বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই লেখাটি আপনি স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন। এর মধ্যে কোন বিশেষ ‘আনন্দদায়ক’ কথা লেখা নেই। আমি প্রেমের গল্প অথবা টানটান রোমহর্ষক গল্প ফেঁদেও বসিনি।
কেবল ইতিহাসের একটু কচকচানি। আর লেখার দৈর্ঘ্যও বেশ বড়। সবচেয়ে বড় কথা, আমি অন্তত জানি আমার লেখা খুব সুপাঠ্য কিছু নয়।
সুতরাং…
ধুর আপনাদের আর কিছুই বলবো না! সবকিছুই অবিশ্বাস করেন। ভাবেন আমি বুঝি সব কিছুতেই মিথ্যা বলছি। আসলে আপনারাই অবিশ্বাসীর দল।
আচ্ছা, আমায় না হয় বিশ্বাস করেন না, কিন্তু Tuhin কে তো করেন? ও কখনোই মিথ্যা বলেনা। সবাই জানে, ও রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল।
আচ্ছা যদি বলি সত্যি না, স্বপ্ন দেখেছি। তাহলেও বলবেন ঢপ। অথচ এমন স্বপ্ন দেখতে কে না ভালবাসে?
শুনবেন সেই স্বপ্নের গল্পটা, তাহলে শুনুন।
মাঠটা জুড়ে একটা বিশাল সামিয়ানা টাঙানো। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাম পাশে পর পর, যারা রক্ত দান করতে এসেছেন, তারা বসে আছেন। তারপর একটা লম্বা টেবিলে রক্তদাতাদের ইন্টারভিউ চলছে। চলছে নাম, ঠিকানা, বয়স, রক্তচাপ মিলিয়ে পরপর নাম নথিভুক্তিকরণের কাজ। এনারা সকলে রক্ত দেবেন। ডান দিক-বাঁ দিক মিলিয়ে গোটা কুড়ি ফোল্ডিং খাট, রক্ত দান চলছে।
এতোক্ষণ এক টানা চর্কির মতো ঘুরছি, কারো মুখের দিকে তাকাবার ফুরসত পাইনি।
অবসর পেতেই চারদিকে তাকিয়ে দেখি, লোকলস্কর সবাই তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আমার আর এখানে না থাকলেও চলে। সন্তু আর তোপসেকে দেখলাম জল আর সরবতের গ্লাস নিয়ে ঘুরছে। দূরে অর্জুন আর গোগলকেও লক্ষ্য করলাম। সন্তু বললো, “কাকাবাবুও এসেছে, ওপাসে চলে যাও, সব্বাই আছে। গল্প করছে। তোমাকে খুঁজছিল।”
আমিও ওদের সাবধানে কাজ কর বলে একটু বড়োদের খোঁজে সামনে এগিয়ে গেলাম।
আরেকটা পর্দা পেরোলেই বেশ একটা বড়ো জায়গা, বৈঠকখানার মতো করে করা, খাট, চেয়ারে ভর্তি।
ওখানে গিয়ে দেখি সে এক মেলা বসেছে। কে নেই সেখানে? চা-সিগারেট তো আছেই, সঙ্গে তুমুল আড্ডা চলছে।
আমি যেতেই, প্যালারাম বলে ওঠলো “এই তো এতোক্ষণ তোমাকেই মিস করছিলাম। শিগগিরি বসে পরো।” প্যালারামকে একটু মৃদু ধমকে বললাম, “তুই বাবা, এই বড়োদের মধ্যে কেন বসে আছিস? ওদিকে, বেচারা তোপসে, সন্তু কাজ করে মরছে। তোর অর্জুনদা, এমন কি বাচ্চা গোগলটা পর্যন্ত কাজ করছে। ওদের একটু সাহায্য কর গে। আর ক্যাবলা, হাবুলকেও নিয়ে যাস।”
“আজ, ওদের ছেড়ে দাও। আমাদের স্বেচ্ছায় রক্তদান এবং ওদের স্বেচ্ছায় শ্রমদান।”
এ কথার কোন জবাব হয় না, গলাটা চেনা চেনা লাগাতে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, হ্যাঁ, স্বয়ং তিনি, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আরে ঘনাদা। তিনি দেখি তার প্রিয় আমারকেদারায় শুয়ে আছেন। পারেও বটে!! আরামকেদারাটাও বয়ে এনেছে।
সিধু জ্যাঠা সাধারণত কোথাও যান না, নিজের ঘরেই বসে থাকেন, কিন্তু আজ আমার অনুরোধ রক্ষা না করে পারেননি। ওপাশে তারিণী খুড়োতো হাজির থাকবেনই জানাই ছিল। দুজন দেখি পাশাপাশি বসে আছেন, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। এক সাথে বলে উঠলেন, “আরে, আমরা তোমার কথাই বলছিলাম। তুমি আজ যে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছো, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই গরমে জেলায় জেলায় প্রচন্ড রক্ত সংকট। খুব দরকার ছিল এটার। আমরা রক্ত দান নিয়েই আলোচনা করছিলাম। আমাদের মধ্যে আর কবে সচেতনতা আসবে?”
