চিকিৎসা আমি নেহাৎ খারাপ করি, এমন অপবাদ আমার শত্রুরাও দিতে পারে না (দেখলেন তো সক্কাল সক্কাল কেমন নিজের ঢাকে নিজেই কাঠি দিলাম)!!
তবে মানুষটা আমি বেজায় “ঢিলে” (সবাই দিব্যি জানে!) আর সাংঘাতিক কড়া (এটা যারা আমার আউটডোরে অনিয়মিত ভাবে ওষুধ খায় বা “খাওয়ার চেষ্টা করে” তারা ছাড়া বিশেষ কেউ জানে না!)।
এই বিষয়ে পাঠ্য-পুস্তকের নির্দেশ বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দুই থেকেই খুব ভালোভাবে জানি, মানসিক রোগের ওষুধ-ভিত্তিক চিকিৎসায় সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে, ওষুধের একেবারে “নিষ্ঠাভরা” প্রয়োগের মধ্যে। প্রাত্যহিক ধর্মাচরণ যেমন অনেক মানুষ (আমি নিজে অবশ্য ওইসব আচার থেকে একটু দূরত্ব রাখায় বিশ্বাস করি, তবু!!) প্রবলতম “ভক্তি”র সঙ্গে, নিয়ম মেনে করে থাকে, এবং বহুদিন এক কাজ একইভাবে করেও কোনোভাবেই বিরক্ত হয়না, মানসিক রোগের (এবং আরো অনেক দীর্ঘ মেয়াদী রোগের) ক্ষেত্রেও ঠিক একই ভাবে সেই “নিষ্ঠা” জরুরী।
অন্যথায় আপাতভাবে কোনো সমস্যা যদি নাও হয়, কয়েকদিন বা কিছু সপ্তাহ বা দু-চার মাস পরে আবারো সব “লক্ষণ” এসে উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে থাকে। অসুস্থতা কোনো ক্ষেত্রে আরো বড় আকার নেয়, কখনও চিকিৎসায় চট করে সেরেও উঠতে চায় না।
এই অবস্থাটা এড়ানোর জন্য আমি ওষুধ চালু রাখার উপরে বড্ড জোর দিই। আর যারা রাখেনা, তাদের জন্য বাছা বাছা সব “শব্দবন্ধ” তৈরী থাকে। এতে কাজও হয়, “ড্রপ-আউট”-এর সংখ্যা অনেকটাই কমে।
সাধারণত: প্রশ্ন শুরু হয়, খুব নিরীহ ঢং-এ! যেমন, “কি হলো, এত দেরী কেন?” কিংবা “কি ব্যাপার গো! এতদিন পরে হঠাৎ?”
এরপরে উত্তর আসলে, স্পিন বা স্যুইং-এর বিষাক্ত ছোবল আছড়ে পরে।
সাধারণত: যে উত্তর গুলো আসে,
১) গরীব মানুষ… (যেন আগে বা পরে “গরীব” ছিল না, মাঝে মাসখানেকের জন্য “গরীব” হয়ে গিয়েছিল!!)
২) বাড়ীতে একটু অসুবিধা ছিল… ( মানসিক অসুস্থতা তত বড় অসুবিধা নয়!!)
৩) অমুকের বিয়ে, তমুকের ভাই-এর অন্নপ্রাশন… এসবের পাশাপাশি নানারকম অন্য অসুস্থতার গপ্পো! (সত্যি হতেও পারে, কিন্তু আমি একদম “একপেশে” থাকি, রোগীর চিকিৎসার প্রশ্নে!!)
৪) এবং মৃত্যু। বিভিন্নজনের এত মৃত্যু-সংবাদ অতি অনায়াসে পেশ হয়ে যায়, আমি অনেকসময় ঠাহরই করতে পারিনা, এক লোককে একাধিকবার মেরে ফেলা হচ্ছে কিনা!!??
৫) আর ইদানিংকালে যুক্ত হয়েছে, “… এই লক ডাউনের বাজার”!! গত মে মাসের পর থেকে এই ব্যাখ্যা (অনেক সময়েই “অজুহাত”!) শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল!!
এদের মধ্যে দুটো মূল ভাগ করতে হয়। একদল না আসলেও কোনো ভাবে “ওষুধ” কিনে খেয়েছে। আর একদল আসেনি, ওষুধও খায়নি। মধ্যবর্তী একটা অংশ থাকে যারা কিছুদিন ওষুধ খেয়ে বন্ধ করেছে।
যাইহোক, এই করে প্রাক-করোনা যুগের থেকে রোগীর সংখ্যা এপ্রিল মে মাসে বেশ কমে গিয়েছিল, আউটডোরে। তারপর আবার আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় সমান সমান, খুব বেশী হলে দশ শতাংশ মত কম। কিন্তু আমাকে (আমার মত সবাইকেই!) এখনও “গলাবাজি” করে যেতে হচ্ছে।
*******************************
এরইমধ্যে সেদিন এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনে একদম মিইয়ে গেছিলাম।
বয়স্কা মহিলা তার নাতিকে নিয়ে আসেন। ওর সমস্যায় টানা ওষুধ খাওয়া ভীষন জরুরী। দেরীতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলাম…
– হ, কয়দিন দেরী হইসে। এই বিষ্যুদবার তো আইসবার লগে সব ঠিকই সিলো, কিন্তু ছাগলটা…
– ছাগলটার কি হইলো?
– আরে, ছাগলটা বাচ্চা দিল তো!!
– তাই নাকি! কয়খান?
লাজুক স্বরে উত্তর আসে,
– দুই খান!
এখন, এনাকে কি আর ওষুধ বাদ দেওয়ার মতো ছোটোখাটো অপরাধে দোষী করা যায়??
*******************************
লিখবো লিখবো করে, অনেকদিন কিছু লেখা হয়নি। পার হয়ে গেল “মানসিক স্বাস্থ্য দিবস”, এই দশই অক্টোবর। ঢিলেমির অজুহাত প্রথমেই দেওয়া আছে। দিন তিনেক বাদে তাই লিখে ফেললাম, একটা বেশ হাবিজাবি লেখা।
মূল লক্ষ্য একটাই, কেউ যদি মানসিক বা শারীরিক, কোনো চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকেন, হঠাৎ করে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া নিজের উদ্যোগে সেটাকে বন্ধ করবেন না, তাতে “উল্টো বিপদ” হতে পারে। মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিষয়টি ভীষণ, ভীষনভাবে প্রযোজ্য।
ইংরেজী শব্দটা হলো “Treatment Adherence”… এককথায় কোনো বাংলা খুঁজে পেলাম না। ভেঙে বললে, “চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার সঙ্গে দৃঢ় ভাবে যুক্ত থাকা”! এইটুকুর উপরেই অনেক কিছু সাফল্য বা সুস্থ থাকা নির্ভর করে।
*******************************
যা হোক, ফূর্তিতে পূজা কাটান। “কি হলে কি হবে”, এতসব ভেবে “এইবারের” মতো পূজোর আনন্দ মাটি করবেন কেন??
পরে নাহয় নিজের জন্য বা বাড়ীর লোকের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে একটা “শয্যা” জুটিয়ে ফেলবেন! তার বাইরে বেশী কেউ অসুস্থ হলে, বেশী কেউ মারা গেলে, সেটাতো শুধুই সংখ্যা!! অত মাথা ঘামাবার কি আছে!!!
জীবন গেলে যাবে, কিন্তু পূজা, বছরের একমাত্র সত্যিকারের “আনন্দোৎসব”, মোটেই মাটি করা যাবে না! ফূর্তিতে থাকুন!!
আর সেবা করার, বা গাল খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর্মীরা তো আছেনই… তারা থাকবেন!!!
খুব সুন্দর শিক্ষা ও সচেতনতামূলক লেখা।ভালো থাকবেন।
ভালো লেখা।