? ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত না থাকলে কী করা যায়?
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, সুস্থ মানুষের নৈতিক কর্তব্য হলো নিয়মিত ব্যবধানে রক্তদান। কারণ রক্ত কৃত্রিমভাবে তৈরী করার ব্যবসায়িক পদ্ধতি এখনও আসেনি। ফলে রক্তদান না করলে রক্ত কোনো মতেই পাওয়া যাবে না; রক্তদান যত কম পরিমাণে হবে রক্তের দাম তত বেশী হবে এবং এর উল্টোটাও সত্যি। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই রক্তদান করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে পরে বিশদে আলোচনা হবে।
কিন্তু এর সাথেই জানিয়ে রাখি, রক্ত বা রক্তদাতা জোগাড় করার দায়িত্ব ব্লাড ব্যাঙ্কের। কোনো ব্লাড ব্যাঙ্ক আপনাকে এই নিয়ে কোনোরকম জোরাজুরি করলে সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি। ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সরবরাহ বজায় রাখার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবে সেই ব্লাড ব্যাঙ্কের। রোগীর আত্মীয়দের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের চাপ দিয়ে রক্তদান করানো কিন্তু Donor motivation নয়, বরং তাদের কাউকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার পরে তিনি রক্তদানের উপযোগিতা বুঝে স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে সেটি Donor motivation হিসেবে গণ্য করা যায়। এছাড়া এই ভাবে চাপ দিয়ে রক্তদান করানো হলে সেটা রক্তসুরক্ষার নীতি (Policy of Blood safety)-র সাথে আপস করা হবে। তাছাড়া, এইভাবে জোরাজুরি করে রক্তদান করানো হলে সেটা ব্লাড ব্যাঙ্কের সুনাম খারাপ করবে এবং তার সাথে এই গোটা blood donation movement-এর জন্য এটা ক্ষতিকারক।
আরো জানিয়ে রাখি, আপনার হয়ে কেউ রক্তদান করলেও রক্ত কিনতে আপনার যা খরচ হবে, আপনার হয়ে কেউ রক্তদান না করলেও রক্ত কিনতে আপনার তাই খরচ হবে। কারণ NBTC-র নির্দেশিকায় এমন কোনো নিয়ম বানানো নেই যেখানে রোগীর হয়ে কেউ রক্তদান করলে তার জন্য রক্তের দামের উপর আলাদাভাবে ছাড় দিতেই হবে (এই বিষয়ে পরে বিশদে আলোচনা করা হবে)।
তবে, বাস্তবে যদি নিকটস্থ ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে সেই সময়ে রক্ত না থাকে বা কম থাকে তাহলে রক্তের অভাবে নিশ্চয়ই আপনার রোগীকে মরতে দেবেন না। সেক্ষেত্রে রক্তদাতা এভাবে খুঁজতে পারেন।
১) প্রথমেই একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, রিকুইজিশনে লেখা সমস্ত রক্ত সব সময়েই যে একসাথে রোগীকে দেওয়া হয় এমনটা নয়। দুই ইউনিট রক্ত লাগলে আজকে এক ইউনিট এবং পরে প্রয়োজন হলে আরেক ইউনিট রক্ত সঞ্চালন করা হলো, এমনটা হতেই পারে। তাই এইটা জেনে নিয়ে তবেই রক্তের জন্য খোঁজ করা শুরু করবেন। মাথায় রাখা উচিৎ যে রক্ত একটি ওষুধের মত, ওষুধ যেমন নির্দিষ্ট মাত্রার কম বা বেশী পরিমাণে গ্রহণ করলে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে, তেমনই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত রক্ত বা তার উপাদান নিলেও সমস্যা হতে পারে।
এই প্রসঙ্গেই আরেকটা জিনিস জানিয়ে রাখা যায় যে, রক্ত বা তার উপাদানগুলি ব্লাড ব্যাঙ্কে নির্দিষ্ট কিছু অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। ফলে ব্লাড ব্যাঙ্কের সেই সংরক্ষিত অবস্থা থেকে রক্ত বা তার উপাদানগুলি একবার বেরিয়ে গিয়ে সাধারণ অবস্থায় চলে এলে, সেই রক্ত সঞ্চালনের কাজে না লাগলে রক্তসুরক্ষার নিয়ম অনুযায়ী সেই রক্ত বা তার উপাদানের থলেটি সমেত নষ্ট করে দিতে হয়। অর্থাৎ, রিকুইজিশনে চার ইউনিট রক্ত লেখা থাকায় আপনি চার ইউনিট রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে এসে চিকিৎসাকেন্দ্রে জমা করলেন, কিন্তু পরে দেখা গেলো যে মাত্র এক ইউনিট রক্তই কাজে লাগলো, তখন ঐ তিন ইউনিট রক্ত কিন্তু নষ্ট করে দিতে হবে। আর এইভাবে রক্ত নষ্ট করা একদিকে সম্পদের অপচয় কারণ দান করা রক্ত থেকে এই রক্ত বিভিন্ন খরচসাপেক্ষ পদ্ধতি এবং পরীক্ষার মাধ্যমে বানানো হয়; অন্যদিকে এইভাবে রক্ত নষ্ট করলে ভবিষ্যতে প্রয়োজনে হলে তখন রক্ত না থাকায় অন্য কোনো রোগীর সমস্যা হতেই পারে।