কাকাবাবু বলে উঠলেন “সম্ভবত কোন দিনই না, আমরা কথা বলি বেশী , কাজের সময় আগে পালানোর কথা ভাবি। কিন্তু তাও আমি আশাবাদী।”
কিরীটি বললেন, “ঠিকই আমাদের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে সময় লাগে না। খুন করতে হাত কাঁপে না, ধর্ষণ আজ শুধুই খেলা, শেষের দিক থেকে দেশের মধ্যে সবচেয়ে উপরে, কিন্তু একফোঁটা রক্ত দিতে বললে বীরত্ব বেরিয়ে যায়।” আরিব্বাস, ভাবিই নি, ওনার পদধূলি পরবে।
কর্ণেল সায় দিয়ে বলে উঠলেন, “পৃথিবীর ইতিহাস তো কেবল রক্তের ইতিহাস। অসভ্যতার ইতিহাস।
রক্ত ক্ষরণের ইতিহাস। ছেলে-বাবাকে, ভাই-ভাইকে, একরাজ্য আরেক রাজ্যকে রক্তাক্ত করেছে। জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে আমরা বীরত্বের গাথা তৈরী করেছি, পূজা করেছি।”
“অথচ আমাদের দেশে প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরী হয়েছিল এই কলকাতাতেই, ১৯৪২ সালে, অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হেল্থ এন্ড হাইজিনে, যা আসলে রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে ছিল।” বললেন প্রফেসর শঙ্কু। লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল আমার। উনি, উনিও এসেছেন! সেই গিরিডি থেকে!! ভাবতেই শিউরে উঠলাম। বোধহয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেই, আবার বলে উঠলেন, “আমি, টাটাতে থাকলেও আসতাম, না এসে পারতাম না”।
ঘনাদা আবার বলতে শুরু করলো, “আমাদের দেশে আজও রক্ত দান নিয়ে সেরকম সচেতনতা গড়ে উঠলো না। অথচ, ইয়োরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমার চোখের সামনে, পুরুষদের কথা ছেড়ে দাও, কত মহিলা রক্ত দান করেছেন, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আর মেয়েরা এগিয়ে এসেছিল বলেই রেডক্রস সোসাইটি তাদের কাজ শেষ করতে পেরেছিল। অবশ্য কেন মেয়েরা এগিয়ে এসেছিল, কে তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল…”
‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটা শুনলেই আমার আবার কেমন মাথা ঘোরে, শ্বাসকষ্ট হয়, আর ঘনাদা এখন গল্প কোন ছোট্ট দ্বীপের ঘেরাটোপ থেকে কোথায় নিয়ে হাজির করবেন, তার ঠিক নেই। সেই ভয়েই আমি খানিকটা হুড়মুড় করে বাধা দিয়ে বললাম “সেটা খুব সত্যি কথা, কিন্তু পুরো গল্পটা পরে আমরা বনমালী নস্করের মেসে গিয়ে শুনবো, আজ না।” ঘনাদা একটু ক্ষুন্ন হলেও আমাকে কিছু বলতে সাহস করলো না।
টেনিদা সাধারণত কাউকে কথা বলতে দেয় না, কিন্তু আজ হঠাৎ বলে উঠলো, “আজ তোমার মুখে এই রক্তদানের ইতিহাসটা শুনবো আমরা। প্লিজ, না বোলো না।”
সবাই জানেন গল্প বলতে আমি ভালোই বাসি, কিন্তু, সিধু জ্যাঠা, তারিণী খুড়ো, কাকাবাবু, কিরীটি, কর্ণেল, কিকিরা সবার সামনে কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। তাই বাধ্য হয়ে বললাম,
“আপনারা থাকতে আমি কেন? আর তাছাড়া আমি ঠিক গুছিয়ে গল্প করতে পারিনা, খাপছাড়া আগুপিছু হয়ে যায়।”
