আজ অফিস থেকে ফিরেই কারও সাথে কথা না বলে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো স্নিগ্ধা। পেট উগড়ে বমি বেরিয়ে এলো। চোখে মুখে একটা চাপা স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ! খুব ঘেমে গেছে ও, বুকের কাছে কিছু একটা যেন চেপে ধরেছে! শ্বাস নিতে গিয়েও অল্প কষ্ট হচ্ছে! একটু চোখে মুখে ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে দিল! বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মাকে বলে দিলো-এখন আর কিছু খাবে না, একটু রেস্ট নিয়ে তারপর উঠে খাবে!
বলেই সটান নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। চোখে জল আসছিল ওর! রাগে, দুঃখে, কষ্টে! নতুন অফিসে জয়েন করার পর থেকেই একটা সমস্যা শুরু হয়েছিল, আজ একটু বাজে ভাবেই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কলিগ প্রথম দিন থেকেই ওকে একটু বেশিই কদর করছিল যেন! ব্যাপারটা ও আঁচ করতে পারলেও প্রথম প্রথম খুব একটা মনে করেনি কিছু। নতুন অফিস, চাকরিতেও খুব বেশিদিন হয় নি, তাই শুরুতেই ঝামেলাতে জড়াতে চাইছিল না! কিন্তু উনি জোর করেই ঘনিষ্ঠ হতে চাইছিলেন! আজ অফিসে জেরক্স মেশিনের ছোট ঘরটায় ও ব্যস্ত ছিল! তখন হুট করে এসে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। একটা ফাইল নেওয়ার অছিলায় ওর হাতের সাথে ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে ফেললেন! তারপর পেছন থেকেই বুকের কাছে একটা হাতের স্পর্শ, নাড়াচাড়া করছিল! জোরে এক ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল স্নিগ্ধা।
উপরের ঘটনা যে কাল্পনিক এক গল্পগাথা, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই! এইরকম অবাঞ্ছিত শারীরিক স্পর্শ বা যৌন হেনস্থা আকছার আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে!
সম্প্রতি #MeToo, #TimesUp আন্দোলনের ঢেউ হলিউড থেকে বলিউড সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে, স্ট্যান্ডআপ কমেডি থেকে সংসদের অধিবেশন, খেলার জগৎ থেকে বিজ্ঞানী মহল সমস্ত জায়াগাতেই উপচে পড়া যৌন হেনস্থার কথা সদম্ভে ঘোষণা করে, ভীত নাড়িয়ে দেয় তথাকথিত ‘মেল ইগো’র, লুকিয়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিকতার! তা যে শুধু শুধুমাত্র অফিস বা কাজের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ এরকমও নয় ! রাস্তায় চলাফেরা করার সময়, ঘরের ভেতর, রোজকার সংসারে ঘরে বাইরে এই যৌন হেনস্থার ছাপ সুদূররপ্রসারী!
মানসিক স্বাস্থ্য ও যৌন হেনস্থার মধ্যেকার সম্পর্ক কতখানি গুরুতর তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার আগে যৌন-হেনস্থা কী, কীভাবে ঘটে এই সমাজে, তা কতদূর ছড়িয়ে রয়েছে- তা একটু বুঝে নেওয়া দরকার!
আমেরিকা,ইউরোপ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সার্ভে করে করে দেখা গেছে যৌন হেনস্থার পরিমাণ সমস্যাজনক ভাবেই যথেষ্ট বেশি! সেক্ষেত্রে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই যৌন হেনস্থায় আক্রান্ত হবার পরিমাণ মোটামুটি ভাবে ৪০-৭৫%। আমেরিকাতে প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে ১ জন নিজের জীবনে কোনও না কোনও ভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন!
যৌন হেনস্থা কী??
যৌন হেনস্থা কী এবং তাকে দেখার এবং বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা যে কোনও পরিসরে একটা দূর অবধি আলোচনা সাপেক্ষ! তা নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষটির উপর, তার অবস্থানের উপর, তার নিজের ধ্যানধারণার উপর!
মোটামুটিভাবে দেখা যায় ১৯৭০ এর দশক থেকেই আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে sexual harassment বা যৌন হেনস্থা- এই টার্ম বা শব্দবন্ধটি জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে!
সক্রিয় আইন কর্মী ও সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট Catharine Mackinnon তাঁর বই The Sexual Harassment of Working Women (1979) প্রথম এই শব্দবন্ধটিকে ব্যবহার করলেন আইনি ভঙ্গিতে! অবশ্য তারও আগে ১৯৭২ সালে টরোন্টোতে The Globe and Mail পত্রিকায় sexual harassment কথাটি ব্যবহার করা হয়! ১৯৭৩ সালে Mary Rowe যিনি ছিলেন Massachusetts Institute of Technology (MIT)-র নারী সংক্রান্ত কাজের আচার্য, তিনি প্রথম কাজের জায়গায় নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক আচরণকে সমস্যাজনক হিসেবে শনাক্ত করতে শুরু করেন এবং যৌন হেনস্থা এই শব্দটি ব্যবহার করে লড়াই শুরু করলেন! পরবর্তীকালে সামাজিক কর্মী Lin Farley, Susan Meyer এবং Karen Sauvigne এঁরা Working Women United এই নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে আরও বিপুলভাবে কাজ শুরু করেন, বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণবিরোধী সংগঠনগুলোর সাথে কথাবার্তা বলা শুরু করেন!
