আরজি করের ঘটনা নিয়ে মনটা একেবারে খিঁচড়ে ছিল এই কদিন। নিজের কলেজ। দেড় দশক আগে ছেড়েছি। যেই কলেজ থেকে পড়ে, ইন্টার্নশিপ শেষ করে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ডাক্তারি শিখলাম, সেখানেই এরকম একটা ঘটনা। একসময় যেই কলেজকে – তার বিল্ডিং, ওয়ার্ড, হোস্টেল – সবকিছু প্রায় হাতের তালুর মত চিনতাম, সেখানে এরকম একটা ঘটনা কখনো হতে পারে এটা অভাবনীয় ছিল আমার কাছে। আমাদের অনেকের কাছেই। ভাবতে পারছিলাম না, প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। যেই হাসপাতালে আমরা ইন্টার্ন ছিলাম, রাতের পর রাত জেগে এই ওয়ার্ড সেই ওয়ার্ড, এই বিল্ডিং সেই বিল্ডিং করে দৌড়ে বেড়াতাম, ইমারজেন্সি কলবুক এটেন্ড করতে, মাঝরাতে পাশের খাবারের দোকানে গিয়ে ম্যাগি খেয়ে পেট ভরাতাম, কাজের ফাঁকে যেখানে সেখানে যেকোনো খালি জায়গা পেলে কোনোমতে শুয়ে পড়তাম, টানা ডিইউটির মাঝে যদি দুমিনিট চোখ জুড়িয়ে রেস্ট নিতে পারি তো সেটাও অনেক।
আমরা, মানে জুনিয়র ডাক্তাররা, ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ, পিজিটিরা পুরো স্পেসটাকে দাপিয়ে বেড়াতাম রাতজুড়ে, সিনিয়র প্রফেসররা তো সকালে আসতেন। এবং বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আমার অনেক সহপাঠিনী মহিলা ইন্টার্নদের সেইটাই ছিল প্রথম ওয়ার্কপ্লেসে রাত জাগা, নাইট ডিউটি করা। একটা স্বাধীনতার স্বাদও ছিল তাতে। সাথে ছিল উত্তেজনা। নতুন কিছু শিখছি জানছি, এই প্রথম হাতে কলমে ডাক্তারি করছি, রুগীর বাড়ির লোকের সাথে জীবনে প্রথম বার কথা বলছি এইসব। এই গোটা জায়গাটা কখনো সেরকম আনসেফ স্পেস বলে মনে হয়নি। ইন্টার্নশিপের একটা গোটা বছর ওই এমার্জেন্সি বিল্ডিং, গাইনি বিল্ডিং, সার্জিকাল ব্লক – এইগুলোই প্রায় ঘরবাড়ি ছিল আমাদের। হ্যাঁ , কিছু কিছু রাস্তা, করিডোর, কয়েকটা অন-কল রুম একটু নির্জন ছিল। সেটা নিয়ে আমার অনেক সহপাঠিনী ইন্টার্নদের মধ্যে একটু অস্বস্তি, গা ছমছম ছিল। সিকিউরিটি কোনোদিনও সেরকম ছিলনা। প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু জানতাম চারিদিকে এত পেশেন্ট, রুগীর বাড়ির লোক, সিস্টার, ওয়ার্ড বয় – সবমিলিয়ে একটা আশ্বস্ত বোধ কাজ করত। এখানে এট্ লিস্ট সেরকম কিছু হবেনা।
এই ঘটনায় যেটা সবচেয়ে ধাক্কা খেলাম সেটা হলো যেটাকে সবচেয়ে ‘সেফ স্পেস’ ভাবতাম আমরা, আমাদের সহপাঠিনীরা, মহিলা জুনিয়র ডাক্তাররা, যেই বিশ্বাসের উপর ভরসা রেখে যেখানে সেখানে শুয়ে পড়ে ডিউটির মাঝে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতাম আমরা, সেই বিশ্বাস বা ভরসার জায়গাটা এই এক ঘটনার ধাক্কায় নিমেষে ভেঙে গেলো। মহিলাদের সেফ স্পেস বলে আর কিছু রইলো। আসলে ছিলোও না কোনোদিন। আমরা ভাবতে ভালোবাসতাম যে কিছু জায়গা যেমন শহরের বুকে বড় সরকারি হাসপাতাল এখনো অবধি সেফ স্পেস। না তা নয়।