সিধু জ্যাঠাই শেষে বলে দিলেন, “তাও, তুমিই বলো, আমাদের মুখে গল্প তো ওরা যখন-তখনই শুনতে পারে, তোমাকে তো আর রোজরোজ পাওয়া যায় না। ওরে টেনিরাম, যা একবার, ছোট গুলোকে ডাক, ওদের শোনাটা খুব জরুরী। রক্ত দান সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মকে উৎসাহিত করে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। ওদের তো বেশী করে শোনা উচিত।”
ডাকতে আর হলো না, দেখি সবকটা, একসাথে পর্দার এপারে এসে উপস্থিত হল, যাকে বলে রীতিমতো অনুপ্রবেশ।
তারপর, এক সাথে চিৎকার করে উঠল, “ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক ইয়াক!!”
ভয় পেয়ে গেলাম, এইরে! বাকি যারা রক্ত দিতে এসেছে, তারা আবার ভয় পেয়ে না পালায়! অবশ্য এই ডাকের সাথে অপরিচিত বাঙালি আর কে ই বা থাকতে পারে। তাও আমি বলে উঠলাম, “পুদিচ্চেরি”।
সিধু জ্যাঠার অনুরোধ, অতএব শুরু করতে হবে।
“রক্ত দান সম্বন্ধে বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। স্থান, কাল, পাত্রের পরিবর্তন করে পিছিয়ে যেতে হবে পাঁচশো বছরের একটু বেশী সময়। সময়, ১৪৯২ সাল। স্থান, রোম আর পাত্র, পোপ ইনোসেন্ট VIII. তোমরা কি জানো, মানুষের শরীরে রক্ত দেবার চিন্তা মানুষের মনে হয়েছিল, সংবহন তন্ত্র আবিষ্কারের আগেই। হ্যাঁ, এই ১৪৯২ সালে। আর সেই চেষ্টাটা হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। কেউ জানো কি হয়েছিল?”
সবচেয়ে ছোট গোগল বলে উঠলো, “শিরার বদলে ধমনীতে?”
“ভেবেছিস খুব ভালো, কিন্তু সেটা না। অন্য ভাবে”।
অবধারিত ভাবে হাবুল উঠে দাঁড়িয়ে, অবলীলায় বলে দিল “তবে ক্যমনে করলো, ওউগ্গা কি সারা গায়ে রক্ত ঘইস্যা ঘইস্যা বেবাক দিসিলো?”
ভাগ্যিস কিকিরা বলে উঠলো, “হাবলা, তুই এবার চুপ না করলে, টেনির বদলে আমিই তোর নাক কিন্তু নাসিকে পাঠিয়ে দেব।” তা না হলে এই উত্তর শুনে একজনের মুখের যা অবস্থা হয়েছিল, তা বলার নয়।
“জানো না তো? মুখ দিয়ে।”
এই উত্তর শুনেও আবারো, সবার চোয়াল ঝুলে পরলো, আর বিচিত্র রকমের “অ্যাঁ” শব্দে এক অদ্ভুত কোলাহলের সৃষ্টি হল।
“হ্যাঁ, ঠিকই শুনছো, মুখ দিয়ে।
অদ্ভুত মনে হলেও মুখ দিয়েই রক্ত দেবার চেষ্টা করা হয়, যদিও জানা যায় দাতা এবং গ্রহীতা দুজনেই তাতে মারা যান, তবুও ভেবে দেখ, প্রথম রক্ত দান এবং রক্তগ্রহণ । যদিও সেই ঘটনার সত্যতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।”
“মুখ দিয়ে? ইশ্ পাগল ছিল নাকি?” জোজো বলে উঠলো।
“হ্যাঁ, মুখ দিয়ে।
কেন পাগল কেন? তবে শোন, রক্ত পানের ইতিহাস তো আজকের নয়, বরং এই ট্রেডিশন অনেক পুরোনো। তুই ভেবে দেখ ভীম সেই কবে দুঃশাসনের রক্ত পান করেছিল, মহাভারতের সত্যতা সম্পর্কে বলছি না, কিন্তু আর একটাও যদি বাস্তব উদাহরণ চোখের সামনে না থাকে, এইরকম কল্পনা করে ওঠাও বেশ দুস্কর। আরো শুনবি, প্রাচীন গ্রীসে মার্সিলিও ফিসিনো (১৪৩৩-১৪৯৯) তার রাজত্ব কালে, যুবকদের রক্ত পান করতেন, কারণ, তাতে নাকি যৌবন ধরে রাখা যায়! ভেবে দেখ!!