জনসাধারণের মধ্যে তার একটা পরিচিতি তৈরি হয়!
১৯৭৯ তে Mackinnon তাঁর পূর্ব উল্লেখিত বইতে পাকাপকি ভাবে Sexual Harassment শব্দটিকে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং তার আইনি দিক নিয়ে আলোচনা শুরু হল!
যৌন হেনস্থা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি এবং তার ব্যপ্তি কতটা, তা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে! এবং বিগত ৫০ বছরের সামাজিক এবং নারীবাদী আন্দোলনের জেরে তার বিভিন্ন দিকও উন্মোচিত হচ্ছে!
বর্তমানে সংযুক্ত আমেরিকা দেশে Equal Employment Opportunity Commission (EEOC)-এর নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী–কাজের জায়গায় অবাঞ্ছিত (unwelcome) যৌন আচরণ, যৌন সুবিধার জন্য অনুরোধ এবং কোনওরকম মৌখিক(verbal) বা শারীরিক ব্যবহার যার মধ্যে যৌনতার ছাপ রয়েছে-
(১) সেই অনাকাঙ্খিত যৌন কাজের জন্যে তাকে বাধ্য করা,
(২) তাকে কাজ থেকে বিতাড়িত করার ভয় দেখানো,
(৩) তার কাজের জায়গায় নিজের যে দক্ষতা ও ক্ষমতা নিয়ে কাজ করার কথা তা তা নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত হওয়া!
উপরের (১) এবং (২) কে বলা হয় quid pro quo অর্থাৎ এটার বদলে ওটা, অভিযুক্তের আরোপিত যৌনতা সংক্রান্ত কাজে বা সংলাপে অংশগ্রহণ না করলে, কাঙ্ক্ষিত কোনও কাজ দেওয়া হবে না!
আর (৩) নং হল কোনও প্রতিষ্ঠানে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়ার দরুন যৌন হেনস্থার পরিমাণ বাড়া এবং তা জানা সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনও হস্তক্ষেপ না করায় খারাপ কাজের পরিবেশ বজায় থাকা!
এখানে কিন্তু ‘অবাঞ্ছিত আচরণ’ শব্দটি আলোচনার দাবি রাখে। অবাঞ্ছিত মানে কিন্তু “অনিচ্ছাকৃত” নয়। এখানে একজন ব্যক্তি কিছু কাজে বাধ্য হয়ে সম্মতি দিতেই পারেন এবং প্রাথমিক ভাবে সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নিতে বাধ্য হতেই পারেন যদিও তা অপমানকর এবং আপত্তিজনক। তার মানে এই নয় যে তা কাঙ্খিত ছিল তাঁর কাছে! তাই যখনই কোনও ব্যক্তি নিজের অনুভূতিতে কোনও যৌন মূলক ঘটনাকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করবেন, তাকে সবার আগে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ বলেই ধরে নিতে হবে! এখানে সাব্জেক্টিভ বা বিষয়গত অনুভুতি ও চিন্তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়! তা আসতে পারে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন রূপে!
বিভিন্ন দেশে আইনিগত ও সামজিক বোঝাপড়ার দিক থেকেও যৌন হেনস্থা বিভিন্ন রকমের। আমাদের দেশে যৌন হেনস্থা আর ইভ টিজিং একই অর্থে ব্যবহৃত হয়! সেখানে যৌন হেনস্থা ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ১৪ অনুযায়ী একজন নারীর লিঙ্গ সাম্যতা নিয়ে যে মৌলিক অধিকার তা লঙ্ঘন করে এবং আর্টিকেল ২১ অনুযায়ী মানুষ হিসেবে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘিত করে!
১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট কাজের জায়গায় যৌন হেনস্থাকে সংজ্ঞায়িত করেন- যা বিখ্যাত হয় ‘বিশাখা জাজমেন্ট’! প্রায় ১৬ বছর পরে এই বিশাখা গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে আমাদের দেশে একটি আইন রূপায়িত হয় যা হল-‘The Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013 অনুযায়ী নিচের যে কোনও উল্লিখিত কাজ বা ব্যবহার যা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কারও উপর করা হয়েছে অবাঞ্ছিত উপায়ে, তা যৌন হেনস্থার সামিল–
- শারীরিক ভাবে ছোঁয়া
- যৌন ব্যবহারের জন্যে জোর করা বা বার বার অনুরোধ করা!
