এক রাজস্থানি ব্যবসায়ী ছিলো। গাড়ির ল্যুব্রিক্যান্টের ব্যবসা করতো। তার একটা ছোটো কারখানা ছিলো। সাইকেল, মটোর সাইকেল , গাড়ির গ্রিজ তৈরি হতো। রাজস্থানি বটে কিন্তু জন্ম কর্ম এই বাংলায়।
বোধহয় ভুল হলো। এই রকম ছোটো ছোটো কারখানা সব প্রদেশের সব শহরেই ছিলো। অনামা কোম্পানি। ঘুরে ঘুরে দোকানে সাপ্লাই করতো। এরকম মানুষ গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে ব্যবসা করতো।
বিশ্বায়ন হোলো। মোবিল, ভলভোলিন, লুব্রিপ্লেট এইসব বিরাট কোম্পানি ভারতে এসে ঢুকলো। এদের শেকড় কিন্তু বিদেশের মাটিতে গাঁথা। এদের বিজ্ঞাপন – সাপ্লাই লাইন অনেক বড়ো। ছোটো ব্যবসায়ীরা হারিয়ে গেল। ছোটো ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন আর অসম্ভব রকম ভালো সাপ্লাই লাইনের সঙ্গে পারলো না। যেমন হারিয়ে যাচ্ছে দর্জির দোকানগুলো।
ঠিকই তো একই দামে বা সস্তায় যদি সহজলভ্য জিনিস পাওয়া যায় তাহলে তো এরা কিছুতেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এটাই ক্যাপিটালিজম। এখানে দয়া ধর্মের কোনও স্থান নেই। এবং ক্রেতার জন্য অফুরন্ত পছন্দের সম্ভার থাকবে, সে তার পছন্দসই জিনিসটা খরিদ করবে এটাই বাজারের নিয়ম অথবা পুঁজিবাদের নিয়ম।
কিন্তু যেই মুহূর্তে নিজের প্রস্তুতি ছাড়া বিশ্বায়নের দরজা খুলে দেওয়া হবে তখনই বহুজাতিক কোম্পানি এসে আমাদের ক্ষুদ্র শিল্প শেষ করে দেবে।
চীন যদিও আমাদের পরম শত্রু দেশ তবু সে নিজের শিল্পক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষ লাভ করে প্রথমে বিদেশে সস্তা চীনা মাল বিক্রি আরম্ভ করে। ততদিনে তাদের মানুষ কিন্তু খাদ্যে আর শিল্পে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠেছে। এদিকে আমাদের দেশের ছোট কোম্পানিগুলো ডুবে গেল আবার বড় কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ নিজের নিজের দেশে নিয়ে যেতে থাকলো। ভারত ঋণের ভারে ন্যুব্জ কুব্জ হয়ে পড়লো। আমাদের অসংগঠিত শিল্পরা বাজার ধরতে পারলো না। শ্রমিকদের মাইনে দিতে পারলো না। শেষে অন্যের দোকানের মাসমাইনের কর্মচারী হয়ে মাথা নিচু করে জীবন কাটাতে লাগলো। না আমরা আমাদের কৃষিভিত্তিক দেশে কৃষি একটা সুসংহত বাজার তৈরি করতে পেরেছি – না আমাদের লুপ্তপ্রায় শিল্পক্ষেত্র সেটা পেরেছে। চাষী দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম হচ্ছে। চাষা মানেই কাদামাখা ছিন্ন পিরান ভিন্ন ধুতি অস্থিপঞ্জর সর্বস্ব একটা ছবি ভাসে। অন্য কিছু তো মানাই যায় না।
আমাদের মহাত্মা গান্ধী তিনি আর কি কি করেছেন সেসব বিচারে না গিয়ে যদি ওনার চরকা কাটা ছবিটার কথা ভাবি তাহলে মনে হবে উনি চরকাটা আমাদের দীন দরিদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের কথা বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারের কথা। তাহলে আমরা কি বিদেশী ব্র্যান্ডেড কাপড়জামা পরবো না? অবশ্যই পরবো। আগে আপামর সাধারণ মানুষের বিকাশ হবে, তারপর সেসব ভাবা যাবে। ততদিন দেশটাকে বিদেশী জিনিসের মুক্তাঞ্চল না করাই বোধহয় ভালো।
আসলে যে দেশে বেশীরভাগ মানুষ চিরজীবন ব্রিটিশ রাজত্বের ভজনা করে গেলো। শান্তিপ্রিয় মানুষেরা মঙ্গল পান্ডে, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেল – যেখানেই এইসব বিপ্লবীদের কথা বলা হয়েছে বা যে কাগজে এদের খবর ছাপা হয়েছে সেটাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দেশদ্রোহিতা? কোন দেশ রক্ত না ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে? নেতাজী সুভাষ বোস একটা অঘটন মাত্র। ব্রিটিশ ভয় পেল। সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত। এই লোকটা জার্মান নয় জাপানিও নয় সম্পূর্ণ ভারতীয় অথচ সম্পূর্ণ ভারতীয় সৈন্যদল গড়ে – স্বাধীন সরকার গড়ে যুদ্ধ করতে আসছে। এমন তো হতেই পারে এর আগমনে দোর্দণ্ড ব্রিটিশ সেনা, যেটা মূলতঃ ভারতীয়দের দিয়েই বানানো, সেটা যদি সিপাহী বিদ্রোহের মতো দেশপ্রেমের নামে বিগড়ে যায় তাহলে বড্ড মুশকিল হবে। অলমিতি বিস্তারেণ। ফিরে আসি বর্তমানে।