আরো পিছিয়ে যা, রোমান ঐতিহাসিক প্লিং (খ্রিস্টপূর্ব ২৩-৭৯), লিখেছেন, মৃত গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত খাবার জন্য দর্শকদের মধ্যে পাগলামী দেখা দিত, কারণ, সেই যৌবন এবং বীরত্ব, বীর গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত খেলে নাকি বীরত্ব বাড়ে !!
রক্ত শরীরের বাইরে বের করে চিকিৎসার প্রথা বহুদিনের, প্রাচীন মিশরে এই প্রথার সর্বপ্রথম উদাহরণ পাওয়া যায়, তারপর তা ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতেই, এমনকি এই ভারতবর্ষেও।
কিন্তু শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে চিকিৎসার কথা প্রথম ভেবে ছিলেন, জার্মান চিকিৎসক আন্দ্রেস লিবাভিউস ষোলশ শতকের শেষের দিকে। যদিও তিনি নিজে চেষ্টা করেননি, কিন্তু তার ভাবনাটাও অনেক। বলা যেতে পারে সেটাই ছিল এই বিশাল কর্ম যজ্ঞের প্রথম ধাপ।”
“কোয়াইট ইন্টারেস্টিং” বলে জটায়ু দেখি তার ডাইরিটা বের করছেন।
“মানুষের দেহের রক্ত সংবহন আবিষ্কার করেন, ইংরেজ ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভে, ১৬২৮ সালে।”
সিধু জ্যাঠা “ব্রাভো” বলে উঠলেন। “রক্তবাহ ছাড়া আর কিছু তে যে রক্ত দিলে কাজের কাজ হবে না, জানা গেল। তারপর বলে যাও।”
“তবে মানুষেরও আগে কুকুরের দেহে প্রথমবার রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচানো হয়। ১৬৬৫ সাল। ইংরেজ চিকিৎসক রিচার্ড লোয়ার, একটি মরণাপন্ন কুকুরের শরীরে আরেকটি কুকুরের রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচান। সে এক যুগান্তকারী ব্যাপার।
এরপর ১৬৬৭ সালে, মানুষের শরীরে প্রথম বার বাইরে থেকে রক্ত দেওয়া হল। পৃথিবীর দুজন চিকিৎসক পৃথক ভাবে এই কাজ করলেন। একজনকে আমরা ইতিমধ্যে চিনেছি, ইংরেজ ডাক্তার রিচার্ড লোয়ার। আর অপরজন, ফ্রান্সের সম্রাট কিং লিউইস xiv -র চিকিৎসক, জিন-ব্যাপটিস্ট ডেনিস। অদ্ভুত ভাবেই দুজনেই ভেড়ার রক্ত ব্যবহার করেছিলেন। ফলতঃ যা হবার তাই হলো। দুজনেই মারা গেল।
“আচ্ছা একটা কোর্ট কেস হয়েছিল না?” কাকাবাবু বলে উঠলেন।
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, জিন-ব্যাপটিস্টের বিরুদ্ধে, সম্ভবত সেটাই, কোন ডাক্তারের বিরুদ্ধে করা প্রথম মামলা। তবে জিন ব্যাপটিস্ট রীতিমত প্রভাবশালী ব্যাক্তি ছিলেন। তাছাড়া, তিনি প্রাণ বাঁচাতে করেছিলেন, মামলায় তার শাস্তি হয়নি। তবে এরপর থেকে মানুষের শরীরে অন্য কোন প্রাণীর রক্ত দেওয়া আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।”
ক্যাবলা বলে উঠলো, “ইয়ে তো বিলকুল, সিনেমা কা মাফিক।”
“ব্যাস, এরপর প্রায় দেড়শো বছর মানুষের শরীরে রক্ত পরিব্যাপ্তি সংক্রান্ত কোন কাজের কথা জানা নেই। একটা কালো অধ্যায় বলা যায়।