- যৌন বিদ্রূপাত্মক কোনও মন্তব্য করা
- জোর করে বা না জানিয়ে পর্ণোগ্রাফি দেখানো
- যেকোনো রকমের অবাঞ্ছিত বা অনাকাঙ্খিত যৌনতামূলক আচরণ।
যৌন হেনস্থার মধ্যে যা পড়ে-
মৌখিক (verbal)
- যৌন সম্পর্কের জন্যে অনিচ্ছাকৃত বলতে থাকা,
- অবাঞ্ছিত টেক্সট, মেসেজ বা চিঠি, ফোনে কথা বলা,
- ডেটে যাওয়ার জন্যে জোর করা!
- কোনও প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাকে বাচ্চা বা কোনও অসম্মানসূচক নামে ডাকা।
শারীরিক (physical)
- ইচ্ছে করে শরীরের কোনও অংশ স্পর্শ করা, ঝুঁকে পড়া, চিমটি কাটা।
- রেপ(Rape) বা কোনও রকম যৌন আক্রমণ
আচরণগত (Behavioural)
- যে কোনরকম আকার-ইঙ্গিত ব্যবহার, যৌন আচরণ,যা অপরজনকে হেনস্থা করে,
- সামনের জনকে উপর থেকে নিচ অবধি দেখা, যাকে ‘এলিভেটর আই; (Elevator Eye) বলে,
- সিটি মারা যেকোনো যৌন মন্তব্য করা,
- কাজের বিষয়ের মধ্যে বার বার ইচ্ছে করে যৌন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে থাকা!
কোন ক্ষেত্রে, কোন পরিসরে এই যৌন হেনস্তা হতে পারে তাও এক বড় বিষয়-
যেকোনো কাজের জায়গায়, বাড়ির ভেতরে, বাড়ির বাইরে, যাতায়াতের পথে, সর্বত্রই এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়! লকডাউনের জন্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। আমেরিকাতে ৭৯% মহিলা ও ২১% পুরুষদের উপর কাজের জায়গায়, ৫১% ক্ষেত্রেই তা কিন্তু তার ঊর্ধ্বতন কর্মী বা সুপারভাইসারের দ্বারা ঘটিত হয়! অপরাধী এ ক্ষেত্রে হতে পারে যে কেউ! কোনও শিক্ষক, কোনও ক্রেতা, কোন সহকর্মী, অভিভাবক, যে কেউ! অপরাধীকে সুনির্দিষ্ট ভাবে অন্য লিঙ্গ (জেন্ডার)-এর হতেই হবে এমন কোনও নিয়মও নেই! এমনও হতে পারে তাকে যে যৌন হেনস্থা করা হচ্ছে সে বুঝেই উঠতে পারল না সে সময়!
আমেরিকান সাইকলজিস্ট Martha Langelan মোটামুটি ভাবে চার রকমের অভিযুক্ত বা Harasser-দের কথা বলেছেন-
১) Predatory Harasser– যৌন রোমাঞ্চ পাওয়ার জন্যে এটি লোকে করে থাকে! যৌনতামূলক কথাবার্তায় কীভাবে সামনের ব্যক্তি কী রকমের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তার অস্বস্তি হচ্ছে নাকি পাল্টা কিছু বলছেক এই ভাবনা থেকে তারা এটা করে! সাধারণত এরাই শারীরিক ভাবে যৌন হেনস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করে থাকে!
২) Dominant Harasser– এই ধরণের অভিযুক্তরা সবচেয়ে বেশি! সে নিজের মজা পেতে এটি করে থাকে!
৩) Strategic or Territorial Harasser- কাজের জায়গায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে, উপরের দিকে নিজের অবস্থান সুনিশ্চিত করতে বা নিজেকে উচ্চতর প্রমাণ করতে এই ধরণের ব্যবহার করে!
৪) Street Harasser– যে কোনও ধরনের পাবলিক প্লেসে অপরিচিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বিক্ষিপ্ত মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া, পথ আটকানো যারা করে থাকে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও যৌনহেনস্থা
এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে যৌন হেনস্থা মানসিক স্বাস্থ্য তো বটেই আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটায়! যেকোনো রকম যৌন হেনস্থার ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী! শেষ ৫০ বছরে সরকারি,বেসরকারি, বিভিন্ন এনজিও সমস্ত দিক থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক স্টাডি করে এটা প্রমাণিত হয় যে, যে কোনও রকমের যৌন হেনস্থা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা ও মানসিক রোগ তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাভাবিকভাবেই মানসিক স্বাস্থ্য বলতে ঠিক কী বুঝি সেটা আমাদের একটু জেনে নেওয়া জরুরি!
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায়- যে স্বাচ্ছন্দ্যশীল অভিপ্রেত অবস্থায় একজন ব্যক্তি নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সঠিকভাবে বুঝতে পারে,জীবনের স্বাভাবিক কোনও স্ট্রেসফুল অর্থাৎ কোনও কঠিন পরিস্থিতিকে সুন্দর ভাবে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, নিজের কাজের জায়গায় ফলপ্রসূ কাজ করতে পারে এবং সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকতে সক্ষম এবং তার মাধ্যমে সামাজিক কোনও অবদান রাখতে পারে!
