ছত্রখান হয়ে রয়েছে। বালির বেদী বানিয়ে তারপরে ইঁট দিয়ে তার ওপরে আবার বালি দিয়ে হোমের ব্যবস্থা হয়েছিল। সে সব বালি আর ইঁট এখন সারা ঘরে ছড়ানো। ইঁটগুলো টুকরো টুকরো করে ভাঙা। আধপোড়া যজ্ঞের কাঠ সারা বাড়িময়। দেওয়ালে, মেঝেতে কাঠকয়লার হিজিবিজি দাগ। সন্ন্যাসীদের অন্য সব সরঞ্জামও তেমনই ছড়ানো। বোতল খুলে কেউ সারা বাড়িতে ঢেলেছে। আর সেই সঙ্গে এত হাড় আর হাড়ের টুকরো, আর রক্ত, যে মনে হয় বধ্যভূমি। কাঁচা রক্তে মাখামাখি ছাদ, মেঝে আর দেওয়াল। কেউ যেন অযত্নে দেওয়ালে রক্তের চুনকাম করেছে। রক্ত আর মদের তীব্র গন্ধ চারিদিকে, বমি আসার জোগাড়।

পেছনের ফ্ল্যাটের দরজা আরও ফাঁক হচ্ছে। চট করে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন ডাঃ চন্দ্র। তার আগে বাসুকে বললেন, “ওপরে গিয়ে সুধাংশুকে বল সবার জন্য চা বানাতে…”

বললেন বটে সবার জন্য, কিন্তু কেউ কি খেতে পারবেন? রক্তে, বালিতে, হাড়ের টুকরোয় মাখামাখি সাতটা দেহ পড়ে আছে, তার মধ্যে দুটো জেগে আছেন এবং উঠে বসছেনও বটে, আরও চারজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তাঁরা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, কিন্তু জ্ঞান আছে কি? আর সপ্তম জন? যাঁর অর্ধেক শরীর উপুড় হয়ে যজ্ঞের বেদীর ওপর আর অর্ধেক মেঝেতে? মনে হচ্ছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে… তিনি?

ডাঃ চন্দ্র প্রথমে তাঁরই পাশে গেলেন। সাবধানে, রক্ত বাঁচিয়ে কবজি ধরলেন। ক্ষীণ, কিন্তু নাড়ি আছে। বাকিদেরও এক এক করে পরীক্ষা করলেন। কারওর শরীরেই আঘাত নেই। রক্ত সব বাইরে থেকেই লেগেছে। কিন্তু সকলেই অজ্ঞান। এর বেশি আর কিছু খারাপ বুঝলেন না।

উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সন্ন্যাসীকে দেখিয়ে বললেন, “এঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।”

বলেছিলেন শিবশম্ভু ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে, উত্তর দিলেন নগ্ন সন্ন্যাসী বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “নেহি। কোই জরুরত নেহি হ্যায়।” কন্ঠস্বর ক্লান্ত, কিন্তু বাসু যেমন ডাঃ চন্দ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পায়নি, তেমনই ডাঃ চন্দ্রও বৃদ্ধ কাপালিকের চোখের দিকে তাকিয়ে তর্ক করতে পারলেন না।

শিবশম্ভু ঠাকুর বললেন, “আমরা আজ রাতেও থাকব।”

কেন? প্রশ্নটা অব্যক্ত রয়ে গেল। শিবশম্ভু বললেন, “যজ্ঞ বিফল হয়েছে। কিন্তু আমরা সফল হয়েছি — এই আমাদের ধারণা।”

চন্দ্র হাতজোড় করে বললেন, “তাহলে তিনি গেছেন? কী ভাবে?”

