নবজাতককে স্নান করাবো কি না, কবে করাবো, কি ভাবে করাবো এই সব জানতে গেলে তার আগে আমাদের আরো কিছু বিষয় জেনে নিতে হবে।
শিশু জন্মানোর আগে থাকে মাতৃ জঠরে। একটা থলে ভর্তি জলের মধ্যে শিশু ভেসে থাকে। সেই জলকে বলে এমনিয়োটিক ফ্লুইড। শিশুর ঘোরা, হাত-পা নাড়া সব সেই জলের মধ্যে হয়। আর শিশুর ত্বকের উপরে লেগে থাকে এক ধরনের মোম জাতীয় তৈলাক্ত ক্রিমের মত পদার্থ, তাকে ডাক্তারী ভাষায় বলে ‘ভার্নিক্স কেজিওসা’। শিশুর ত্বকের সিবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত সিবাম, ঝরে পড়া লোম, মৃত ঝরে পড়া কোষ – সব এক সাথে মিলে এই ভার্নিক্স তৈরি হয়। শিশু যত পরিণত হতে থাকে, ততোই এই ভার্নিক্সের পরিমাণ কমতে থাকে। অপরিণত শিশুর ক্ষেত্রে বেশী থাকে। আবার জন্মানোর নির্দিষ্ট দিন পেরিয়ে গেলে ভার্নিক্স এবং জল, দুটোর পরিমাণই কমতে থাকে।
এই ভার্নিক্সের কাজ নানাবিধ।
১। গর্ভস্থ শিশুর ত্বক খুব নরম। এমনিয়োটিক ফ্লুইডের মধ্যে শিশু যখন নড়াচড়া করে, তখন যাতে ত্বকের কোনও ক্ষতি না হয়, তার জন্যে প্রকৃতিই এই ব্যবস্থা করে রেখেছে।
২। জন্মানোর আগে শিশু মাতৃগর্ভে থাকে, সেখানকার তাপমাত্রা মায়ের শরীরের তাপমাত্রার সমান থাকে, সব সময় প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশে-পাশে। সেই তাপমাত্রায় শিশু বেড়ে ওঠে। তারপর সে হঠাৎ ভূমিষ্ঠ হয় এই পৃথিবীতে। আর পৃথিবীর তাপমাত্রা গরমকাল ছাড়া অন্য সময়ে অনেক কম থাকে। শীতকালে যেমন বারো/তের ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়ে যায় বা আরও কম হয়। হঠাৎ অন্য তাপমাত্রায় এসে পড়া শিশুর দরকার হয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের- ভার্নিক্স এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৩। ভার্নিক্স শিশুকে নানা রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। যখনই শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, সে এসে পড়ে এমন একটি পরিবেশে, যেখানে তার চারিদিকেই রোগ জীবাণু, আর এই রোগ-জীবাণুগুলি শিশুকে আক্রমণ করার জন্যে মুখিয়ে থাকে। ভার্নিক্স ঢালের মত তাদের আক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষা করে। ভার্নিক্সের মধ্যে কিছু জীবাণুনাশকও থাকে, যা আক্রমণকারী জীবাণুকে ধ্বংস করে।
৪। শিশু জন্মানোর ক্ষেত্রেও ভার্নিক্স সাহায্য করে, তার জন্মানোর পথকে সুগম ও পিচ্ছিল করে।
এই ভার্নিক্স কেজিয়োসা দেখতে অনেকটা মোমের মত, সহজে গা থেকে উঠতে চায় না, সাদা বা সাদা-হলদেটে রঙের হয়। যেহেতু শিশুর গর্ভকালীন বয়সের সাথে ভার্নিক্সের পরিমাণের সম্পর্ক আছে, তাই জন্মানোর সময় কোনও কোনও শিশুর গায়ে অল্প আবার কারও গায়ে বেশি ভার্নিক্স লেগে থাকে। অনেকেই মনে করেন, এটি শিশুর গায়ের ময়লা, যা পরিষ্কার করা দরকার। তাই জন্মাবার পরে পরেই শিশুকে কেউ কেউ স্নান করিয়ে দেন। আগে এই ঘটনা বেশি ঘটত, যখন বাড়িতে শিশুর জন্ম হ’ত বেশি এবং তখন গ্রাম্য ধাইয়েরাই প্রাথমিক উপদেশ দিতেন। তাঁদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব ছিল। এই কারণে অনেক শিশুর ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, এমনকি নিউমোনিয়াও হতে পারে।