একথা তাই স্পষ্ট যে খুব সহজে মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না! মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণা অনেক বড় একটা ব্যাপার। শুধু খুশি থাকা মানেই যেমন মানসিক স্বাস্থ্য ভালো এরকম নয়, তেমনি অখুশি থাকা মানেই মানসিক রোগ নয়।
ঠিক একইরকমভাবে মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে! মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা মানেই যে মানসিক রোগ হয়েছে এমনটা নয়! মানসিক রোগ বলতে যা বোঝায় তা হল- আমাদের অনুভুতি, চিন্তন ও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক পরিবর্তন যা সেই ব্যক্তিকে কিম্বা তার আশেপাশের লোকজনের মধ্যে সমস্যা তৈরি করছে, যা তার প্রত্যাশিত সামাজিক, পেশাগত ও অন্যান্য কাজকর্মেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে! এবং মানসিক রোগের সঙ্গে স্ট্রেস (stress–জীবনের কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতি, সঙ্কটমূলক অবস্থা)-এর এক কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে! অর্থাৎ মানসিক রোগকেও বুঝতে হবে সেই ব্যক্তির নিজস্ব সংস্কৃতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর ভিত্তি করে!
তাই যৌন-হেনস্থা এবং মানসিক স্বাস্থ্য অনেক বেশি স্ট্রেস এবং ট্রমার (trauma) সাথে সম্পর্কিত! হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও যৌন হেনস্থা যেমন ক্ষণিকের স্ট্রেস (acute stress)-এর জন্ম দিতে পারে তেমনি দিনের পর দিন ক্রমাগত চলতে থাকা যৌন-হেনস্থা অনেকদিন ধরে চলা স্ট্রেসের (chronic stress)-এর মতোও কাজ করে গভীর মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে!
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর যৌন হেনস্থার প্রভাব
মনে পড়ে যায় সেই বাচ্চা মেয়েটির কথা, যাকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলাম গাইনি ডিপার্টমেন্টে! একটি ১৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে ভর্তি হয়েছে কৃত্রিম গর্ভপাত করানোর জন্যে (MTP-Medical Termination of Pregnancy), অনাকাঙ্ক্ষিত যে প্রেগনেন্সি ওর শরীরে এসছে তাকে নষ্ট করে দেবার জন্যে! বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে জানলাম, ওর ছোট বেলা থেকেই একটু বুদ্ধি কম, যাকে বলে mental retardation বা এখন intellectual disability। বাড়ির লোকের কথা অনুযায়ী ও কিছুই বলতে পারছে না, কেমন জানি একটা হয়ে গেছে! আত্মীয়দের মধ্যেই হয়ত কেউ বলপূর্বক ওর সাথে যৌন-সঙ্গম করেছে, একজনকে ওঁরা সন্দেহ করেছেন- তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম-চলুন আপনার মেয়েকে দেখি।
আমি যখন শেফালির সামনে দাঁড়ালাম- আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারিনি! এরকম ভাবলেশহীন চোখের দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানো যায় না, সাইকিয়াট্রি ইন্টারভিউ মানে কথোপকথন শুরু করা তো পরের ব্যাপার! মনে হচ্ছিল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আমার সমস্ত মানসিক শক্তি শুষে নিচ্ছিল ওর চোখ, যেন আমাকেই প্রশ্ন করছিল বারবার! একটা ১৩ বছরের বাচ্চা যে এখনও জীবনকে বড় হতে দেখে নি, যার নিজের শরীরের আন্দাজ অল্প, ওর সাথে কী ঘটে গিয়েছে তার সম্পর্কে ওর সম্যক কোনও ধারণা নেই, কিন্ত কিছু একটা ঘটে গিয়েছে যার নাগাল ও কিছুতেই পাচ্ছে না, ওর বিধ্বস্ত চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গলা বুজে আসছিল! আমিও হয়ত নার্ভাস ছিলাম জীবনে প্রথমবার একজন রেপ ভিক্টিমের সাথে আমার পেশাগত দিক থেকে যোগাযোগ হল- আমি জানি এই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ ওকে আজীবন বইতে হবে। আমি ফিরে এসেছিলাম এই সমাজের এক রাশ ক্লেদ, দুঃখ যন্ত্রণা ক্ষোভ বয়ে নিয়ে।
যৌন হেনস্থা কীভাবে কার ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলবে তা অনেকটাই সাবজেক্টিভ; মানে সেই ব্যক্তির উপর নিজস্ব অনুভূতির উপর নির্ভরশীল! এবং যেকোনো রকম যৌন-হেনস্থাই আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় যেমন ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও বিভিন্ন সমস্যার সূত্রপাত ঘটে! কার কাছে কীভাবে, কতদিন ধরে, কী পর্যায়ে, কতটা তীব্রতায় এই হেনস্থাগুলো ঘটেছে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি যে কোনও যৌন হেনস্থাই খুব বড় রকম স্ট্রেসের জন্ম দেয়! সোশ্যাল সাইকলজিস্ট Mackinnon’s তার বই The Sexual Harassment of Working Women (1979)-এ যৌন হেনস্থাকে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এক স্ট্রেস হিসেবে দেখিয়েছিলেন! Fitzgerald, Hulin, and Drasgow ১৯৯৪ সালেও তাঁদের আলোচনাতে একে স্ট্রেস বলতে চেয়েছেন!
