সেই মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিবারের থেকে isolation-এ আছি। আলাদা ঘর। হাসপাতালের সময়টুকু ছাড়া দিন কেটে যায় ওই ঘরে। বইই সঙ্গী। মেয়ের অবসর কাটতো আমার সাথে বক বক করে। তাও প্রায় বন্ধ। একটা হতাশা গ্রাস করছে ক্রমশ। আট দিন আগে আমার এক অত্যন্ত প্রিয় সহকর্মী, যার ডাক্তারীর প্রতি ভালোবাসা অসীম, এক শ্বাসকষ্টের রুগীকে protective gear পরে দেখতে গিয়ে আজ করোনাতে আক্রান্ত। কাল তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। প্রটোকল অনুসারে ১৫ মিনিটের বেশি এ জাতীয় রোগীর কাছে থাকা উচিত নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তাঁকে বাধ্য করে ৩০ মিনিটের বেশি সময় থাকতে। অথচ তাঁরা রুগীকে যখন নিয়ে আসেন তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা ৫৫%। বেশির ভাগের মুখেই মাস্ক নেই। ফল হাতেনাতে। এরই মধ্যে আমারও একই ঘটনা। আবার সেই সন্দেহভাজন শ্বাসকষ্টের রোগী ও পরবর্তী পরীক্ষায় covid পসিটিভ। চিরকালের অভ্যাস যত্ন করে দেখার। যদিও সময় নিয়েছি প্রটোকল মেনেই। (অথচ খবরে শুনি শ্বাসকষ্টের রোগী দেখলেই নাকি ডাক্তাররা পালাচ্ছে!)। সুতরাং বাড়ি ফিরেই আরো কড়া isolation।
বাড়িতে আশি বছরের মা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে ছেলের খাওয়া দেখছে। এতদিনের অভ্যেস দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ানো। সেটা মানতে না পেরে মানসিক চাপে। মনে অজানা ভয়। মার ঠাকুর ঘরে আরো বেশি সময়। যেদিন বিকেলে বাড়ি থাকি সবাই একসাথে চা খাই। এখন আমি আলাদা। বন্ধ টিভি দেখা। রাত্রিবেলা শুতে আসলেই মেয়ের গলা জড়িয়ে সারাদিনের ঘটনা বিবৃত করা বন্ধ। সব সময় মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়। দূর থেকে সজল দৃষ্টিপাত। সহধর্মিনীর আপাত কাঠিন্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখা বেদনা। সব মিলিয়ে এক দুঃসহ জীবন যাপন। এরই মধ্যে এই ঘটনা পরিবারের মধ্যে তীব্র হতাশা নিয়ে আসে।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি মেয়ে বলেছে, ‘বাবার কিছু হলে আমরা সবাই মরে যাওয়া ভালো’।
আমার মনে হল মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এ কি পেশায় এসেছি? চাকরি তো করি পরিবারের জন্য। সেই পরিবারের লোককে যদি নিরাপত্তা না দিতে পারি.. কি দরকার এই চাকরির??
আপনারা, যাঁরা এমন চাকরি করেন যে অফিসে কেউ করোনা হলেই তিন দিন অফিস বন্ধ করে sanitization হয়…জেনে রাখুন আমরা তা পাই না। জেনে রাখুন কোয়ারেন্টিনে থাকা আমাদের কাছে অজানা এক শব্দ। আমাদেরও ভর্তির জন্য এ হাসপাতাল, ও হাসপাতাল করতে হয়। পরীক্ষা করাতে অপেক্ষা করতে হয়। অথচ চোখের সামনে দেখি অন্য দপ্তরের অফিসাররা রাতারাতি পরীক্ষা করে নিয়ে আসেন।
এই লেখার উদ্দেশ্য একটাই ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যে লড়াই দিচ্ছেন তাকে অন্ততঃ সম্মান দিন। আর স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা আক্রান্ত হলে তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তাঁরা যে দুঃসহ যাতনা নিয়ে কোনো ক্রমে মরে বেঁচে আছে..তাঁদের যাতনাটাও একটু অনুভব করুন।
ভগবানের আর্শীবাদে সুস্থ থাকুন।হৃদয়গ্ৰাহী লেখার জন্য ধন্যবাদ।
নত মস্তকে প্রণাম জানাই। অবশ্যই সুস্থ থাকবেন।