এরপর জাম্প টু ১৮১৮, আবার এক ইংরেজ চিকিৎসক, ধাত্রীবিদ (গাইনোকলজিস্ট) জেমস ব্লান্ডেল শিরোনামে উঠে আসেন। তিনি এক মহিলার প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের চিকিৎসার জন্য তার স্বামীর শরীরের রক্ত ব্যবহার করেন। অবশ্য প্রাথমিক সাফল্য ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল, কারণ উনিও মারা গেছিলেন। অবশ্য জেমসবাবু নিরুৎসাহ না হয়ে ১৮৩০ সাল অবধি নানা রোগের জন্য দশবার এক মানুষের রক্ত আরেক মানুষের শরীরে দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন। তার মধ্যে পাঁচজন রোগী সুস্থও হয়েছিল, বা বলা যায় সফল রক্তদান হয়েছিল।”
“আচ্ছা, ১৭৯৫ সালে প্রথমবারের জন্য আমেরিকায় যে ডঃ ফিলিপ স্নিগ ফিসিক, রক্ত ট্রান্সফিউস করেছিলেন, তাকে কেন ভুলে যাচ্ছো ভায়া?” কিরীটি বলে উঠলো।
“ভুলে কিছুই যাইনি দাদা, আমি কেবল সেটাই বললাম যেটা সর্বজনগ্রাহ্য বা রিপোর্টেড, ওনার এই রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে উনি নিজেই কোথাও লিপিবদ্ধ করে জাননি, ওনার মৃত্যুর বহু পর এটা একটা ভেসে আসা ‘খবর’ বলেই ধরে নেওয়া হয়।”
সন্তু হঠাৎ বলে উঠলো, “আচ্ছা ট্যাটু থাকলে কি রক্ত দান করা যায় না?”
ফেলুদা কে বললো, “না না, সেরকম কিছু না, তবে সেই প্রসিডিওরের ছ’মাসের মধ্যে দেওয়া যায় না।
কেন? তুই কি করেছিস? আর শোন না মন দিয়ে, কোন প্রশ্ন থাকলে জমিয়ে রাখ শেষের জন্য।”
“না, তুমি বরং ওদের রক্তদান নিয়ে নির্দেশিকা গুলো বলে দাও, ওর আর কি দোষ? কতক্ষণ আর ইতিহাসের আকচা আকচি ভালো লাগে শুনতে? আমি না হয় পরে আবার ইতিহাস নিয়ে ফিরবো।”
” ওরে বাবা, সেতো বিশাল বড়ো লিস্ট, তুমিই বলে দাও।”
“আমি এখন শুনবো, তুমিই বলে দাও। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জল খাবো। আর মনে মনে পরের অংশটা সাজিয়ে নেব এই সুযোগে।”
“আচ্ছা, আমি বলতে পারি কি?” বলে উঠলেন স্বয়ং ব্যোমকেশ বক্সী।
“সানন্দে” বলে আমরা সবাই লাফিয়ে উঠলাম।
সঙ্গে আমি জুড়ে দিলাম “ফেলুদা কে বলা যায়, তুমিই বলো। কিন্তু তোমাকে অনুরোধ করতে কেমন বাধো বাধো লাগছিল। আর তুমি বললে তো সবাই ‘সত্য’ কে জানতে পারবো।”
“নির্দেশিকা আসলে কিছুই নেই, প্রয়োজন কেবল রক্ত দেবার ইচ্ছা, আর কিছু না। এই নির্দেশিকার জন্যে যত না রক্তদানে ইচ্ছুক মানুষকে বিরত রাখা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই নির্দেশের আড়ালে লুকিয়ে থেকে পালিয়ে বাঁচে। আর এটাই হলো সার সত্য।”
“হক কথা” তারিনী খুড়ো বললেন।
“তবুও নির্দেশ গুলো জেনে রাখা ভালো।
*বয়স : ১৮-৬৫ বছর, যিনি প্রথম বার রক্ত দিচ্ছেন তার বয়স ষাটের বেশী যেন না হয়।
ওজন: অন্তত ৪৫ কেজি।
*দুবার ‘হোল ব্লাড’ দেবার মধ্যে সময়ের পার্থক্য তিন মাস (৯০ দিন, ছেলেদের জন্য), আর চার মাস (১২০ দিন, মহিলাদের জন্য)। আমাদের শরীরে রক্তের পরিমান প্রায় ৪.৫-৫.৫ লিটার, যেখানে দিতে হয় মাত্র ৩৫০ মিলি লিটার।
* রক্ত চাপ: সিস্টোল (উপরের টা) ১০০-১৪০; ডায়াস্টোল (নীচের টা) ৬০-৯০.