আমরা সাধরণ চাকর মনোবৃত্তির মানুষ। চাষ বাস অতো বুঝি না। আমরা এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। যখন দু হাজার ষোলোর পাঁচুই সেপ্টেম্বর জিও ভারতে আসে তখন তারা বিনা পয়সায় সার্ভিস দেওয়া চালু করে। বিএসএনএল যখন ফোর জি স্পেকট্রাম আনে (পাবলিক সেক্টর হিসেবে খরচটা মূলতঃ বিএসএনএল করেছিলো) তখন বিএসএনএল স্পেকট্রাম নিলামে ডাক পায়নি। এবার বিএসএনএল প্রায় লুপ্তপ্রায় প্রজাতি আর জিও সম্রাটের মতো মূল্য নির্ধারণ করছে।
বিএসএনএল কর্মীরা কাজ করতো না এটা মস্ত একটা অভিযোগ। কিন্তু কোন সরকারি অফিসে সবাই ঠিকমতো কাজ করে? এদের অকর্মণ্যতা আসলে কিন্তু পরিচালকদের অক্ষমতা প্রকাশ করে। কৃষকদের কথা বলতে গেলে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ( এফসিআই ) এর কথা বলতে হবে। এফসিআইএর কাজ হলো মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি )-এ কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনা (যেটা মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর ফসল তোলার আগে নির্ধারণ করে থাকে) এবং দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যদি মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস না থাকে তাহলে এই পুরো সংস্থার কাজ কি দাঁড়াবে? অর্থাৎ আরও বহু সংস্থার মতো এটাও উঠে যাবে।
অন্যদিকে এক বস্তা আলু হিমঘরে রাখতে একজন চাষীর বস্তাপিছু ষাঠ টাকা বছরে খরচ হয়। সেই বস্তায় যেহেতু সে অতো বেশী দাম পাবে না সেহেতু ঐ আলু সে অল্প দামেই বেচে দেয়। এক্ষণে যদি আদানি (আদানি গ্রুপ কিছুদিন আগেই দুশো ছিয়ানব্বই কোটি টাকায় ভারতের বৃহত্তম কোল্ড স্টোরেজ চেইন ‘স্নোম্যান’ কিনে নিয়েছে এবং দু হাজার সাত সালে মোগা নামের একটা জায়গায় এফসিআই-এর সঙ্গে যৌথভাবে দেশের বৃহত্তম কোল্ড স্টোরেজ বানিয়ে নিয়েছে – এবার এফসিআই অকেজো হলে কী হতে পারে? এই আইনের পরে যথাসম্ভব অত্যাবশ্যকীয় শস্য কিনে মজুত করতে থাকে এবং দু এক বছর বিক্রি না’ও করে তাহলে এদের কিছুই এসে যাবে না কেননা এখন আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ন্যূনতম মূল্য থাকছে না বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারীও এখন আর বেআইনি নয়।
এটাই বর্তমান কৃষক আইনের মোদ্দা কথা। এর ফলে দু এক বছরের মধ্যেই কৃষকরা বাধ্য হবে কম দামে শস্য বেচতে অথবা দাদন নিয়ে (চাষের আগে টাকা নিয়ে) মালিকের মর্জিমাফিক চাষ করতে বাধ্য থাকবে। সুধী পাঠিকার এক্ষেত্রে নীল দর্পণ আর নীল বিদ্রোহ স্মর্তব্য। দু তিন বছর পর মূলধনের অভাবে ঐসব ছোটো ফড়েদের আর অস্তিত্বই থাকবে না।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আদানি গ্রুপের মোট সম্পত্তি প্রায় দু লক্ষ আঠাশ হাজার কোটি টাকা। আজ্ঞে আমি অঙ্কে কাঁচা বহু কষ্টে একটা মোটামুটি হিসেব করেছি। ইনি ভারতের দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি। এহেন মানুষ আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য নিয়ে মজুতদারী করলে কৃষক তো কোন ছার আমরা যারা তথাকথিত ভদ্রলোক তারা কেউও বাঁচবো না।
অবশ্যম্ভাবী কয়েকটা প্রশ্ন আসেঃ
১) মাত্র এই কজন কৃষক কেন?
২) ওরা ঠান্ডায় মরছে আর আমাদের সেনাবাহিনী লাদাখে অবর্ণনীয় শীতের মধ্যে কাজ করে না?
৩) এরা তো সবাই ভালো পোষাক পরা ভালো খাবার খাওয়া লোকজন – এরা কি সত্যি সত্যিই কৃষক?
৪) হঠাৎ সরকার কী বুঝে এমন একটা আইন চালু করলো?