“মন্ত্রে,” সংক্ষেপে বললেন বন্দ্যোপাধ্যায়। “কিন্তু গেছে কি না, তা পরীক্ষা করতেই আমরা থাকব।”

শিবশম্ভু বললেন, “খাদ্য, পানীয়, আসব আর সম্বীদা লাগবে। আমাদের কিছুই আর বাকি নেই।”

বাকি সবটা সহজেই জোগাড় করতে পারবেন ডাঃ চন্দ্র। চা নিয়ে সুধাংশু আর বাসু ফিরতে বললেন, “বাসু, যা তো রে বাবা, বেশ খানিকটা ভালো গাঁজা নিয়ে আয় তোর ছেলেটার কাছ থেকে। দামের জন্য আটকায় না যেন।”

বাসু বলল, “আহিরিটোলা গেলে ভালো পাব। অনেকটা দেবে, দামেও মারবে না।”

ডাঃ চন্দ্র–র কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসু বেরিয়ে গেলে এবং সুধাংশুর হতবাক ভাবটা কাটলে সকলে মিলে যতটা পারেন ফ্ল্যাটটা পরিষ্কার করলেন। বাথরুমে, রান্নাঘরে আর শোবার ঘরেও একই রকম উৎপাত হয়েছে। বাথরুমে গিজার আর এক্সস্ট ফ্যান, রান্নাঘরের চিমনি, আর শোবার ঘরের দেওয়াল আলমারি দুমড়ে মুচড়ে ভাঙা হয়েছে। ধোয়ামোছা করতে সারা দিন গেল।

“দেওয়ালে আবার রং করতে হবে,” বললেন শিবশম্ভু।

সারা দিনের পরে আবার রাত কাটাতে হলো সিক্স ‘বি’–তে। রাত দশটা নাগাদ ফোন করে শিবশম্ভু বললেন, “এখনই আসতে হবে না, তবে আমরা নিশ্চিত, যে আর এখানে কোনও অপদেবতার উপস্থিতি নেই। আমরাও ঘুমোতে যাচ্ছি। তুইও ঘুমো। কাল সকালে দেখা হবে।”

~উপসংহার~

“কী হে? অনেক দিন খবর টবর নেই যে?”

মাস তিনেক পরে ডাঃ সেনের ফোন পেলেন ডাঃ চন্দ্র।

“দেবার মতো খবর নেই, দাদা। তাই করিনি।”

“চমৎকার! আমার একটা দেবার মতো খবর আছে। আবার হবে তো দেখা, তিন বছর আগেরটাই শেষ দেখা নয় তো… আগামী মাসের সাতই, রবিবার — আমার বাড়িতে ডিনার — তৈরি থেকো। ডায়রিতে লিখে রাখো।”

উৎফুল্ল হয়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “আসছেন তাহলে?”

ডাঃ সেন বললেন, “আসব না? তিন পেরিয়ে প্রায় চার বছর দেশের মুখ দেখিনি। এবারে গিন্নিকে আর মেয়েকে বলেছি, যেতে না দিলে একদিন দেখবে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে প্লেন ধরেছি।”

“আসুন, আসুন, তা বৌদিও আসছেন তো?”

“আসবে তো বটেই। একা ছাড়বে আমাকে? যদি ফসকে যাই? তার ওপর কানে কম শোনে আজকাল। ‘প্লেন ধরেছি’–কে ‘প্রেম করেছি’ শুনে খুব টেনশন করছে।” হা হা করে হাসলেন ডাঃ সেন। ডাঃ চন্দ্রও গলা মেলালেন। তারপরে বললেন, “বেশ। তাহলে অনেক দিন পরে সিক্স ‘বি’–তে আড্ডা বসবে।”

ডাঃ সেন বললেন, “ও, না। ওটাও বলার ছিল। সিক্স ‘বি’–তে আর না। ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিলাম, বুঝলে? নতুন ঠিকানাটা লিখে নাও…”

“সে কী! এত কাণ্ডর পরে শেষে ‘স্টেশন টাওয়ার্স’ ছাড়লেন? কোথায় বাড়ি কিনেছেন?”

“না না। ‘স্টেশন টাওয়ার্স’ ছাড়ব কেন? ফ্ল্যাটটা ছেড়েছি। নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানা লেখো। ফ্ল্যাট ফাইভ ‘বি’ — স্টেশন টাওয়ার্স।”

হতভম্ব হয়ে ডাঃ চন্দ্র বললেন, “ফ্ল্যাট ফাইভ ‘বি’? আপনি ফাইভ ‘বি’ কিনেছেন?”