কাজেই এই ক্ষেত্রে যেটি করতে পারেন সেটি হলো, রিকুইজিশন ও নমুনা দিয়ে আপনার প্রয়োজনীর রক্তের কথা ব্লাড ব্যাঙ্কে জানিয়ে রাখলেন এবং ব্লাড ব্যাঙ্ক পরীক্ষা করে আপনার জন্য প্রয়োজনীয় রক্তের আয়োজন করে রাখলো। এরপরে বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী যখন যত ইউনিট (বা প্রচলিত ভাষায় যত Bag) রক্ত লাগলো তখন তত ইউনিট রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে জমা করলেন। এই ব্যবস্থাটি সেই ক্ষেত্রে করা সহজ যেখানে চিকিৎসাকেন্দ্রের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে অথবা ব্লাড ব্যাঙ্কটি চিকিৎসাকেন্দ্রের খুবই কাছে।
২) ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের অভাব থাকলে, নিজের আত্মীয়দের বা চেনা পরিচিতদের ভেতর কোনো রক্তদাতা খুঁজতে পারেন।
এই ক্ষেত্রে, একটি জিনিস মাথায় রাখবেন যে Transfusion-associated graft-versus-host disease (TA-GvHD) নামক রোগ সৃষ্টির ভয় থাকায় রোগীকে তার অত্যন্ত নিকটাত্মীয়ের (সন্তান, বাবা, মা, ভাই/বোন ইত্যাদি) রক্ত না দেওয়াই ভালো। তবে যদি অবস্থা এই রকম থাকে যে ব্লাড ব্যাঙ্ক তার Buffer stock থেকে এক ইউনিট রক্ত দিচ্ছে যেখানে পরের কোনো রোগীর জন্য আপনার তরফে কোনো আত্মীয় এক ইউনিট রক্ত দান করছেন, সেখানে আত্মীয়ের রক্ত রোগীর দেহে সঞ্চালন না হওয়ায় ঐ রোগ সৃষ্টির ভয় থাকে না। এই বিষয়টা ব্লাড ব্যাঙ্কে জেনে নেওয়া উচিৎ।
৩) এইপ্রসঙ্গেইজানিয়েরাখি, কিছু ক্ষেত্রে ব্লাড ব্যাঙ্কের কাছে হয়ত আপনার রোগীকে যে গ্রুপের রক্ত দিতে হবে সেটি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও অন্য গ্রুপের রক্ত কম আছে। সেই ক্ষেত্রে ব্লাড ব্যাঙ্ক আপনাকে সমান ইউনিট কিন্তু যে কোনো গ্রুপের রক্তদানের অনুরোধ করে থাকে। এইক্ষেত্রেও আপনি অনুরোধ রক্ষা করতেই পারেন।
তবে আবার জানিয়ে রাখি, আপনি রক্তদান করতে না চাইলে কোনোরকম জোর করে রক্ত দিতে বাধ্য করা বেআইনি। এবং উপযুক্ত রক্ত বা তার উপাদান থাকার পরেও সেটা রোগীর আত্মীয়দের না দিলে এবং এর ফলে হওয়া রক্তের অভাবে রোগীর কোনো ক্ষতি হলে তার দায় কিন্তু ব্লাড ব্যাঙ্কের উপরেই আসবে।
কিন্তু এর সাথেই এটাও জানিয়ে রাখি যে, যাতে এই অবস্থার সৃষ্টি না হয় তার জন্য নিয়মিত ব্যবধানে নিয়ম মেনে রক্তদান করা দরকার।
৪) হতেই পারে যে সেই সময়ে আপনার পরিচিতদের মধ্যে সবাই চিকিৎসাশাস্ত্রের মাপকাঠিতে রক্তদানে অক্ষম। তখন Social Media যেমন – Facebook, Twitter, Whatsapp, Telegram বিভিন্ন মাধ্যমে রক্তদাতার জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে আপনার বার্তায় বা লেখায় রিকুইজিশনের ছবি এবং রক্তদাতা চিকিৎসাকেন্দ্রে বা ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তদান করতে গেলে তাকে সাহায্য করতে পারবেন এমন কোনো আত্মীয়ের নাম ও ফোন নাম্বার অবশ্যই জানিয়ে রাখবেন। অনেকেই খেয়াল করেন না তাই লিখতে বাধ্য হচ্ছি, এই ক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন যে যিনি রক্তদান করতে আসছেন তিনি কিন্তু একজন অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত মানুষের ডাকে নিজের কাজের ফাঁকে সময় বার করে এবং রক্তদানকে মানবিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে রক্তদান করতে আসছেন, কাজেই তার সাথে ব্যবহারটি ভদ্রজনোচিত হওয়া আবশ্যিক।
৫) রিকুইজিশন না থাকলে কী করবেন?