প্রশ্ন আসে এই স্ট্রেস কী?? স্ট্রেস হল এমন এক মানসিক ও শারীরিক অবস্থা যেখানে কোনও ব্যক্তি মনে করে তার ক্ষমতা ও দক্ষতার দিয়ে এই বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব নয়! এই স্ট্রেস অনেক রকম ভাবে জীবনে থাকতে পারে! যেমন- আর্থিক ভাবে, সম্পর্কগত দিক দিয়ে, পেশাগত দিক দিয়ে, পারিবারিক ঝামেলার দিক দিয়ে। কখনও কখনও এই স্ট্রেস কারও কাছে ট্রমা হয়ে উঠতে পারে! ট্রমা আর স্ট্রেস কিন্তু এক নয়! সহজ ভাষায় ট্রমাকে বলা যেতে পারে আকস্মিক গভীর এক তীব্র স্ট্রেস! ট্রমা এক ভীতিপ্রদ মানসিক আঘাত যা সেই ব্যক্তির কাছে আলাদা রকম তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই যে ঘটনা আমার কাছে ট্রমা হিসেবে আসতে পারে সেই একই ঘটনা অন্য আর একজনের কাছে ট্রমা হিসেবে নাও যেতে পারে! ট্রমা বলতে আমরা যা বুঝি- (১) সরাসরি এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হওয়া যা জীবন মরণের সাথে জড়িত, খুব ভয় পাওয়ানো এক ঘটনা যেখানে মৃত্যু আপনাকে আঁচড় কেটে বেরিয়ে গেছে, প্রচন্ড হিংসা (violence)-এর কোন ঘটনা (বিশেষত যৌন হিংসামূলক বা নির্যাতন), বড় ধরনের কোন শারীরিক অসুখ।
(২) একটা ভয়াবহ কোন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া- চোখের সামনে দেখা এক বিস্ফোরণ, কিম্বা কোনও অ্যাকসিডেন্টে কাউকে চোখের সামনে মর্মান্তিক মারা যেতে দেখা কিম্বা কাউকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখা।
(৩) খুব কাছের কোনও বন্ধুর সাথে ঘটে যাওয়া ট্রমাটিক ঘটনার বিশদ বিবরণ ওর সাথে থাকতে থাকতে জেনে যাওয়া! বার বার সেই ঘটনা শুনে শুনে আক্রান্ত হওয়া বা প্রভাবিত হওয়া! মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে ঘটনাটি অবশ্যই হতে হবে তার কাছে ভীতিপ্রদ এবং দুর্বিষহ।
(৪) কেউ যদি বার বার অন্য কারো সাথে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর ট্রমাটিক ঘটনাটি অনুভব করতে করতে যায়, বার বার সেই ঘটনার পুঙ্খ্যানুপুঙ্খ বিরূপ একটা বিস্তারিত বিবরণ জোগাড় করতে গিয়ে যা হতে পারে। তাই কোন পুলিশ অফিসার বা ডাক্তার বা এন.জি.ও কর্মী যাকে কোনও শিশুর যৌন নির্যাতনের বা বাচ্চাদের পর্নোগ্রাফি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ওই ঘটনার বার বার কোন সম্মুখীন হতে হয়, শুনতে হয় সমস্ত ঘটনাবলীর বিশদ খুঁটিনাটি, ছবি দেখতে হয়, জানতে হয় স্থান কাল পাত্র, কোন মহামারী বা যুদ্ধের পরে যাদের প্রাথমিক ভাবে পরে থাকা জ্বলন্ত, খণ্ড-বিখন্ড পচা-গলা মানুষের দেহ সংগ্রহ করতে হয় তাদের ক্ষেত্রেও তা ট্রমা আকারে আসতে পারে।
অর্থাৎ ট্রমা হল এমন একটা অপ্রত্যাশিত আকস্মিক ভয়াবহ ঘটনা যা সেই ব্যক্তির কাছে প্রচণ্ড ভয়ের ও উদ্বেগের কারণ যার প্রভাব স্বাভাবিক স্ট্রেসের এর চেয়ে অনেকগুণ বেশি! যে কোনো হিংসাত্মক দুর্ঘটনা বা অপরাধ, যুদ্ধ, মিলিটারি আক্রমণ, কিডন্যাপ হওয়া, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী থাকা, যৌন নির্যাতন, শারীরিক আঘাত, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এক অসুখ, একের পর মৃতেদেহ দেখতে থাকা, (যা কোভিডের সময় যে কোনও স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে পারে) সবগুলোই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে কারো কাছে ট্রমা হয়ে উঠতে পারে! এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে পরোক্ষভাবে মানে কিন্তু ঘরে বসে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে টিভি বা ভিডিও বা শুনে এই সব ঘটনা দেখলে বা শুনলে হবে না যতক্ষণ না সেটা আমার আপনার কাজ অর্থাৎ প্রফেশানের সাথে জড়িত হচ্ছে!