*হৃৎস্পন্দন: ৬০-১০০, নিয়মিত।
*রক্তদানের সময় জ্বর না থাকাই কাম্য।
*হিমোগ্লোবিন: ১২.৫ বা তার বেশি। ‘থ্যালাসেমিয়া ট্রেট’ হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু পরিমান মতো হিমোগ্লোবিন থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
আছে আরো অনেক, কিন্তু কিছু রোগের ক্ষেত্রে আমি মাসের হিসেবে একটা সাজিয়ে বলছি,
৩ মাস: ম্যালেরিয়া, সম্পূর্ণ সেরে যাবার পর।
৪ মাস: জিকা, সম্পূর্ণ সেরে যাবার পর।
৬ মাস: মাইনর সার্জারি, দাঁত তোলা, ডেঙ্গি, কিডনির ইনফেকশন।
১২ মাস: রক্ত নিজে নিয়ে থাকলে (গ্রহীতা হলে), দাঁতের অপারেশন (অ্যানেস্থেসিয়া সহ), মেজর সার্জারি, হেপাটাইটিস এ, ই (বি বা সি হলে চিরতরের জন্য বন্ধ), টাইফয়েড।
২৪ মাস: টিউবারক্যুলোসিস।
অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে রক্ত দান করা যাবে না।”
“টেরিফিক। মহিলাদের জন্য কোন বিশেষ নিয়মাবলী আছে কি?” মিতিন মাসি আর দেবলীনা গলা মিলিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো।
“হ্যাঁ, তাও আছে।
*বাচ্চা হবার পর ১২ মাস,
*বাচ্চা পেটের মধ্যেই মারা গেলে ৬ মাস,
রক্ত দেওয়া যায় না।
*ঋতুস্রাবের সময় রক্ত না দেওয়াই ভালো শারীরিক কারণে।
আর কিছু না।”
তারিনী খুড়ো, আবার তাড়া লাগালেন, “নাও তুমি আবার শুরু করো ‘বেরসিক’, ভীষণ ইন্টারেস্টিং।”
“তারপর থেকে বহু চিকিৎসক মানুষের শরীরে রক্ত দিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করেছেন, কেউ সফল হয়েছেন কেউ অসফল। কিন্তু ক্রমাগত একটা চেষ্টা চলেছে। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে নি। এমনকি থমকে দাঁড়িয়ে নেই সময়ও। ১৮৪০ সালে, লন্ডনে চিকিৎসক স্যামুয়েল আর্মস্ট্রং হিমোফিলিয়ায় রোগাক্রান্ত রোগীকেও রক্ত দিয়ে সফলতার আস্বাদ দিয়ে দিয়েছেন। রক্ত দানের এ হলো আরেক সোপান।
যদিও রক্ত দেবার পর মৃত্যু, সেই অসফলতা, বারবার করে, পিছিয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু নতুন উদ্যমে আবার ঝাপিয়ে পরেছে মানুষ।
রক্তের অভাবে ভেড়া, ছাগল, গরু, এমনকি মানুষের দুধ দিয়েও প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। স্যালাইন জল দিয়েও দেখা হয়েছে, এসব ১৮৭০ থেকে ১৮৮৪-র মধ্যে। কিন্তু…
মেঘ দেখে কেউ ডরাস নে ভাই, আড়ালে তার সূর্য হাসে।
কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার, অস্ট্রিয়ার চিকিৎসক, ১৯০০ সালে, রক্তদানের দুনিয়ায় এক সোপান তৈরী করলেন। আবিস্কার করলেন, রক্তের গ্রুপ। জানা গেল তিন ধরনের রক্ত আছে, এ (A), বি (B) এবং সি (C) (এই আবিষ্কারের জন্যে উনি ১৯৩০ এ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন)। দুবছরের মধ্যেই ওনারই সহকর্মী, অ্যালফ্রেড ডিক্যাসটেলো এবং অ্যাড্রিয়ানো স্টুরিল, আবিস্কার করলেন এবি (AB) গ্রুপ। সি গ্রুপের নাম বদলে ও (O) করা হল।
