মেডিক্যাল কলেজ ভাঙা হবে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কোনও নড়াচড়া কারওর দেখা যাচ্ছে না। ততদিনে (কানাঘুষোয়) জানা গেছে যে সামনের বিশাল বিশাল থাম আর সেই বিখ্যাত সিঁড়ির কোনও পরিবর্তন হবে না, তাই কারওর বেশি দুঃখও নেই। একদিন গোগোল এসে বলল যে ও নাকি কোন পি–ডব্লু–ডি ইন্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে যে পি–ডব্লু–ডি এখন আর মেডিক্যাল কলেজের প্রধান বাড়িটার মেরামত করবে না, কারণ অর্ডার এসেছে যে রেনোভেশন হবে।
কিন্তু তার কোনও লক্ষণ তো দেখা যায় না। শোনা গেল মেডিক্যাল কলেজের মেইন বিল্ডিং–এর সব ওয়ার্ড সরিয়ে গ্রিন–বিল্ডিং–এ নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু গ্রিন যেহেতু গাইনিকলজির জন্য তৈরি হচ্ছিল, তাই তারা চ্যাঁ–চ্যাঁ শুরু করেছে, ইত্যাদি।
দিন, সপ্তাহ, মাস কেটে যায়। পি.ডব্লু.ডি–র মেরামত বন্ধ, ফলে এধারে ওধারে নানারকম সমস্যা – এখানে ইসকুরুপ খসে পড়া, ওখানে জানলার কাচ ভাঙা – আর সারানো হয় না। উত্তরের দক্ষিণের বারান্দার থামের মাঝে মাঝে যে বিশাল বিশাল তেরপলের পর্দা ঝুলত, সেগুলো ছিঁড়তে মেরামত হয় না। ফলে শীতের সময়ে ঠাণ্ডা হাওয়ায় পেশেন্টরা কাঁপে, বর্ষায় ওয়ার্ডে জল ঢুকে যায়। টুকটাক রঙ করা, দরজা সারানো, এই সব করতে গেলেও তিনবার চিঠি দিতে হয়।
একদিন, বর্ষাকাল। সেদিন কী কারণে আমি একা – সঙ্গীরা সবাই বাড়ি গেছে। সমস্যা হতে পারে এমন পেশেন্ট ছিল না নিশ্চয়ই। কিন্তু একা বলে সারা হাসপাতাল ঘুরে সব রোগী দেখতে সময় লেগেছিল। শেষ হয়েছিল এমার্জেনসিতে। রাত তখন প্রায় ন’টা। এমার্জেনসি থেকে বেরিয়ে দেখি এতক্ষণের টিপটিপ বৃষ্টি বেশ ঝিরঝিরে হয়েছে। সঙ্গে ছাতা নেই। ছাতা নিয়ে এ–ওয়ার্ড থেকে ও–ওয়ার্ডে যাওয়া সহজ নয় বলে ডিপার্টমেন্ট–এর অফিসে রেখে ওয়ার্ডে গেছিলাম। বেশিরভাগ ওয়ার্ড থেকে যাতায়াত করার টালি–ঢাকা পায়েচলা রাস্তা আছে, তাই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখন আর সেই সুবিধা নেই। বৃষ্টি বেড়েওছে।
নিউরোলজির অফিসটা ছিল মেডিক্যাল কলেজের প্রধান বিল্ডিং–এর মধ্যেই। অর্থাৎ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ঠিক উলটো দিকে। বৃষ্টির মধ্যে অজস্র সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। এক ছুটে। পা হড়কালে কিংবা হোঁচট খেলে হয় সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়া, নইলে গড়িয়ে নিচে নেমে আসা।
কিন্তু দাঁড়াবার উপায় নেই। রাতের খাবার পেতে গেলে সাড়ে–নটার বেশি দেরি করা চলবে না। তাই একছুটে উঠতে শুরু করলাম।
প্রবল বেগে সিঁড়ি ওঠা শেষ করেই দেখি সিঁড়ির শেষে বিল্ডিং–এ ঢোকার মুখে কল্যাপসিব্ল গেটটা প্রায় পুরোটাই বন্ধ। এক–মানুষ চওড়া ফাঁকটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা – সম্ভবত কোনও রোগীর বাড়ির লোক। তিনি আমাকে অমন উল্কার গতিতে সিঁড়ি চড়তে দেখে বোধহয় খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েই চট্ করে গেট ছেড়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন, আর আমিও আমার দৌড়ন’র গতি না কমিয়ে ওঁর ছেড়ে দেওয়া গেটের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে সেই গতিতেই ভিতরে ঢুকে আরও সাত–আট পা গিয়ে আমাদের অফিসের দরজায় লাগানো তালায় চাবি ঢোকালাম।
