এতক্ষণ রক্ত নেওয়া নিয়ে আলোচনা করা হলো। স্বাভাবিকভাবেই এরপরে রক্তদান নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন, কারণ রক্ত দান ছাড়া অন্য উপায়ে রক্ত পাওয়া এখনও অসম্ভব। এটিএম মেশিনে যদি টাকাই না ভরা হয় অথবা ব্যাঙ্কেই যদি টাকা জমা না পড়ে, তাহলে কার্ড আর পিন থাকলেও আপনার পক্ষে যেমন টাকা তোলা সম্ভব নয়; তেমনি যদি ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত জমা না পড়ে এবং জমা পড়লেও বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেটি ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসতে পারা অসম্ভব হয়ে গেলে সেই ক্ষেত্রে রিকুইজিশন এবং নমুনা নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্কে গেলেও আপনার পক্ষে রক্ত পাওয়া অসম্ভব।
? রক্তদান কখন করতে পারবেন আর কখন করতে পারবেন না, সেই বিষয়ে ভারত সরকারের Drug Act – এ জানানো আছে, সেটিথেকেই বঙ্গানুবাদ করে এখানে দেওয়া হলো। এছাড়া এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে রক্তদানের আগে ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে পারেন।
ভারত সরকারের Drug and Cosmetic Act অনুযায়ী –
A] রক্তদানের সময় একজন রক্তদাতার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের সাথে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো আবশ্যক –
১) প্রথমবার রক্ত দিতে গেলে বয়স আঠারো থেকে ষাট বছরের মধ্যে হতে হবে। ষাট বছরের আগে রক্ত দেওয়ার অভ্যাস থাকলে পঁয়ষট্টি বছর অবধি রক্তদান সম্ভব।
২) তিনশো পঞ্চাশ মিলিলিটার আয়তনের ব্যাগের জন্য রক্ত দিলে দেহের ওজন কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ কেজি হতে হবে।
চারশো পঞ্চাশ মিলিলিটার আয়তনের ব্যাগের জন্য রক্ত দিলে দেহের ওজন কমপক্ষে পঞ্চান্ন কেজি হতে হবে।
৩) রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে কমপক্ষে বারো দশমিক পাঁচ গ্রাম হতে হবে (থ্যালসেমিয়ার বাহক বা Thalassemia Minor হলেও রক্তদান সম্ভব)।
৪) রক্তের চাপ (প্রতি মিলিমিটার পারদস্তম্ভের মাপে)
ক) ডায়াস্টোলিক – ষাট থেকে নব্বই
খ) সিস্টোলিক – একশত থেকে একশত চল্লিশ।
রক্তদানের আগে যদি বিগত আঠাশ দিন একই মাত্রার ওষুধ খেয়েও এই রক্ত চাপ বজায় থাকে তাহলে রক্তদান করা যেতে পারে।
৫) হৃদস্পন্দনের গতি – স্বাভাবিক এবং প্রতি মিনিটে ষাট থেকে একশত বারের মধ্যে হতে হবে।
৬) দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক (সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা আটানব্বই দশমিক চার ডিগ্রি ফারেনহাইট) হতে হবে।
৮) শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে হবে।
৯) শরীরের যেখান থেকে রক্ত নেওয়া হচ্ছে সেই অংশে ত্বকে কোনো রোগ থাকলে হবে না।
খেয়াল রাখবেন যে, ভিন্নভাবে সক্ষম (Differently abled) ব্যক্তিরাও রক্তদান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মতো তাঁকেও পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর মত (Consent) নিতে হবে।
এছাড়া অনাহারে বা ভরাপেটে রক্ত না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। একটি পরিপূর্ণ আহারের সাথে রক্তদানের সময়ে চার ঘন্টার ফারাক থাকা উচিত।