এতোদিনে বোঝা গেল কেন যে কোন রক্ত শরীরের মধ্যে প্রবেশ করালেই সাফল্য আসে না। এই মৃত্যু মিছিলের কারণ জানতে পারা গেল। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৪৯২ সালে।
১৯০৭ সাল থেকে দাতা এবং গ্রহীতার গ্রুপ মিলিয়ে রক্ত দেবার প্রথা শুরু হলো। চিকিৎসক রুবেন ওটেনবার্গ প্রথম এই কাজে সাফল্য নিয়ে এলেন। তিনি দেখালেন ‘ও’ সর্বজনীন দাতা, এও দেখালেন রক্তের গ্রুপ মেন্ডেলিয়ন সূত্র ধরে চলে।
১৯১২ সালে, রজার লি O রক্তের গ্রুপ কে সার্বজনীন দাতা আর AB কে সার্বজনীন গ্রহীতা বলে চিহ্নিত করলেন।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও, কেন কিছু মানুষ রক্ত দিলেই অসুস্থ হয়ে পরছেন? চলতে লাগলো ‘কেন’-র উত্তরের খোঁজ। উত্তর মিললো অচিরেই। সেই কার্ল লেন্ডস্টাইনার, বের হল আর এইচ গ্রুপ (rh group), শরীরে, বলা ভালো রক্তে এই গ্রুপ থাকলে পজিটিভ (+ve) না থাকলে নেগেটিভ (-ve)।
এতো লড়াইয়ের পর রক্ত না হয়, কি দিতে হবে, কেন দিতে হবে জানা গেল। দেবো টা কি করে?
কটা বছর আবার পিছিয়ে যাই। ১৯১৪ সাল, পৃথিবীর আকাশে হানা দিয়েছে অশান্তি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমাগত আহত হচ্ছেন সৈনিকরা। প্রয়োজন রক্তের। রক্ত না হোক জোগার হল, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত নিয়ে যাওয়া যাবে কি করে? তখন, রক্ত দিতে হতো পাশাপাশি শুয়ে, সরাসরি। অথচ রক্ত লাগবেই, এতদূর যুদ্ধ ক্ষেত্রে রক্ত নিতে গেলে জমাট বেঁধে যাবে। দেবার উপযোগী থাকবে না। উপায়?
উপায় বের করলেন, অ্যাডলফ হাস্টিন, উনি দেখলেন রক্তের মধ্যে সোডিয়াম সাইট্রেট দিলে রক্ত জমাট বাঁধে না, অন্তত দশ দিন পর্যন্ত রক্ত তরল রাখা যায়। আর সেই রক্ত দিতেও বাঁধা থাকছে না। এটি হলো আরেকটি সোপান, বলা যেতে পারে ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরীর প্রথম ধাপ। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঙ্গিনায় এসে দশ দিনের এই সময়সীমা বেড়ে দাঁড়াল ৪২ দিন, অ্যাসিড সাইট্রেট ডেক্সট্রোস ফর্মুলা আবিষ্কার করেন জে এফ লোউটিট এবং প্যাট্রিক মলিসন, ১৯৪৩ সালে, যা রক্তের সংগ্রহ এবং জমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এক বিশেষ উল্লেখ দাবি রাখে।
রক্ত কে শরীরের বাইরে তরল রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার হবার সাথে সাথেই এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। রক্ত নিয়ে, জমা করে রাখার কথা মাথায় চলে এলো, যেন প্রয়োজনীয় মূহুর্তে ব্যবহার করা যায়।
