এত বছর পর গতমাসে ফোনে শিবুদার গলা শুনে অবাকই হয়েছিলাম! যোগাযোগ নেই প্রায় সিকি শতক!
সে বছর মাঝ শ্রাবণে ভাসতে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছেছি মহানগরের স্নায়ু কেন্দ্রে। ঠাঁই নাড়া হবার পর সেই আমার নতুন ঠিকানা!
সেখানে হাত বাড়ালেই প্রসিদ্ধ স্মৃতি-সৌধ, গির্জাঘর, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, কৃষ্টি-কেন্দ্র, আর অজস্র-ধারা-বৃষ্টির মতন মানুষ!
শিকড় সমেত উপড়ে এনে আমাকে বলা হয়েছে, ডালপালা ছড়াও হে, এই তোমার নতুন আকাশ!
এই শহরে আমার প্রথম চেম্বারটি ছিল দেড়তলার এক চিলতে ঘরে, নিচে একদিকে একটি ক্যাটারিংয়ের অফিস ঘর অন্যদিকে একটি ওষুধের দোকান।
শিবুদা ছিলেন সেই দোকানের সিনিয়র মোস্ট কর্মচারী! রিটায়ারমেন্টের বয়েস পেরিয়ে গেছেন তখনই, তবুও ওঁরা পুরোনো মানুষটিকে অবসর নিতে দেন নি।
বাচ্চা ডাক্তারটির প্রতি অদ্ভুত একটা সম্ভ্রম মেশানো স্নেহ ছিল মানুষটির।
আমার প্রবল আপত্তি আর অস্বস্তি উপেক্ষা করেই আমাকে অকারণে আপনি সম্মোধন করে কথা বলতেন শিবুদা।
বেশ মনে আছে নব্বইয়ের মাঝামাঝি শিবুদার কোমর ভাঙে। গাড়ির ধাক্কায়। তার পরেও, একটু সেরে ওঠার পর আবার ফিরে এসেছিলেন কাজে।
আর তার বছর দুই পর শিবুদা ওঁর দাদা নারায়ণবাবুকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন!
ভদ্র, শিক্ষিত, সুপুরুষ নারায়ণ বাবুর হাতের আঙুলের নখের নিচে যেটা হয়েছিল সেটা কালান্তক স্কিন ক্যান্সার মেলানোমা!
তিরিশ বছরে সামান্য যে গুটিকয় মেলানোমা দেখেছি, তারই একটি! ডায়াগনোসিস হবার পর, মাত্র ছ’ মাস বেচেঁছিলেন ভদ্রলোক!
শিবুদার সঙ্গে সেই শেষ দেখা!
কিছু সমস্যায় ভুগছেন, ফোনে বার দুই চেষ্টা করলাম চিকিৎসা করার! গলা শুনে বুঝলাম, ওঁর অসুখ বেশির ভাগটাই মনে! একাকীত্বের অসহায়তায় ভুগছেন মানুষটা, একটা অজানা আতঙ্কে ডুবে যাচ্ছেন!
হোম কলে যেতে পারি না আজ বহু বছর! সময় পাই না! শিবুদা ডাকেন নি, তবু ঠিক করলাম যাব, গিয়ে দেখে আসবো, কেমন আছেন! তার একটা কারণ যদি এতো বছর পর মানুষটাকে দেখার লোভ হয়, অন্যটা হলো, আনন্দ পালিত আমার চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার পথে সামান্যই ডিট্যুওর!
খুঁজে খুঁজে পৌঁছেও গেলাম! সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে উঠতে ভাবছিলাম অনেক পুরোনো কথা!
ওয়াকারে ভর দিয়ে দুচোখ ভরা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ মানুষটা। দেখে চিনতে কষ্ট হলো না! শীর্ণ মানুষটি শীর্ণতর হয়েছেন, এক মুখ দাড়ি গোঁফ!
প্রথমে আবেগের অতিশয্যে কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলেন না। তারপর আমরা দুজনে ডুবে গেলাম স্মৃতিচারণে।
কথায় কথায় ফিসফিস করে, যেন নিজেও শুনতে না পান, এই ভাবে জানতে চাইলেন, এটা স্কিন ক্যানসার কি না! এতক্ষণে আমার কাছে পরিষ্কার হলো, ফোনে শোনা কণ্ঠস্বরের বিপন্নতার কারণ!
বোঝালাম, নিশ্চিত করলাম।
মুখে হাসি ফুটলো বৃদ্ধের।
পাশের ঘর থেকে চা আর প্লেটে সাজানো কেক নিয়ে যিনি এলেন, তিনি ন্যূব্জদেহ, তাঁর বয়েস একানব্বই!
তিনি শিবুদার দিদি প্রতিমা মিত্র!
সাতাশি বছরের ভাইকে তিনি প্রাণ দিয়ে আগলে রাখেন, দেখভাল করেন। -ডাক্তারবাবু, শিবু বড্ড নেগেটিভ চিন্তা করে! ওকে বলুন তো একটু আনন্দে থাকতে! এত চিন্তা করে হবেটা কি!
ডাক্তারি করতে যাই নি, একটু দেখতে গিয়েছিলাম ওঁদের।
ফেরার সময় গাড়িতে ওঠার আগে ওপরে তাকিয়ে দেখি ওঁদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন সাতাশির শ্যামাপ্রসাদ আর একানব্বইয়ের প্রতিমা মিত্র!
অন্ধকার আকাশের প্রেক্ষাপটে বাড়িটায় শুধু ওঁদের ফ্ল্যাটেই আলো জ্বলছিল, অন্ধকার সমুদ্রে আলোর দ্বীপের মত।
শীতের সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলাম মনভরা উষ্ণতা নিয়ে।
অপূর্ব অভিজ্ঞতা