B] যেসব কারণে আপনি একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে জন্য রক্ত দিতে পারবেন না সেগুলো হলো –
১) মাসিক ঋতুস্রাব চললে।
২) সর্দি/ ঠান্ডা লাগা/ কঞ্জাংটিভাইটিস হলে– সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।
৩) মদ্যপান করলে এমনকি নেশার লক্ষণ দেখা গেলে– সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।
৪) মিজলস/ মাম্পস/ চিকেনপক্স/ ডায়েরিয়া হলে– সুস্থ হওয়ার পরে চোদ্দ দিন অবধি।
৫) মূত্রথলির সংক্রমণ হলে– সুস্থ হওয়ার পরে চোদ্দ দিন অবধি।
৬) অ্যান্টিবায়োটিক নিলে– সুস্থ হওয়ার পরে চোদ্দ দিন অবধি।
৭) টিকা নিলে–
ক) মৃত জীবাণু বা জীবাণুর বিষ থেকে তৈরি যেমন টাইফয়েড, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, প্লেগ– টিকা নেওয়ার পর চোদ্দ দিন অবধি।
খ) জীবিত কিন্তু দুর্বল জীবাণু থেকে তৈরি যেমন মিজলস, মাম্পস, চিকেনপক্স, পীতজ্বর, জাপানি ইনসেফেলাইটিস, টাইফয়েড, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস এ হলে– টিকা নেওয়ার পর আঠাশ দিন।
(প্রসঙ্গত, একই রোগের দুই ধরনের টিকাই থাকতে পারে।)
৮) অ্যান্টি-টিটেনাস, অ্যান্টি-ডিপথেরিয়া, অ্যান্টি-ভেনাম (সাপের বিষের প্রতিষেধক) সিরাম নিলে– নেওয়ার পর আঠাশ দিন অবধি।
৯) তেজস্ক্রিয়তা-রোধী ওষুধ নিলে– ওষুধ বন্ধের পরে ছাপ্পান্ন দিন অবধি।
১০) ম্যালেরিয়া হলে– সুস্থ হওয়ার পরে তিন মাস অবধি।
১১) ক) আগে এক ইউনিট Whole Blood দিলে পরবর্তী রক্তদান –
1) ছেলেদের ক্ষেত্রে নব্বই দিনের আগে দেওয়া যাবে না,
2) মেয়েদের ক্ষেত্রে একশত কুড়ি দিনের আগে দেওয়া যাবে না।
খ) আগে একবার Plateletpheresis বা Plasmapheresis এর মাধ্যমে যথাক্রমে Platelets বা Plasma দান করলে পরবর্তী Plateletpheresis বা Plasmapheresis–
1) আটচল্লিশ ঘন্টার আগে করা যাবে না,
2) সাতদিনে দুইবারের বেশী হবে না, এবং
3) বছরে চব্বিশবারের বেশী হবে না।
গ) আগে এক ইউনিট Whole Blood দিলে পরবর্তী Plateletpheresis বা Plasmapheresis– আঠাশ দিনের আগে হবে না।
ঘ) আগে Plateletpheresis হলে পরবর্তী Whole Blood donation– আঠাশ দিনের আগে হবে না।
Plateletpheresis/ Plasmapheresis এর সময়ে RBC-গুলি রক্তদাতার শরীরে পুনঃসঞ্চালন না হলে — নব্বই দিনের আগে হবে না।
১২) গর্ভাবস্থায়
ক) গর্ভপাত হলে ছয় মাস অবধি,
খ) প্রসব হলে বারো মাস অবধি।
গ) এছাড়া শিশুর স্তন্যপান যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত রক্তদান বন্ধ রাখতে হবে।
১৩) ডেঙ্গু হলে সুস্থ হওয়ার পরে ছয় মাস অবধি।
১৪) সার্জারি হলে
ক) Minor Surgery (যেমন Root Canal Treatment, দাঁত তোলা)– সুস্থ হওয়ার পরে ছয় মাস অবধি।
খ) Major Surgery (রোগীকে অজ্ঞান করা হয়েছে / রোগীর দেহ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছে এমন)– সুস্থ হওয়ার পরে বারো মাস অবধি।
গ) রক্ত বা তার উপাদান, নিজের অথবা স্বামী/ স্ত্রী (যৌনসঙ্গী)-এর দেহে সঞ্চালন করলে– বারো মাস অবধি।
১৫) হেপাটাইটিস এ এবং ই, নিজের অথবা স্বামী / স্ত্রী (যৌনসঙ্গী)-র হলে– সুস্থ হওয়ার পরে সুস্থ হওয়ার পরে বারো মাস অবধি।
১৬) নিজের অথবা স্বামী / স্ত্রী (যৌনসঙ্গী) এর দেহে উল্কি বা অ্যাকুপাঞ্চার করলে–বারো মাস অবধি।