যৌন-হেনস্থাও তাই অনেকের কাছে ট্রমা হিসেবে কাজ করতে পারে!
আমেরিকাতে University of Oregon-এর সাইকোলজি প্রফেসর Jennifer Freyd তিন ভাবে ভাগ করেছেন যেকোনো যৌন হেনস্থার পর একজনের অভিজ্ঞতা কেমন হয় তাকে-
(১) Betrayal Trauma- যেখানে একটা ভালো ইতিবাচক সম্পর্কের দিক থেকে হেনস্থা আসে- যেমন অফিসের বস বা খুব ভালো বন্ধু বা ঘনিষ্ঠ কেউ এই ধরণের ব্যবহার করলে, একটা বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা কাজ করে গভীরভাবে!
(২) Betrayal Blindness– এখানে ঘটে যাওয়া এক হেনস্থার ফলে একজন ইচ্ছে করে সেই অনুভুতি থেকে দূরে সরে থাকেন! চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, কাউকে জানতে দেন না! তার জন্যে অনেক অন্যান্য উপায় বের করতে থাকেন, মিথ্যে কথার আশ্রয় নেন! পরবর্তীকালে নিজেই নিজেকে অপরাধী ভেবে কষ্ট পেতে থাকেন!
(৩) Institutional Betrayal– যেসব জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই Strategic বা Territorial Harassers (পূর্বে-বর্ণিত)-এর দ্বারা কেউ যৌন-হেনস্থাতে আক্রান্ত হয়ে মেনে নেয় নিজের নিম্নতর অবস্থাকে, ভাবে নিজের কাজ বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এগুলো মেনে নিতে হবে! এবং সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোও এই পরিস্থিতি টিঁকিয়ে রাখতে সাহায্য করে!
বিগত ২০-৩০ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে একথা সুস্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত যে যৌন-হেনস্থা বিভিন্ন মানসিক রোগের জন্ম দেয়! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টাডি হল Youth Development Study (YDS) যা কিনা ডিপ্রেশানের (Depressive Episode) সাথে সরাসরি সম্পর্কের কথা বলেছে।
ডিপ্রেশানের ফলে সুইসাইড (Suicide) বা আত্মহত্যাও করতে পারেন অনেকে, গভীর এক অপরাধবোধ থেকে নিজের জীবন শেষ করে ফেলার প্রবণতা তৈরি হয়!
ডিপ্রেশান ছাড়াও একজনের ব্যক্তিগত কিম্বা পেশাগত সামাজিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন মানসিক রোগ তৈরি হতে পারে, যেমন Acute Stress Reaction, Adjustment Disorder, ক্রমাগত Panic Attack, Panic Disorder, বিভিন্ন ধরণের সাইকোটিক (Psychotic) রোগ যেমন ATPD (Acute and Transient Psychotic Disorder- অল্প সময় ধরে থাকা Hallucination, Delusion ) অথবা Dissociative (Conversion) Disorder। একটু ছোট বয়সে Reactive Attachment Disorder- বাচ্চারা খুব অল্প কথা বলে, প্রয়োজন পড়লেও সাহায্য চায় না, অথবা Disinhibited Social Engagement Disorder- যেখানে বাচ্চাদের অপরিচিত ব্যক্তিদের সাথে বিনা দ্বিধায় চলে যাওয়ার, বেশি ভাব জমিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায় ।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক হতে পারে PTSD (Post Traumatic Stress Disorder) যা কিনা যৌন-হেনস্থায় আক্রান্ত যে কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে হতে পারে!
PTSD হলে কি কি হয়?
প্রথম কথা যৌন-হেনস্থা ট্রমার মত গুরুতর হলে PTSD হতে পারে, যার সাথে সময়গত ও একরকমের কার্য কারণ সম্পর্ক থাকতেই হবে। অর্থাৎ ওই ঘটনার পরে এবং ওই ঘটনার জন্যেই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে! মোটামুটি রকমভাবে চার ধরনের সিম্পটমগুচ্ছ নিয়ে PTSD হাজির হয়-
(১) জোর করে চলে আসা কিছু চিন্তা
বারবার করে চলে আসা,অনধিকার ভাবে মনের ভিতরে সেই ট্রমাটিক ঘটনার স্মৃতি প্রবেশ করতে শুরু করে, অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই যৌন-হেনস্থার ঘটার দিন, সময়, মুহূর্তগুলো নিজের চিন্তার মধ্যে চলে চলে আসে। অনেকের ক্ষেত্রে স্বপ্নের মধ্যে তা চলে আসতে পারে যা খুবই পীড়াদায়ক !কিম্বা আসতে পারে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো-সেই ঘটনার চিত্রগুলো হুড়মুড় করে চোখের সামনে ভেসে আসা!