ডাঃ সেন বললেন, “কিনিনি। এক্সচেঞ্জ করেছি। তুমি তো বলেছিলে মিঃ সরকার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেবেন। তাই আমি ফোন নম্বর জোগাড় করে জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করবেন? আপনি সিক্স ‘বি’ নিন, আমি ফাইভ। তাহলে আপনি বিক্রিও করতে পারবেন সহজে। দেখলাম রাজি হয়ে গেল।”

এখনও বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি ডাঃ চন্দ্র। বললেন, “আপনি ওই ফ্ল্যাটটাই নিলেন?”

“কেন হে? এখনও তুমি কিন্তু কিন্তু করছ? তুমিই তো বললে, যজ্ঞ করলে, পুজো করলে, কাপালিকরা এসে সব দোষ কাটিয়ে দিয়ে গেছে, তারপরে গোটা শহরকেই মুক্ত করেছে সে কোন কালীমন্দিরে বসে পুজো করে — সে সব কি ভুলে গেলে, না কি সব ঢপ দিয়েছিলে? তা–ই ভাবলাম, ওই বাড়িটাই তো আমারই কেনার কথা ছিল, এখন আবার সে সুযোগ ছাড়ি কেন? যেই সরকারবাবু রাজি হয়েছেন, ওমনি নিয়ে নিয়েছি। এবারে পৌঁছে ওপরের মাল নিচে নিয়ে এসে ওখানেই বাসা বাঁধব। আর তারপরে ওখানেই পার্টি হবে… কেমন? ভেরি গুড, এখন আমি চলি, আরও কয়েকজনকে খবর দিতে হবে — ওই আমাদের সেনগুপ্ত — পালমোনোলজিস্ট, রায় — অর্থো, আর তোমার ক্লাসমেট, ইউরোলজিস্ট জয়ন্ত — কী যেন পদবীটা? ওই, যে ছবি তোলে… যা হোক, ডায়রিতে লিখে রাখো। আগামী মাসের সাতই, রবিবার…

PrevPreviousমেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস (২য় পর্ব) – ১৮৬০ পরবর্তী সময়কাল
Nextমা হওয়া কি মুখের কথা? প্রসব পরবর্তী অবসাদNext
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

Medical Empire Builders

February 8, 2023 No Comments

Early days of Western medicine in India was not much conducive to the British settlers and Indians as well. Though, it is historically accepted that

With Malice Towards None

February 7, 2023 No Comments

The thirty fifth annual conference of Physical Medicine and Rehabilitation at Mumbai was important to me. In this conference my contribution to PMR was appreciated.

রোজনামচা হাবিজাবি ২

February 6, 2023 No Comments

শীত কমে যেতেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের সমস্যাগুলো বেশ বাড়ছে। দশটার সময় হেলতে-দুলতে চেম্বারে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে না। সাড়ে ন’টার আগেই

নাটকের নাম গৌরহরির মৃত্যু 

February 5, 2023 5 Comments

গৌরহরিবাবুর সন্দেহটা কেমন গেঁড়ে বসলো মরে যাবার পর। ছেলেটা বিশ্ববখাটে, গাঁজা দিয়ে ব্রেকফাস্ট শুরু করে আর মদ গিলে ডিনার সারে। ছোটবেলায় পড়াশোনা করার জন্য চাপ

ডক্টরস’ ডায়ালগ ও প্রণতি প্রকাশনীর ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান সফল করে তুলুন।

February 4, 2023 No Comments

সাম্প্রতিক পোস্ট

Medical Empire Builders

Dr. Jayanta Bhattacharya February 8, 2023

With Malice Towards None

Dr. Asish Kumar Kundu February 7, 2023

রোজনামচা হাবিজাবি ২

Dr. Soumyakanti Panda February 6, 2023

নাটকের নাম গৌরহরির মৃত্যু 

Dr. Anirban Jana February 5, 2023

ডক্টরস’ ডায়ালগ ও প্রণতি প্রকাশনীর ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান সফল করে তুলুন।

Doctors' Dialogue February 4, 2023

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

424544
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

[wppb-register]