১৯১৭ সালে, প্রথম অস্থায়ী রক্তের ডিপো তৈরী করা হল, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ডাক্তারেরা কেবল মাত্র ‘ও’ (O) গ্রুপের রক্ত নিয়ে জমা করলেন, যুদ্ধে যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। এ হল দ্বিতীয় ধাপ। আর, প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্কের জন্যে আরো পনেরো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। লেনিনগ্রাডে ১৯৩২ প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা হল। ‘ব্লাড ব্যাঙ্ক’ এই নামটার জন্যে অপেক্ষা করতে হল আরো কুড়ি বছর, ১৯৩৭ সালে আমেরিকায় হাঙ্গেরিয় চিকিৎসক বার্নার্ড ফ্যান্টুস এই নামকরণ করলেন, চিকাগোর কুক হাসপাতালের জন্যে।
চিকিৎসক জন্ ইলিয়ট, এরপর চল্লিশ সালে ওই প্রথম রক্ত নেবার জন্যে আলাদা ‘ভ্যাকুয়াম’ বোতল তৈরি করলেন, ১৯৪৮-৫০ সালে এলো প্লাসটিক ব্যাগ, যা রক্ত সংগ্রহের দুনিয়ায় এক বিপ্লব বলা যেতে পারে। অনেক সহজ করে তুললো রক্ত সংগ্রহ করা, স্টোরেজ করা এবং বহন করা।
এরপর আর দুটো কথা বলে রাখবো, পেটের মধ্যে ইঁদুর রীতিমতো ডন-বৈঠক দিচ্ছে।
আমি ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান’ কেন বলে? তাহলে কি ধরে বেঁধে লোকের থেকে রক্ত নেওয়া হত? মাকে এই প্রশ্নবাণে বহুবার জর্জরিত করেছি। এখন জেনেছি কারণটা। আগে অধিকাংশ ‘রক্তদান’ই হতো অর্থের বিনিময়ে, তারপর মানুষ ‘রক্তদান’ কে পেশার মতো ব্যবহার করতে শুরু করলো। ১৯৭০ সালে ব্লাড ব্যাঙ্ক পলিসিতে পরিস্কার করে দেওয়া হলো, রক্তদান কেবলমাত্র ‘স্বেচ্ছায়’ই হতে হবে।…
হঠাৎ দেখি Jinia পর্দা সরিয়ে ঢুকছে, পেছনেই সত্যবতী আর কৃষ্ণকলি। জিনিয়া আমাকে বলে উঠলো “তোমার না হয়, ফেসবুক, লেখা আর গল্প-আড্ডা নিয়েই চলে যাবে। কিন্তু এদের নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে না খেতে দিয়ে বসিয়ে রাখলে চলবে? সবাই চলে আসুন, ওদিকে খাবার বেরেছি।”
ব্যাস, আর কি? আমার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। ‘বোলতি বন্ধ’।
ভাগ্যিস সিধু জ্যাঠা ছিলেন, মাস্টার স্ট্রোকটা তিনিই দিলেন। বললেন, “দাড়াও বৌমা, এক মিনিট, একটা কথা বলে যাই, সবাই তারপর খেতে যাব।
“১৯৪১ সালে রেডক্রস সোসাইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে পৃথিবী জুড়ে এক বিশাল রক্ত সংগ্রহের ডাক দেয়, এবং সারা পৃথিবী জুড়ে যে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিল যে বলার নয়। ছেলে-মেয়ে, বাচ্চা-বুড়ো নির্বিশেষে সেই বিশাল কর্মকান্ড অংশগ্রহণ করেছিল। সেই সংকট কেটে গেছিল, কারণ সকলে এগিয়ে এসেছিল।
আজ আমাদের রাজ্যে যে রকম রক্তের হাহাকার দেখা দিয়েছে, তা কেবল আমারাই পারি সমাধান করতে। যদি সবাই একটু করে এগিয়ে আসি।”
ডাক্তারবাবু , আমার বয়স ৩৭, রক্তদান প্রথমবার করেছিলাম কলেজে পড়তে। রক্তদান যে অত্যন্ত দরকারী, তাও জানি। রক্তদান করতে ইচ্ছে করে, দিয়েওছি বার দুয়েক। তবে বর্তমানে আমি Oxetol 600 আর Thyronorm 75 ওষুধ খাই। আমার কী রক্তদান করা বারন? যদি একটু বলেন।