তাই শিশু জন্মানোর পর কখনই সাথে সাথে স্নান করানো উচিৎ নয়। তার গায়ে যদি বেশি এমনিইয়োটিক ফ্লুইড থাকে বা রক্ত লেগে থাকে, তখন তাকে উষ্ণ ও নরম তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার করে গরম বিছানায় রাখতে হবে। কিন্তু এসব হাসপাতালের লেবার রুমের ঘটনা, বাড়ির লোকের জানা দরকার শিশুকে কবে স্নান করানো যাবে, কিভাবে। আমি এবার সেই সব বিষয়ে আলোকপাত করব।
স্নান করানোর আগে আমাদের আর একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, নবজাতকের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম থাকে। অথচ বাইরের জলে, স্থলে আকাশে-বাতাশে তাকে আক্রমণ করার জন্যে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস। এগুলো থেকে শিশুকে রক্ষা করাই আমাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিশুর ত্বকের মাধ্যমে, নাকের ও মুখের ভিতর দিয়ে এই সব রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। আর নবজাতকের ক্ষেত্রে নাভি বা আম্বেলিকাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নাভির মাধ্যমেই শিশুর সঙ্গে তার মায়ের যোগাযোগ থাকে। জন্মানোর পরেও এই নাভির সঙ্গে নবজাতকের রক্তের সরাসরি যোগ থাকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই নাভি ভালভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই নাভিই রোগ জীবাণু প্রবেশের অন্যতম পথ। এই পথে জীবাণু সরাসরি নবজাতকের শরীরে এবং রক্তে প্রবেশ করতে পারে এবং মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
স্নান করানোর জল যতই পরিষ্কার হোক, সেখানে অনেক ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস থাকতে পারে বা থাকেও। জলের সাথে তারা সহজেই শিশুর সংস্পর্শে আসতে পারে এবং শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। সে কথা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর কানে যদি জল ঢুকে যায়, তাহলেও অসুবিধা হতে পারে, কান পেকে যেতেও পারে। এই সব কথা মাথায় রেখে শিশুকে স্নান করানোর বিষয়টি ভাবতে হবে।
বাড়িতে এনে শিশুকে কতদিন পরে, কিভাবে স্নান করানো যাবে?
বাড়িতে এনে প্রথম মাসে শিশুকে স্নান করানোর দরকার নেই। এমনকি প্রথম বৎসরে শিশুকে বেশি স্নান করানোর দরকার হয় না। ঠান্ডার দেশে ২-৩ দিন পরে পরে স্নান করাতে বলা হয়, বাকী দিনে স্পঞ্জ করে গা হাত পা মুছিয়ে দিলেই চলে। তবে আমাদের গরমের দেশের হিসাব কিছুটা আলাদা। শিশুর বয়স এক মাস হওয়ার পর স্নান শুরু করাতে হবে। প্রথমে এক দুদিন পরে পরে, তারপর গরম কালে প্রতিদিনই স্নান করানো যেতে পারে। শীতের সময় এক দু’দিন পরে পরে স্নান করানো ভাল। যেদিন স্নান করানো হবে না, সেদিন গা হাত-পা উষ্ণ জলে ভিজিয়ে নরম তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতে হবে। তবে প্রথম মাসে জল ঢেলে স্নান না করালেও গা হাত-পা এক দু’দিন পরে পরে মুছিয়ে দেওয়া যাবে। নাভি পড়া ও শুকিয়ে যাওয়ার সাথে স্নান করানোর একটা সম্পর্ক আছে। স্নান করানোর সময় যদি কাঁচা নাভিতে জল লাগে, তখন নাভি পেকে যেতে পারে। তাই কাঁচা নাভিতে যেন কোন ভাবেই জল না লাগে।
স্নান করানোর সময় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে।
১। শিশুকে সব সময় উষ্ণ ধুলোবালি মুক্ত পরিবেশে স্নান করাতে হবে। ঘরের মধ্যে হলে ভাল হয়।