চাবি ঘুরিয়ে তালা খোলার আগেই বাইরে থেকে প্রচণ্ড এক শব্দ – যেন কামানের গর্জন! দরজা, জানলা, আলমারি সব থরথর করে কেঁপে উঠল।
প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এল তা হল, ভূমিকম্প নাকি? তারপরে – তখনও ঘটনার আকস্মিকতায় স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি – মনে হল, না, তা নয়। তালা না খুলে চাবিটা বের করে আবার বাইরের দিকে গেলাম। ঘরের বাইরে তখনও সেই মহিলা দাঁড়িয়ে। আমাকে আসতে দেখে ছুটে এসে পায়ের ওপর আছড়ে পড়লেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমি নাকি দেবতা, শুধু ওঁকে বাঁচাতেই স্বর্গ থেকে নেমে এসেছি।
বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে আর কেউ উঠছেও না। কল্যাপসিব্ল গেটের বাইরের চাতালে সাদা সাদা থান ইঁট সাইজের অজস্র কিসের টুকরো পড়ে আছে – এক্ষুনি তো ছিল না! এল কোত্থেকে?
বাইরে বেরিয়ে দেখতে যাব, এমার্জেনসির গাড়ি বারান্দার নিচে দাঁড়ান’ বহু লোক একসঙ্গে হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠল। ততক্ষণে ওয়ার্ড থেকে আরও অনেকে বেরিয়ে এসেছেন – রোগী, তাঁদের বাড়ির লোক, স্টাফ – তাঁরাও আটকালেন। ওপর থেকে ছাদের বিশাল একটা অংশ ভেঙে সিঁড়ির সামনের চাতালে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। পড়েছে কল্যাপসিব্ল গেটটার ঠিক সামনেই। আমি দৌড়ে ঢোকার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। অর্থাৎ এমন হতেই পারত যে আমি যদি বৃষ্টির জন্য না দৌড়তাম, তাহলে ওই বিশাল চাঙড়টা আমার মাথাতেই পড়ত। এবং ওই মহিলা তার কয়েক ফুটের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, সুতরাং বেশিরভাগটাই ওঁর গায়ে লাগত বইকি। আমাকে জায়গা দিতেই উনি ভেতরে ঢুকেছিলেন, এবং সেই জন্যই আমিই ওঁকে বাঁচিয়েছি এ কথা একবাক্যে মেনে নিল সবাই।
এমার্জেনসির নিচের লোকেরা যখন বলল ছাদ থেকে আর কিছু পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না, তখন এক ছুট্টে চাতালে বেরিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে চোখ আড়াল করে যা দেখলাম তাতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়! মেডিক্যাল কলেজের একেবারে ওপরে একটা তিনকোনা ডিজাইন আছে। স্থাপত্যবিদ্যার পরিভাষায় তাকে বলে পেডিমেন্ট। তার একেবারে ওপরের অংশ থেকে প্রায় চল্লিশ–পঞ্চাশ ফুট লম্বা একটা চাঙড় নেই। সেটা এবড়োখেবড়োভাবে ভেঙেছে, কিন্তু ওই দূরত্ব থেকে যা বুঝলাম – সবচেয়ে চওড়া অংশটা প্রায় সাত আট ফুট তো হবেই। যে টুকরোগুলো মাটিতে পড়ে আছে, সেগুলোই প্রায় এক ফুট চওড়া।
সরেজমিনে দেখে আবার ভেতরে ঢুকছি, আর ভাবছি, ফ্যাটিদার গল্পটা প্রায় উলটে গেছিল আর কী! এমন সময় টেলিফোন অপারেটর – যিনি বসেন সামনেই, ডেকে বললেন, “আমাদের কি এই বাড়িতেই মৃত্যু হবে?”