কিছু ক্ষেত্রে রিকুইজিশন সেই সময়ে পাওয়া যায় না। ধরুন, রোগীর অস্ত্রোপচার হবে কিছুদিন পরে এবং সেই সময়ে তিনি চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি থাকবেন না (অনেক বেসরকারী চিকিৎসাকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায় কারণ সেখানে থাকার দৈনন্দিন খরচ যথেষ্ট)। ফলে সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের পক্ষে সেই রোগীর জন্য রিকুইজিশন লিখতে গেলে বেশ কিছু তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে না, কাজেই এক্ষেত্রে তারা রিকুইজিশন দিতে সক্ষম হন না। আর রিকুইজিশন দিতে না পারায় নমুনা সংগ্রহ করার প্রশ্নই থাকে না।
তবে, Planned Surgery-র ক্ষেত্রে treating Consultant-কে একটা prescription-এ লিখে দেবেন যে কবে, কত ইউনিট, কোন ব্লাডগ্রুপের কোন উপাদান লাগবে, একসাথে এক দিনেই লাগবে অথবা আলাদা দিনে লাগবে (অনেক ক্ষেত্রে যেমন সার্জারির আগেই আরবিসি বা প্লেটলেটস সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়)। আর রোগীর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে রাখতে হবে, নাহলে প্রথমে মৌখিকভাবে জানা গ্রুপ এবং পরে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গ্রুপ আলাদা হলে সেটা অহেতুক সময় নষ্ট করে রোগীর বিপদ বাড়াবে।
এক্ষেত্রে এই তথ্যগুলো রক্তদানের অনুরোধ জানানো ঐ বার্তায় লাগবেঃ
১) আগের মতই, রক্তদাতা চিকিৎসাকেন্দ্রে বা ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তদান করতে গেলে তাকে সাহায্য করতে পারবেন এমন কোনো আত্মীয়ের নাম ও ফোন নাম্বার অবশ্যই জানিয়ে রাখবেন;
২) রোগীর নাম;
৩) রক্ত সঞ্চালনের কারণ;,
৪) কত তারিখের মধ্যে রক্ত লাগবে,
৫) কোথায় কোন ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তদান করতে হবে (কারণ সবসময়ে রোগী যেখানে ভর্তি আছেন সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক নাও থাকতে পারে) ;
৬) রক্তের গ্রুপ,
৭) রক্তের কোন উপাদানটি লাগবে অথবা SDP বা Cryo-precipitate- এর মতো কোনো বিশেষ উপাদান লাগবে কি না;
৮) কত ইউনিট রক্ত লাগবে।
এই প্রসঙ্গেই জানাই, একজন রক্তদাতা রক্তদান করলে সেখান থেকে component separation এর মাধ্যমে এই উপাদানগুলি পাওয়া সম্ভব (এই নিয়ে পরে বিশদে আলোচনা করা হবে) –
১) এক ইউনিট Concentrated Red Blood Cell (CRBC),
২) এক ইউনিট Plasma (FFP),
৩) এক ইউনিট Platelets.
কাজেই কোনো রোগীর জন্য যদি এক ইউনিট CRBC এবং এক ইউনিট Plasma লাগে, তাহলে সেই ক্ষেত্রে দুই জনের জায়গায় একজন রক্তদাতা রক্তদান করলেই প্রয়োজন মিটে যায়।
এছাড়া, শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের জন্য যদি Pediatric Unit রক্তের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে ৬০ মিলিলিটার রক্ত লাগে, যেখানে রক্তের ব্যাগে ৩৫০ বা ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত ধরে। অর্থাৎ সাধারণভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ যে পরিমাণ রক্তদান করেন তার থেকে পাঁচটি থেকে সাতটি পেডিয়াট্রিক ইউনিট রক্ত পাওয়া যায়।
কাজেই কোনো শিশুর ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন হলে এই বিষয়েও সচেতন থাকা দরকার।