০৬.১২.২২
বিষয়: মেডিক্যাল কলেজ ও সিনিয়র চিকিৎসক
গতকাল, কলকাতার পিজি হাসপাতালের, ট্রমা সেন্টারে, দুজন জুনিয়র চিকিৎসক রুগী পরিজনের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, সিনিয়র চিকিৎসক ছিলেন না বলেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, সংগঠনগত আমরা তাঁর ওই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করছি। পরপর ঘটনাবলী দেখে, অতীতের মতোই, স্বাস্থ্যের সমস্ত অব্যবস্থার দায়, পরিকল্পিত ভাবে, আবারও চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে বলেই আমরা মনে করি।
২০১৭ সালে, কলকাতার টাউন হলের মিটিংয়ে, কর্পোরেট হাসপাতালের অনিয়ম, বেনিয়ম বন্ধ করার পরিবর্তে, সাধারণ মানুষকে কার্যত প্ররোচিত করা হয়েছিল চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। তার পরপরই গোটা স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দখল চলে যায় দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণে। চূড়ান্ত নৈরাজ্য নেমে আসে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। চিকিৎসকের গায়ে মানুষের বিষ্ঠা মাখানো, জুনিয়র ডাক্তার পরিবাহর ভয়ংকর নিগ্রহ এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে আমাদের মনে।
সম্প্রতি রেফার করা রুগী মারা গেলে তার দায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককেই নিতে হবে বলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করায় চিকিৎসক সমাজ তীব্র আতঙ্কে আছে। আমরা জানি ব্লক থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত হাসপাতাল গুলোর নানা স্তর বিন্যাস আছে। সব স্তরে, সব রোগের চিকিৎসা যেমন সম্ভব নয় এবং হওয়ার কথাও নয়, তেমনই স্তর অনুযায়ী সব হাসপাতালে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী নেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধপত্রের সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন নয়। এমনকি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গুলোতেও উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সেখানেও, এতদিন পরেও, কার্যত কিছু স্পেশালিটি সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হন রুগী রেফার করতে। কিন্তু তার দায় চিকিৎসকদের নিতে হবে কেন? অব্যবস্থার বন্দুকের নল সব সময় চিকিৎসকদের দিকে ঘুরিয়ে দিলে তারাই বা কাজ করবেন কিভাবে? মানুষকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে তার দায় কে নেবেন?
গতকাল কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে, রাজ্যের শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষ হাসপাতাল পিজিতে, আবারও চিকিৎসক নিগ্রহ ঘটলো। সুরক্ষা, নিরাপত্তা যাদের দেওয়ার কথা, তাদের দায় আবারও চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানো হলো। সিনিয়র চিকিৎসকরা রাত্রে থাকেননা বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, আমরা তার তীব্র বিরোধিতা করছি। আবারও ভিন্নপথে মানুষকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করছি। আমরা জানি সিনিয়র চিকিৎসকদের নানা স্তর আছে। “আরএমও”, “এসআর” থেকে শুরু করে “প্রোফেসর” পর্যন্ত। আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, যে সমস্ত বিভাগ জরুরি পরিষেবা দেয়, সেই সমস্ত বিভাগে,কোনো না কোনো স্তরের সিনিয়র চিকিৎসক ২৪ x ৭ অবশ্যই হাসপাতালে থাকেন। মেডিক্যাল কলেজে গুলোতে সিনিয়র চিকিৎসকরা যেমন আউটডোর করেন, অপারেশন করেন, ইনডোরে রুগী দেখেন তেমনই তারা ছাত্র/পিজিটি পড়ান, পিজিটি ডাক্তারদের গবেষণাও তাদের দেখতে হয়। মেডিক্যাল কলেজ গুলোতে প্রফেসররা সাধারণ ভাবে অনকল থাকেন। তবে প্রয়োজনে তাদেরও যে কোনো সময় আসতে হয়।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে আমাদের প্রশ্ন…
১. স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সমস্ত অবস্থার দায় কেন বারবার চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানো হবে?
অভিযোগ করার আগে স্বাস্থ্য দপ্তর কি খোঁজ নিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজ গুলোর, সব বিভাগে প্রয়োজনীয় সিনিয়র চিকিৎসক আছেন কিনা?
২. কেন সর্ব স্তরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো থাকবে না? কেন চিকিৎসা সরঞ্জাম,ওষুধ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পাওয়া যাবে না? কেন সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া যাবে না?
৩. চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, নিরাপত্তা কেন সুনিশ্চিত হবে না? ভয় আতঙ্কের পরিবেশে দিনের পর দিন তারা কাজ করবেন কি করে?
৪. চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটলে, সব ক্ষেত্রে কেন প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেবে না? কেন দুস্কৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরের দিন জামিন পেয়ে যাবে? শক্তিশালী “২০০৯ মেডিকেয়ার” আইন থাকলেও কেন তার প্রয়োগ হবে না?
আমরা প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছি মানুষকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা থেকে বিরত না হলে, চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা, সুরক্ষা সুনিশ্চিত না হলে, চিকিৎসক সমাজের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অচিরেই দেখতে পাবেন এবং তার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে।