আমার একটা বড় দোষ হল আমি সাধারণতঃ কোনো ব্যপারেই খুব একটা প্ররোচিত বা অনুপ্রাণিত হই না। এই অভ্যেসটা আমার ছোটবেলা থেকেই আছে এবং এজন্য বাবা-মায়ের কাছে প্রচুর বকাঝকা শুনেছি। তাঁরা বলতেন যে, এইজন্য আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কালক্রমে প্রমাণিত হয়েছে যে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী ঠিকই ছিল। আমি কোন কিছু হতে পারি নি এবং আমার দ্বারা জগতের বিশেষ উপকার বা কারও জ্ঞানতঃ মারাত্মক ক্ষতি হয় নি বলেই মনে হয়।
এবার কাজের কথায় আসি। সম্প্রতি, বেশ কয়েকজন বিখ্যাত এবং প্রতিভাবান চিকিৎসক যখন আপামর চিকিৎসকদের হাতের লেখা বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, তারপরে আমার মত অর্বাচীনের আর কিছু বক্তব্য রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় নি। কিন্তু যখন দেখলাম, আমার অন্য কয়েকজন বন্ধু এ বিষয়ে পরিহাসচ্ছলে মন্তব্য করেছেন যে, ডাক্তারদের খারাপ হাতের লেখাটা ইচ্ছাকৃত,যা একমাত্র ওষুধের দোকানদাররাই পড়তে পারে এবং এর একমাত্র যৌথ উদ্দেশ্য হল, রোগী ও তার বাড়ির লোকেদের লুঠপাট করা- তখন বাধ্য হয়ে এই লেখার অবতারণা করতে হল।
হাতের লেখার বিষয়ে গোপাল ভাঁড়ের গল্প নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, তবু আরেকবার বলি। গোপালের এক প্রতিবেশী তাকে অনুরোধ করল তার শ্বশুরবাড়িতে একটি চিঠি লিখে দিতে। তখনকার দিনে বেশীরভাগ মানুষ লিখতে পারত না। গোপাল তাকে বলল, ‘আমার তো পায়ে চোট। হাঁটতে পারছি না। কি করে চিঠি লিখব?’ প্রতিবেশী তখন বলল, ‘পায়ের চোটের সাথে চিঠি লেখার কি সম্পর্ক? চিঠি তো লিখবে হাত দিয়ে!’ ‘হাত দিয়ে লিখলেও, চিঠিটা তো গিয়ে আমায় পড়ে দিয়ে আসতে হবে! ভাঙ্গা পা নিয়ে আমি এখন তোমার শ্বশুরবাড়িতে যাই কি করে?’
বিখ্যাত লোকেদের হাতের লেখার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী-র কথা। ছোটবেলায় তাঁর হাতের লেখা মোটেই ভালো ছিল না। সেই আক্ষেপের কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। আইনষ্টাইন, অস্কার ওয়াইল্ড, বিঠোফেন, লিঙ্কন, বিল গেটস – এদের কারো হাতের লেখাই ভালো নয় বা ছিল না। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের হাতের লেখা তার মানসিক স্থিতি এবং ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে।
ছোটবেলায় কোনো বিশেষ প্রচেষ্টা ছাড়াই অনেকের হাতের লেখা ভালো থাকে, একেবারে যাকে বলে ‘মুক্তোর মত’। আবার অনেকেরই হাতের লেখা যারপরনাই খারাপ এবং এতই খারাপ যে স্কুল কলেজে পরীক্ষার খাতায় তাদের লেখা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। অর্থ্যাৎ, কোনো একটা বিষয় তারা কতটা জানে, সেটা পরীক্ষক ভালো করে বুঝতেই পারেন না- এবং স্বভাবতঃই প্রাপ্যের তুলনায় কম নম্বর দেন। নিজে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ন’বছর পড়িয়ে এবং কলেজ জীবনে দু’বছর টিউশনি করে এটা আমার অভিজ্ঞতা।
আর এক ধরণের মানুষ আছেন, যাদের হাতের লেখা খুব ভালো নয়, আবার খুব খারাপও নয়। একটু চেষ্টা করলেই তারা তাদের লেখা ভালো না হোক, অন্ততঃ জনসাধারণের বোধগম্য করে তুলতে পারে। আমার নিজের হাতের লেখা এই গোত্রের। অর্থোপেডিক্সে আমার এক শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক শিক্ষকের হাতের লেখাও খুব দর্শনীয় নয়। তবে তাঁর প্রতিটা অক্ষর এমন গোটা গোটা এবং স্পষ্ট যে হাসপাতালে বা প্র্যাকটিসে তাঁর লেখা পড়তে পারছে না- এমন অভিযোগ কেউ করেছে বলে কোনদিন শুনিনি।