(২) যৌন-হেনস্থা সম্পর্কিত সমস্ত কিছুকে এড়িয়ে চলা
যৌন-হেনস্থার মত ট্রমাটিক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত যে স্থান, কোনও জিনিস, সেই ব্যক্তি অভিযুক্ত ব্যক্তি, কোন রকমের কথাবার্তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা।
(৩) চিন্তাভাবনার ধরণে ও অনুভূতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন
ওই ঘটনার জন্যে নিজেকে দায়ী করতে থাকা। সারাক্ষণ নেতিবাচক ইমোশান- অপরাধবোধ ভয় রাগের মধ্যে ডুবে থাকা।
“আমিই আসলে খারাপ। আমি ঠিক থাকলে ওই ঘটনা ঘটত না আমার সাথে। আমার শরীর নষ্ট হয়ে গেছে, আর কাউকে বিশ্বাস করব না!” এই কথা গুলো বলতে থাকা
ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস বেমালুম ভুলে যাওয়া (Psychological Amnesia- মনে না করতে পারা)। আনন্দ ফুর্তি-ভাব কমে যাওয়া, আসেপাশের লোকজনের সাথে আলাদা হয়ে যাওয়া সমস্ত কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা!
(৪) উদ্দীপনায় অতিরিক্ত সাড়া দেওয়া ও চমকে ওঠার প্রবণতা
মনোযোগ দিতে না পারা। খুব খিটখিটে হয়ে থাকা, রাগ দেখানো! খুব বেশি পরিমাণে হঠাৎ করে চমকে ওঠার প্রবণতা। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠা। হঠাৎ করে মোবাইলে কল এলে রিংটোন শুনে ঘাবড়ে ওঠা! সবসময় অতিরিক্ত ভাবে সতর্ক হয়ে থাকা। নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করা।ঘুমের সমস্যা শুরু হওয়া।
এই সমস্যাগুলো কম-বেশি একমাসের বেশি দিন থাকে এবং সামাজিক ভাবে, নিজের কাজের জায়গা্ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কী কী করণীয়??
যৌন-হেনস্তার বিরুদ্ধে আমরা দুভাবে ব্যবস্থা নিতে পারি।
এক, যৌন-হেনস্থায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো।
দুই, যৌন-হেনস্থা বন্ধ করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
পরিস্থিতি আমেরিকা থেকে ইউরোপ বিভিন্ন দেশেই একটু হলেও পরিবর্তনশীল!
সাইকোলজিস্ট Kim Elsesser তাঁর বই Sex and the Office: Women, Men and the Sex Partition That’s Dividing the Workplace-এ স্পষ্টতই বলেছেন এখানে এখন আর কেউ চুপ থাকছেন না! আমাদের দেশে এটা নিয়ে এখনও সমস্ত জায়গায় সবাই সরব না হলেও কিছু কিছু জায়গায় বেশ জোরালো আওয়াজ উঠছে।
এক যৌন-হেনস্তায় আক্রান্ত ব্যাক্তির কী করা উচিত?
- মান্যতা দেওয়া- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যা ঘটেছে তাকে মান্যতা দিয়ে স্বীকার করা ও যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারা। যৌন-হেনস্তার পর নিজের অনুভুতিগুলোকে লুকিয়ে না রেখে অনুভব করার চেষ্টা করা, খুব সহজভাবে কাউকে শেয়ার করা গেলে সেগুলোকে বলে ফেলা!
- লেখালিখি করা– নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে- যদি প্রথম দিকে নাও কাউকে বলে উঠতে পারি তাহলে নিজের কষ্ট বা যাবতীয় অনুভুতিগুলিকে যত্ন করে লিখে ফেলা! তাতে নিজের মনের বোঝা অনেক কম হয়!
- জিরো টলারেন্স টু ফিজিকাল সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট– যদি কোনওরকমের শারীরিক ভাবে যৌন-হেনস্থা হয়, তাহলে বন্ধুদের জানিয়ে কমপ্লেন্ট কমিটিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট করা!
- নিজেকে দোষী ভাবা বন্ধ করা– প্রায়শই আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে দোষী ভাবতে থাকেন- কেন আমি ওই ড্রেসটা সেদিন পরেছিলাম, কেন আমি সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম, আমারই দোষ! এই অনুভুতি খুব মনে আসতে থাকে, তাকে যতদূর সম্ভব গুরত্বহীন করে রাখা! নিজেকে দোষী ভাবা আসলে অপরাধীর হাত শক্ত করে।
- অন্যদের অভিজ্ঞতা শোনা– প্রয়োজনে যারা এই রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তাদের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া!