এক এক করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।
১) কোনও আন্দোলনেই একশো ভাগ মানুষ যোগ দেয় না – দেয় নি। সেটা সিপাহী বিদ্রোহ হোক বা রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাই হোক বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন হোক। প্রত্যেকটায় কতিপয় দূরদর্শী মানুষ যোগ দিয়েছেন – সমর্থন করেছেন আর বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ তদানীন্তন সরকারের হয়ে গান গেয়েছে। একমাত্র সুভাষ চন্দ্র সমস্ত দেশের সমর্থন পেয়েছিলেন। সবাই রেডিওতে কান পেতে শুনতো তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো। হয়তো এটাই ব্রিটিশ সিংহের পালিয়ে যাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তবু আমাদের সুভাষ কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ ভোটে হারেন।
২) সৈন্যদের একটা বিশেষ লক্ষ্য থাকে। দেশের সুরক্ষা। তেমনি চাষীদের একটা লক্ষ্য থাকে ফসল উৎপাদন করে দেশের মানুষকে রক্ষা করা। যদি পেট চালানো বা উপার্জনের কথা বলি তাহলে সেটা উভয় ক্ষেত্রেই সমান এবং প্রাথমিক প্রয়োজন। সুতরাং একজন সাধারণ মানুষ হোক সে চাষী বা ভিখারি অথবা অভিবাসী শ্রমিক তার অনাহারে মৃত্যু বা ঠান্ডায় মৃত্যু বা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কোন অবস্থায় কাম্য নয়।
৩) আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। তা সে মধ্যবিত্ত মধ্যচিত্ত জনগণ যতই বলুক আমাদের দেশের মূল উপার্জন চাষাবাদ। এবার আমাদের ভাবনায় চাষী হচ্ছে একজন ছেঁড়া জামা পরা বিনীত কুঁজো জোড়হস্ত একজন মানুষ। যার স্বপ্ন থাকে সন্তান লেখাপড়া শিখে চাকর হবে, স্যরি চাকরি করবে । আচ্ছা তাই যদি হয় সব চাষীর সন্তান যদি চাকরি করে তাহলে ধান গম এগুলো কে ফলাবে? আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই কেরানী তৈরি করার। একজন কৃষক সন্তানের বা সূত্রধর সন্তানের উপযোগী কোনও পাঠ্যক্রম নেই। যেখানে সে মাটি চিনতে শিখবে – উন্নততর কৃষিবিদ্যা শিখে স্নাতক হবে – গবেষণা করবে – তাদের গাড়ি থাকবে – পরনে ভালো পোশাক থাকবে। তাই ভালো পোষাক পরা কৃষক দেখলে আমাদের চোখ টাটায়। দ্ধুর এ আবার কৃষক নাকি? কৃষক তো হবে মহাত্মা গান্ধীর মতোন। চড় মারলে বা শীতের রাতে গায়ে জল কামান চালালে অন্য গাল বাড়িয়ে দেবে অথবা নতমুখে বলবে আগামীকাল রাতে আবার জল কামান চালাতে আসবেন হুজুর। এদের ঠিক গরীব চাষাভুষোর ছাঁচে ফেলা যায় নি।
৪ ) সরকার ঊনিশশো আটচল্লিশ সালে প্রথম গ্যাট সমর্থন করে তারপর ঊনিশশো পঁচানব্বই সালে গ্যাট চুক্তিতে সই করে। গ্যাটের বর্তমান নাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন। এখানে কিছু বাধ্য বাধকতা থাকে। বিশেষতঃ বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে। একটা উদার মুক্ত বাজার দিতে হবে যেখানে যে কোনও দেশ অন্য দেশে কম শুল্কে দ্রব্য বিক্রি ও খরিদ করতে পারবে। ঘটনাচক্রে একমাত্র একটা দেশের ওপর এই ওয়ার্ল্ড ট্রেডিং অর্গানাইজেশনর সব সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। সেটা হলো ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। সুতরাং ভারতের কিছু বাধ্যতা ছিলো। যে কারণে নিজের শিল্পের সম্ভাবনা বাদ দিয়ে খোলা বাজারে নেমে পড়তে হয়। নিজেদের শস্য ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দিয়ে ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে চাল গম আমদানি করার বাধ্যতা মেনে নিতে হয়।
কৃষকের আন্দোলন মূলতঃ এরই বিরুদ্ধে। আপনি অবশ্যই বিরোধিতা করবেন কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠ চিরকালই সরকারি পক্ষ অবলম্বন করেছে।
খুব ভালো লাগল । আরো লিখতে হবে । তোর লেখা পড়ে খুব ভালো লাগে ।
ধন্যবাদ রে বন্ধু
অসাধারণ লেখা।
ধন্যবাদ দাদা
ভালো লেখা।
ধন্যবাদ
একদম সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।
আপনার ভালো লাগলেই আমার প্রয়াস সার্থক হবে
লেখক এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সহজ-সরল স্বাভাবিক প্রকাশ । লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমি একমত।
তোমার লেখনি আরো ধারালো হয়ে উঠুক।