১৭) টাইফয়েড হলে– সুস্থ হওয়ার পরে বারো মাস অবধি।
১৮) অ্যান্টি – রেবিস, হেপাটাইটিস বি ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা যেকোনো ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিলে– টিকা নেওয়ার পরে এক বছর অবধি।
১৯) গ্যাসট্রোইনটেসটিনাল (GI) এন্ডোস্কোপি করালে– বারো মাস অবধি।
২০) যক্ষ্মা হলে = সুস্থ হওয়ার পরে দুই বছর অবধি।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, Nonsteroidal anti-inflammatory drugs যেমন Ibuprofen, Aspirin ইত্যাদি জাতীয় ঔষধ নিলে সেই রক্ত থেকে অনুচক্রিকা নেওয়া যায় না, তবে তিন দিন ওষুধ সেবন বন্ধ রেখে (অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী) রক্তদান করলে সেই রক্ত থেকেও অনুচক্রিকা আলাদা করা নেওয়া যায়।
C] নিম্নলিখিত রোগের একটিও থাকলে কখনোই রক্তদান করা যাবে না –
১) ক্যান্সার,
২) হৃদরোগ(Cardiovascular Diseases),
৩) কুষ্ঠ,
৪) শ্বাসসম্বন্ধীয় প্রবল রোগে (Acute Respiratory Diseases),
৫) হাঁপানির টান থাকলে/ রোগের উপশমের জন্য Steroidal ওষুধ গ্রহণ,
৬) খিঁচুনি ও মৃগী,
৭) বৃক্কের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (Chronic Diseases of Kidney),
৮) ক্রনিক নেফ্রাইটিস,
৯) যকৃতের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (Chronic Diseases of Liver),
১০) স্কিজোফ্রেনিয়া,
১১) ডায়াবেটিসের ফলে ইনসুলিন গ্রহণ,
১২) রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যা ও অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের প্রবণতা,
১৩) পলিসাইথিমিয়া ভেরা,
১৪) বারবার রক্তপাতের লক্ষণ সহ পাকস্থলীর আলসার,
১৫) হেপাটাইটিস বি ও সি বা অজানা হেপাটাইটিস,
১৬) সিফিলিস,
১৭) গনোরিয়া,
১৮) এইডস,
১৯) হাইপার বা হাইপো-থাইরয়েড,
২০) কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন,
২১) স্টেম সেল দিয়ে চিকিৎসা,
২২) ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য নিলে।
এইসবের পরেও কয়েকটি কথা অতি অবশ্যই মনে রাখবেন –
১) উপরে উল্লেখিত নয় এমন কোনো রোগে ভুগলে বা কোনো ওষুধ নিলে, আপনি যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন তার কাছেই জেনে নিতে পারেন যে আপনি রক্তদান করতে পারবেন কি না।
২) রক্তদানের আগে ও পরে কোনোরকম অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলে তৎক্ষণাৎ সেখানে থাকা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে সেটি জানাবেন।
৩) রক্তদানের ক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখা উচিৎ যাতে রক্তদাতার রক্ত কোনো রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করে। ফলে নিজের অসুস্থতা বা রোগ গোপন করে রক্ত দিলে, সেই রক্ত রোগীর অবস্থা ভালো করার জায়গায় উল্টে খারাপ করতে পারে, এমনকি তার প্রাণসংশয়ও ঘটতে পারে।
কোনো কারণে রক্তদানে অসমর্থ হলে আপনি নিজে রক্তদান না করে যদি অপর কোনো ব্যক্তিকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে সেক্ষেত্রেও সেটি সমাজের এবং রক্তগ্রহীতার উপকার করবে।
এই রচনায় সাহায্য করেছেন ডা ঋতম চক্রবর্তী।
(চলবে)