আমি বললাম, “কাজ ছেড়ে তো আর চলে যেতে পারি না।”
উনি বললেন, “সুপারকে ফোন করে জানান। ওনার গাফিলতিতেই তো কোনও কাজ এগোচ্ছে না।”
বললাম, “লাইনটা দিন।”
আমাদের অফিসে গিয়ে সুপারের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। উনি প্রথমেই জানতে চাইলেন কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না। বললাম, না। সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু সন্ধের ওই সময়ে ওই চাতালটায় লোকজন থিকথিক করে। বৃষ্টি হচ্ছিল বলেই তখন কেউ ছিল না। আমি নিজেও অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। উনি বললেন, “তুমি কিচ্ছুটি চিন্তা কোরো না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
দু’মিনিটের মধ্যে ফোন বাজল। অপারেটর। “কী বললেন, সুপার?”
বললাম, “বলেছেন চিন্তা না করতে – উনি দেখছেন।”
অপারেটর নির্লজ্জভাবে বললেন, “জানি। আমি লাইনে শুনেছি। কী দেখলেন জানেন? আপনার সঙ্গে কথা বলেই ওয়ার্ড–মাস্টারকে ফোন করে বললেন, এক্ষুনি সব পরিষ্কার করে দাও। কাল সকাল অবধি যেন কিচ্ছু না থাকে।”
আমি বললাম, “এক কাজ করুন। স্যারকে ফোন করুন। না, স্যার না। শশীদার বাড়িতে লাইনটা দিন।”
শশীদা জুনিয়র টিচার। লেকচারার হতে আর বাকি নেই। সব শুনল। বলল, “কাল সকালে দেখছি।”
পরদিন সকালে যখন কাজে ঢুকছি, দেখি ছাদের ভাঙা টুকরো আর সিঁড়ির চাতালে একটাও নেই। সব ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সুইপারেরও তো সুপারের মতোই সরকারি চাকরি, তাই সারা চাতালে আর সিঁড়িতে নানা জায়গায় সাদা সাদা চুনের দাগ লেপা রয়েছে। শশীদা এসে দেখলেন। সব চেয়ে বড়ো সাক্ষী তো পেডিমেন্টের ওপরের অংশের ওই ভাঙা জায়গাটা। ওটা তো ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা যায়নি। শশীদা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের সব সিনিয়র ডাক্তারকে ফোন করে বললেন কী হয়েছে। “আমার হাউস–স্টাফের মাথা যদি পড়ত… ইত্যাদি…” তারপরে আমাকে নিয়ে গেলেন রেডিওলজির হেড–এর কাছে। উনি তখন অ্যাসোসিয়েশনের পাকা মাথা। সব শুনলেন। বিশেষত সুপারের কাণ্ড। ফিরে এলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টে। সুনয়ন, সুনীপা আর জবাকে বললাম, “আজকের দিনটা মনে রাখিস। মেডিক্যাল কলেজ নতুন করে তৈরি হলে ভুলিস না – এর পেছনে আমারও অবদান ছিল।”
“ঈঈঈঈ আর কী,” বলল সুনয়ন। “মার্বেলের ভিত্তিপ্রস্তর বানিয়ে তোমার নাম লিখে রাখা হবে।”
“তা হবে না,” হিংসুটে সুনয়নকে আস্বস্ত করলাম। “ওখানে যতীন চক্কোত্তির নাম লেখা থাকবে। তাই তো বলছি – মনে রাখিস।”
খানিক বাদে শশীদা বুক ফুলিয়ে ফিরে এল। “বলে দেওয়া হয়েছে আর সহ্য করা হবে না। সুপারকে একমাসের টাইম দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের পেশেন্টদের গ্রিন বিল্ডিং–এ সরানোর কাজ শুরু না হলে অ্যাসোসিয়েশনের সব ডাক্তার স্ট্রাইক করবে। আমাদের রাইটার্স–ও সমঝে চলে। এবার কাজ হবেই হবে।”
একমাসে হয়নি। তিনমাস পরে মেডিক্যাল কলেজের হাল ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছিল। সে আর এক গল্প।
পূর্বশ্রুত / পূর্বপঠিত, তবু পুনরায় জানতে পেরে দারুণ লাগল! ??
এই ঘটনাটা ১৯৮৭ সালের। লেখায় সেটা প্রকাশ হয়নি। তার জন্য আমি দুঃখিত।