- পেশাদার মনোবিদ বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া- খুব অস্বাভাবিক রকমের তীব্র অনুভূতির আঘাত আসতে থাকলে, কাজেকর্মে অসুবিধা হলে, নিয়মিত ঘুমের ব্যঘাত ঘটতে থাকলে কোনওরকম দ্বিধা না রেখে মনোবিদ বা যেকোনো রকম মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া উচিত!
একজন ভিক্টিমকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।
যৌন হেনস্থায় আক্রান্ত এক ব্যাক্তির সাথে অত্যন্ত সহানুভূতি সহকারে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতে হবে।ঠিক কোন কোন জায়গায় অসুবিধা হচ্ছে সেগুলো অনেক সময় দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি!
- তাদের কে বিচার না করা- কোনওভাবেই যেন আমাদের কথাবার্তার মধ্যে উল্টোদিকের ব্যক্তিকে সংশয়ের আঁচ না থাকে!আমরা যেন জাজ না করতে বসি!
- নিয়মিত যোগাযোগ রাখা- যেকোনো ভাবে খুব অল্প হলেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা! এতে তাদের নিজেদের অপাংক্তেয় মনে হওয়া হ্রাস পায়!
- তাদের সিধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া- ভিক্টিমের নিজস্ব সিদ্ধান্তকে সব সময় গুরুত্ব দেওয়া। এবং তাদের সিদ্ধান্তই যেন সব শেষে অগ্রাধিকার পায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া!
- ভিক্টিমকে স্পেস দেওয়া- যৌন হেনস্থায় আক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তিই এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় তাই তাদেরকে নতুনভাবে গুছিয়ে ওঠার সময় ও সুযোগ করে দেওয়া, তাদের নিজস্ব ব্যক্তি- সীমানার মর্যাদা আমাদের দিতেই হবে!
- Psychological Power Play বন্ধ করা- অনেক সময়ই দেখা যায় যিনি যৌন-হেনস্থা করেছেন, তিনি নিজে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার জায়গা থেকে ভিক্টিমকে মানসিক ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন কিম্বা ব্ল্যাকমেল করছেন ভিক্টিমের সাথে যাতে সে কিছু না বলে কাউকে বা প্রকাশ্যে না চলে আসে ঘটনাটা। একে বলে Psychological Power Play। ভিক্টিমের পক্ষ নিয়ে এই সাইকোলজিকাল পাওয়ার প্লে বন্ধ করতে হবে!
- আত্মহত্যা থেকে ভিক্টিমকে বাঁচানো- অনেকসময় আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারেন, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে তার সেই প্রবণতা বোঝার চেষ্টা করা, দরকারে মানসিক স্বাস্থ্যে পেশাদার লোকজনের সাহায্য নেওয়া!
- তাদের নিজস্ব স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা- তাদেরকে ধীরে ধীরে নিজেদের কাজের জীবনে ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেওয়া।জীবনের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্মে ক্রমাগত উৎসাহ দিতে থাকা!
- আইন এবং তার প্রয়োগ- আগেই বলেছি ২০১৩ তে আমাদের দেশে THE SEXUAL HARASSMENT OF WOMEN AT WORKPLACE (PREVENTION, PROHIBITION AND REDRESSAL) ACT, 2013 আইন সঠিক ভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে যৌন-হেনস্তা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চলছে। এই আইন অনুযায়ী ইন্টারনাল কমপ্লেন্ট কমিটি বা লোকাল কমপ্লেন্ট কমিটি তৈরির পরামর্শ দেওয়া রয়েছে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে! কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন কতটা ফলপ্রসূ তা বিতর্ক সাপেক্ষ!
শেফালি বা স্নিগ্ধার শেষ পরিণতি কী হয়েছে আমরা জানি না! হয়ত আন্দাজ করতে পারি খানিকটা, ঠিক বা ভুল!এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতার আস্ফালন কাজ করে ঘরে-বাইরে সর্বত্র! যৌন-হেনস্থার বোঝা সমাজে এবং প্রত্যেকের জীবনে এতটাই গভীর যে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য! যে কোনও রকমের যৌন-হেনস্থাই স্ট্রেস বা ট্রমা রূপে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে পারে! মানসিক সমস্যা তৈরি হলে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করুন, যৌন-হেনস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন,! প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আইনকে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করার সুযোগ করে দিন। সবশেষে যিনি যৌন-হেনস্থার শিকার তাকে বিনা-বাক্যে বিশ্বাস করুন, নতুন জীবনের ভরসা দিন, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন, তাকে একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দেবেন না! আপনি যতটা আপনার প্রিয়জনের সাথে থাকবেন উনি তত তাড়াতাড়ি ওঁর হারানো জগৎ ফিরে পাবেন।