ডাক্তারদের হাতের লেখা সম্বন্ধে যে অভিযোগ উঠেছে বা অনেক সময়ই করা হয়, সেটা এর ঠিক উল্টো। ডাক্তাররা তাদের হাতের লেখাকে নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করে ফেলে, যাতে কিনা একমাত্র ওষুধের দোকানদার ছাড়া আর কেউই সেই লেখা বুঝতে না পারে! ইচ্ছাকৃতভাবে হাতের লেখা ভালো করা যেমন কঠিন ব্যাপার-যেটা আমার অভিজ্ঞতায় আছে- ইচ্ছাকৃত খারাপ করাও সেরকমই কঠিন। তবে হয়তো কেউ নিজের খারাপ হাতের লেখাকে সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে। কে না জানে, বেশীদিন লেখার অভ্যেস চলে গেলে অথবা খুব দ্রুত লেখার চেষ্টা করলে হাতের লেখা অনেকটাই খারাপ হয়ে যায়। যেটা ডাক্তারদের ক্ষেত্রে অনেকসময় ঘটে থাকে। এটাও হতে পারে যে, কেউ কেউ তাদের হাতের লেখা সর্বসাধারণের বোধগম্য করার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন না।
এই সমস্যার সমাধান করার অব্যর্থ দুটো রাস্তা আছে।
প্রথম রাস্তা, কম্পিউটার ব্যবহার করে ছাপানো প্রেসক্রিপশন দেওয়া। বড় বেসরকারি হাসপাতালে এবং অনেক ডাক্তার ব্যক্তিগত ক্লিনিকে এটা করে থাকেন। আমি ২০১০ সাল থেকে এটা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। হাসপাতাল ও নিজের ক্লিনিকে করা গেলেও, ছোটখাটো চেম্বারে প্রিন্টার বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। তারপর এখন মহামারীর চাপে পরিস্থিতি পুরো ঘেঁটে গেছে। অনেক গ্রামে ও মফঃস্বলে কম্পিউটার এবং প্রিন্টার এখনও স্বপ্ন। সুতরাং, দেশের বেশীরভাগ ডাক্তারের পক্ষে কম্পিউটারাইজড প্রেসক্রিপশন করা এখনও সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় আর একটি সহজতর রাস্তা হচ্ছে, হাতে লেখা প্রেসক্রিপশনে অন্ততঃ ওষুধের নামগুলো এবং তার ব্যবহার প্রণালী গোটা গোটা অক্ষরে বড় হাতে (Capital letter) লেখা। আর অন্যান্য উপদেশগুলো (কি খাবেন, কি খাবেন না, কিভাবে বসবেন, কতক্ষন হাঁটবেন ইত্যাদি) সহজবোধ্য বাংলা বা হিন্দীতে লিখে দেওয়া। যাতে ফার্মাসিষ্ট এবং রোগী/ বাড়ির লোক প্রেসক্রিপশনে তাদের সম্পর্কিত অংশটি সহজে বুঝতে পারে। বিভ্রান্ত না হয়।
তারা যদি বিভ্রান্ত হয় তাহলে কিছু মানুষ সেই সুযোগ নেবে এবং হাস্যরস বা অন্য কোনো রসের মোড়কে মানুষকে আরো বিভ্রান্ত করবে। সমস্যা ও তার সমাধানের মূলে পৌঁছনোর পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেওয়া এইসব দু-লাইনের ফেসবুক বিপ্লবীদের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেন এখনও মূলতঃ বেসরকারী? এমনকি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও অনেকদিন আগেই প্রায় সম্পূর্ণ কাগজবিহীন (paperless) হয়ে গেলেও আমরা কেন তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারছি না- এসব অপ্রিয় প্রশ্ন তোলার ঝুঁকি তারা নেবে না। তাই প্রতিটি প্রেসক্রিপশন লিখতে একটু বেশী সময় লাগলেও ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনকে বোধগম্য করার চেষ্টা করতে হবে।
যিনি তার ফেসবুক পোষ্টের মাধ্যমে দুটো পেশাকে (ডাক্তারি এবং ওষুধের দোকানদার/ফার্মাসিষ্ট) একসাথে দাগী অপরাধী বানানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁর হাতের লেখা কেমন আমি ঠিক জানিনা। হয়ত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তবে বিভিন্ন পেশার অন্যান্য অনেক লোকের হাতের লেখা এবং ইংরেজি-বাংলা বানানের অনেক মণিমানিক্য আমার কাছে ফাইলবন্দী আছে, এটুকু বলতে পারি।
সময়োপযোগী লেখা