ফেসবুকে দুটো ছবি দেখে মনটা আজ একটু উজ্জীবিত হলো – এক, গতকাল আমার কলেজের বাইরে জনসমুদ্র দেখে। উপচে পড়া মানুষর ভিড়। এই ভয়াবহ ঘটনার বিচার চাইতে। আরজিকর থেকে শ্যামবাজার এমনকি শোভাবাজার অবধি থিকথিকে মানুষের ভিড় – এ দৃশ্য কখনো দেখতে পাবো ভাবিনি। আর দুই, আমাদের কলেজের একজন প্রাক্তন ডাক্তার অধ্যাপক মিলন চক্রবর্তীর একটা ছবি দেখলাম আজকে ফেসবুকে। উনি এখন এনআরএস হাসপাতালের জেনারেল মেডিসিন বিভাগের হেড। আমাদের সমযে আরজিকরে মেডিসিন বিভাগের অনেক জুনিওর প্রফেসর ছিলেন, আমরা ডাকতাম ‘এমসি’ নামে, এখন হেড হয়েছেন। ‘এমসি’ সেই প্রজন্মের ডাক্তার তারা জেনারেল মেডিসিনে এমডি পাস্ করেই সাথে সাথেই সুপারস্পেশালিটি ডিএম করার দিকে দৌড়তেন না। ভালোবেসে জেনারেল মেডিসিনই পড়াশোনা করতেন, সরকারি হাসপাতালে তা প্রাকটিস করতেন। খুব সুন্দর ছাত্রদের বুঝিয়ে পড়াতেন, সময় নিয়ে রাউন্ড দিতেন, সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার, ধৈর্য ধরে কথা, সে রুগীর বাড়ির লোকই হোক বা ছাত্রই হোক। এগুলোই একজন ডাক্তারের করা উচিত। কিন্তু এগুলোই এখন সরকারি সেটাপে কম দেখা যায় দুর্ভাগ্যবশতঃ। ফেসবুকে দেখলাম উনি আজ সকালে ওয়ার্ডে রুগীর বিছানায় বসে রুগীর হাত থেকে ব্লাড টানছেন। যেই বেসিক কাজটা দিয়ে একজন ইন্টার্ন তার হাতেকলমে ডাক্তারী জীবন শুরু করেন সেই কাজটা কেরিয়ারের শেষের দিকে উনি নিঃশব্দে একা বসে করে চলেছেন। চারিপাশে কেউ নেই। কোনো অভিযোগও নেই। উনি জুনিয়র ডাক্তারদের বলেছেন ‘তোমরা তোমাদের আন্দোলন ধর্মঘট চালিয়ে যাও আমরা সিনিয়র প্রফেসররা হাসপাতাল সামলে নেবো’। সেইসময়ে শুনেছিলাম উনি বামপন্থী ছাত্ররাজনীতি করতেন একসময়ে, জানিনা সেটা কতটা সত্যি, তবে সেরকম হলে আশ্চর্য হবোনা। এরা একটা প্রজন্ম ছিলেন। আজকের বিশ্বায়ন নব্য উদারবাদের চক্করে যেই প্রজন্ম সেভাবে আর পাওয়া যাবে না।
যাই হোক, রাতের শহর, রাতের রাস্তা মেয়েদের দখল নেওয়ার ডাক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। এটাও একভাবে অভাবনীয়। এই ডাকে এরকম অভূতপূর্ব সাড়া আসবে আমি এবং অনেকেই ভাবতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় মফস্বল টাউনে মহিলারা, মেয়েরা জড়ো হচ্ছেন আগামীকাল। অনেকেই বলছেন এটা নেহাতই প্রতীকী। একদিনের ডাকে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। সেইসব সমালোচনা মাথায় রেখেই বলছি যে ডাক জনমানসে এরকম আলোড়ন ফেলতে পারে তার একটা ওজন রয়েছে, সিগ্নিফিকেন্স রয়েছে। তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়না। যে কোনো কিছু একটা জায়গা থেকে শুরু করতে হয়, তার সমস্ত সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও। বিজেপি -তৃণমূল এই ডাকের পাল্টা নারীবিদ্বেষী ক্যামপেন করতে নেমে পড়েছে । আশা রাখি এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে, বাংলার নতুন প্রজন্মের নারীবাদী আন্দোলনে, বামপন্থী আন্দোলনে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। পেসিমিস্ট আমি নই, আশা রাখতে ভালোবাসি। যেরকম বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনেও রেখেছিলাম, এখানেও রাখছি।