অ্যালার্জি শব্দটার সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। কারুর সেলফি তোলায় অ্যালার্জি তো কারুর আবার মুখোশধারী রাজনীতিতে অ্যালার্জি। আক্ষরিক অর্থে বললে অ্যালার্জি কথাটির অর্থ হল অতিপ্রতিক্রিয়া। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বহুল আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল অ্যালার্জি।
১৯০৬ সালে ‘allergy’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন Clemens von Pirquet, একজন অষ্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী। আপাতভাবে শরীরে কোনো সমস্যা তৈরি করে না বা ক্ষতি করে না এমন কোনো বস্তুর বিরুদ্ধে যখন শরীরের প্রতিরক্ষা তন্ত্র অসংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তখন তাকে অ্যালার্জি বলা হয়।
কোনো নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়, অনেক রকম রোগই হয় অ্যালার্জির কারণে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস, হাঁপানি, আর্টিকারিয়া, হে ফিভার, অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস, অ্যালার্জিক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস (বিশেষ খাবারে অ্যালার্জি), ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত অ্যালার্জি ইত্যাদি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অ্যালার্জিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। অনুন্নত দেশগুলোতে এই সমস্ত রোগ তুলনায় অনেক কম হয়। এখন দেখা যাক এইসব রোগ কেন হয়।
যেকোনো ক্ষতিকর বস্তু সেটা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক হতে পারে, আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে প্রতিরক্ষা তন্ত্র (অনাক্রম্যতন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম) সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ক্ষতিকর নয় এমন সব বস্তুর বিরুদ্ধে যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিসক্রিয় হয়ে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তখনই হয় অ্যালার্জি। আর যে সমস্ত বস্তু অ্যালার্জি সৃষ্টি করে তাদের বলা হয় অ্যালার্জেন। সেটা হতে পারে ধোঁয়া, ধুলো, দূষিত বাতাস, ঠান্ডা হাওয়া, পশুর লোম বা পালক, ফুলের রেণু, পোকামাকড়ের রস, ডিটারজেন্ট, পারফিউম, বিশেষ খাদ্যদ্রব্য বা খাবারে মিশ্রিত অ্যাডিটিভ পদার্থ। এই সব অ্যালার্জেনগুলির বিরুদ্ধে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তার একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা মেকানিজম রয়েছে। অ্যালার্জেনগুলো মূলত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উদ্দীপক বা অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে। আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষাতন্ত্র অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি সংযুক্ত হলে পর অতি দ্রুত প্রক্রিয়ায় কিছু বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে এই ধরণের বিক্রিয়াকে টাইপ ওয়ান হাইপারসেনসিটিভিটি বিক্রিয়া (Type I Hypersensitivity Reaction) বলা হয়। মাস্ট কোষ (Mast Cell) এই বিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যদিও প্রাথমিক ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরিতে এবং ইনফ্লেমেশন সৃষ্টিতে TH2 (Helper ‘T’-Cell) মূল ভূমিকা নেয়। প্রক্রিয়াটি একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক। ধরা যাক শরীরের যে কোনো জায়গায় (ত্বক বা মিউকাস ঝিল্লি) অ্যালার্জেন বা অ্যান্টিজেন প্রবেশ করল। প্রবেশ করা মাত্রই সেই জায়গার ফ্যাগোসাইট কোষ (Phagocytes) বা ডেনড্রাইটিক কোষ (Dendritic Cell) ঐ অ্যালার্জেনটিকে ধরে গিলে নেয়। তারপর ডেনড্রাইটিক কোষ ঐ অ্যালার্জেনটিকে নিয়ে রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে নিকটস্থ লিম্ফ নোডে যায় এবং সেটিকে CD4+ Helper T-cell এর কাছে উপহারের মতো করে উপস্থাপিত করে। ফলস্বরূপ T-cell কিছু সাইটোকাইন (Cytokine) জাতীয় পদার্থের নিঃসরণ ঘটায় এবং T-cell গুলিকে TH2 cell এ বিভেদিত করে। ঐ একই সাইটোকাইনের প্রভাবে অ্যান্টিজেনের প্রবেশ স্থানে ইনফ্লেমেশন সৃষ্টি হয়। TH2 cell অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে আসার দরুন ইন্টারলিউকিন (IL-4, IL-5, IL-13) তৈরি করে। এই ইন্টারলিউকিন-৪ (IL-4) বি-লিম্ফোসাইট (B-Cell) কে উদ্দীপিত করে এবং IgE ধরণের অ্যান্টিবডি তৈরিতে প্রবৃত্ত করায়। ইন্টারলিউকিন-৫ (IL-5) ইওসিনোফিল কোষ তৈরিতে এবং তাদের উদ্দীপিত করতে কাজে লাগে। বি-লিম্ফোসাইট কোষ থেকে প্রচুর পরিমাণে IgE অ্যান্টিবডি তৈরি হলে এই অ্যান্টিবডিগুলি মাস্ট কোষে উপস্থিত FcERI রিসেপ্টরের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়। এখন IgE অ্যান্টিবডি দিয়ে সজ্জিত মাস্ট কোষগুলো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে এলে মাস্ট কোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং কিছু শক্তিশালী মিডিয়েটর নিঃসৃত করে। হিস্টামিন (Histamine), লিউকোট্রিন (Leukotrine), PAF, প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ইত্যাদি অন্যতম কয়েকটি মিডিয়েটর। যে কোনও অ্যালার্জির বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দায়ী এই মিডিয়েটরগুলো। হিস্টামিন এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মিডিয়েটর। হিস্টামিন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত মসৃণ পেশি বা smooth muscle কে সংকুচিত করে এবং স্থানীয় গ্রন্থিসমূহ থেকে রস নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। হাঁপানিতে শ্বাসকষ্ট এবং অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে নাক দিয়ে জল ঝরার এটাই মূল কারণ। এই প্রক্রিয়ার কিছুটা শেষের দিকে ইওসিনোফিল কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এগুলি বিভিন্ন প্রোটিওলাইটিক উৎসেচক (যেমন হিস্টামিনেজ), মেজর বেসিক প্রোটিন, ইওসিনোফিলিক ক্যাটায়নিক প্রোটিন ইত্যাদি নিঃসৃত করে। তাই এই জাতীয় রোগে রক্তের ইওসিনোফিল কোশের সংখ্যা পরীক্ষা করে দেখা হয়। অনেক সময় সেরাম IgE অ্যান্টিবডির মাত্রাও নিরূপণ করা হয়। চিকিৎসার মূল দিকটি হল, যে সব অ্যালার্জেন বস্তুর সংস্পর্শে এলে এই সব রোগ হয় তা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। অ্যালার্জি জনিত রোগে বহুল প্রচলিত একটি ওষুধ হল সেটিরিজিন বা লিভোসেটিরিজিন। এই ওষুধগুলো মূলত হিস্টামিনের কাজে বাধা দেয়। হিস্টামিন সাধারণত H1 রিসেপ্টরের ওপর কাজ করে। সেটিরিজিন বা লিভোসেটিরিজিন এই H1 রিসেপ্টরকে ব্লক করে দেয় অর্থাৎ হিস্টামিনকে আর রিসেপ্টরের সঙ্গে সংবদ্ধ হতে দেয় না। তবে এই সব ওষুধ আমাদের মস্তিষ্কেও ক্রিয়া করে, ফলে ঘুম পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যে সব কাজে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হয় বা মনোনিবেশ করতে হয় (যেমন, ড্রাইভার বা পাইলট) তাঁদের অতি অবশ্যই সতর্ক করে দেওয়া উচিত, যাতে কাজ করার সময় এই জাতীয় ওষুধ না খান।
অ্যালার্জি বিষয়ে যে কথাটা না বললেই নয় সেটি হল, উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই জাতীয় রোগ দিনদিন উত্তোরোত্তর বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে একটি বিতর্কিত ধারণা হল হাইজিন হাইপোথিসিস (Hygiene Hypothesis)। এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোতে অল্পবয়সে জীবাণু সংক্রমণ সবচেয়ে কম হয়, তাই অ্যালার্জিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। অল্পবয়সে যত বেশি সম্ভাব্য অ্যালার্জেন বস্তুর সংস্পর্শে আসা হবে, পরবর্তীতে এই সব রোগের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।