২। স্নান করানোর পরে বা স্নান করানোর সময় যে সব জিনিসের প্রয়োজন হতে পারে, সেগুলো আগে থেকেই হাতের কাছে রাখতে হবে- কারণ শিশুকে বেশিক্ষণ খালি গায়ে রাখা যাবে না।
৩। স্নানের জল উষ্ণ হওয়া দরকার তবে বেশি গরম নয়। তাই আগে জলের তাপমাত্রা নিজে হাত দিয়ে বা কনুই দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
৪। আগে শিশুর মুখে জল দিতে হবে এবং তারপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতে হবে। শিশুর চোখ আলাদা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে হবে।
৫। সাবান ব্যবহার করলে ডিটারজেন্ট ফ্রি সাবান বা শিশুদের সাবান ব্যবহার করতে হবে এবং উপর থেকে নীচের দিকে সাবান লাগিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষ নজর দিতে হবে ত্বকের ভাঁজের দিকে- যেমন বগলে, কুঁচকির দিকে, কানের পিছনে ইত্যাদি।
৭। কন্যা শিশুকে স্নান করানোর সময় সামনের দিক থেকে পিছনের দিকে জল দিতে হবে, ছেলেদের ক্ষেত্রে তার লিঙ্গের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যেন বেশি টানাটানি না করা হয়।
৮। শিশুর মাথা ধোয়াতে হবে বা মাথায় জল দিতে হবে সবার পরে। এতে তার ঠান্ডা কম লাগবে এবং শরীরের তাপমাত্রা ঠিক থাকবে।
৯। স্নান করানোর পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শিশুকে শুকনো তোয়ালে বা নরম কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিতে হবে।
১০। শিশুকে স্নান করানোর পরে নিয়মিত ভাবে কোন তেল, ক্রিম বা লোশান মাখাবার দরকার নেই। যখন শিশুর চামড়া শুকিয়ে যাবে, বা খসখসে হবে, তখন দরকারে এসব লাগানো যেতে পারে – কিন্তু তার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। কোনও গন্ধযুক্ত বা এলকোহল যুক্ত কিছু গায়ে লাগানো যাবে না।
সতর্কতাঃ
১। আমাদের দেশে, বিশেষতঃ হিন্দি বলয়ে নবজাতককে বাইরে উঠোনে শুইয়ে খালি গায়ে বেশ করে অনেক্ষণ ধরে তেল মালিশ করার রীতি আছে। এটি করা উচিৎ নয়, কারণ খালি গায়ে শিশুর হাওয়া লাগতে পারে, তাতে ঠান্ডা লেগে যায়। আবার, বাইরের ধুলোবালিও শিশুর গায়ে লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্য রোগ-ভোগের সম্ভাবনাও থাকে।
২। শিশুকে স্নান করানো উচিৎ ঘরের মধ্যে বা এমন জায়গায়, যেখানে বেশি হাওয়া না থাকে। জায়গাটা যেন স্যাঁতসেঁতে না হয়, ঠান্ডা না হয়। উষ্ণ পরিবেশ বাঞ্ছনীয়।
৩। শিশুর কানে যাতে জল না যায়, তার জন্যে বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে। দরকারে স্নান করানোর সময় কানের মধ্যে খানিকটা তুলো দিয়ে জল ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে।
৪। প্রতিদিন স্নান করানোর চেয়ে শিশুকে পরিষ্কার রাখাটা জরুরী। যে দিন স্নান করানো হবে না, সে দিন উষ্ণ জলে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে শিশুর গা স্পঞ্জ করে দিয়ে হবে।
৫। যতদিন শিশুর নাভি না পড়বে বা নাভি না শুকাবে, ততদিন স্নান করানোর দরকার নেই। কাঁচা নাভিতে যেন কোন অবস্থায়ই জল না লাগে।
৬। শীতকালে স্নান কম করালে ভাল, করালেও উষ্ণ পরিবেশে ঘরের মধ্যে বসে করাতে হবে।
পরিশেষে বলি, শিশুকে জল ঢেলে স্নান করানোর থেকে তার শরীরের দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে এবং তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাকে সুস্থ রাখতে হবে, দেখতে হবে স্নান করাতে গিয়ে যেন তার ঠান্ডা লেগে না যায়।