(রিপোস্ট)
________
আমি একটা কাজ সারা জীবনে পারিনি। ভেবে দেখলে, একটা কেন, অনেক কাজই পারিনি। কিন্তু এই কাজটা না পারার আক্ষেপ আমার সারা জীবনে যাবে না।
কাজটা সামান্যই। সেটা হল কাউকে সাহস দেওয়া। ভাবলে কিছুই না। কোনও টাকা পয়সা খরচ নেই। আর্থিক ক্ষতি নেই। দায় দায়িত্ব নেই। শুধু সমস্যায় পড়েছে এমন কাউকে বলা, “ভয় নেই, সাহস হারিয়ো না। আমি আছি। আমরা আছি।”
আলগা সেই সব কথাতে এমন কিছু সাহস ভরা আছে, তা না। কিন্তু আমার কথার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে তার মনটা হয়তো অল্পক্ষণের জন্যও সরে আসবে সমস্যার থেকে, যন্ত্রণার থেকে। সেই সময়টুকুর মধ্যে তার ভেতরে জমে যাবে সামান্য হলেও তার নিজস্ব সাহস। কিন্তু আমি সেই কাজটা কখনও করে উঠতে পারিনি।
আমার বন্ধু সেলিমের পায়ে গুলি লাগল। তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিল। কী সব রাজনীতির ব্যাপার স্যাপার। আমি এই সবের মধ্যে থাকি না। কিন্তু ঘটনা ঘটল আমাদের বাড়ির গলিতে। এসে আমাদের দরজার ওপর আছড়ে পড়ল। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দরজা খুলে দেখি, নিজেই নিজের পায়ে রুমাল দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে। কিছু পরে এল পুলিশের গাড়ি। আমি ওকে সাহস দেওয়া দূরে থাক, আদৌ পরিচয় আছে চেপে গিয়ে হন্যে হয়ে পুলিশকে বললাম, শিগগিরই নিয়ে যান একে। হাসপাতালে লকআপে যেখানে খুশি।
সেলিমকে পাশে দাঁড়িয়ে সাহস যোগালে আমি এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তাম। পুলিশেরা ওকে চ্যাং-দোলা করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছিল। আমি রোয়াকে জল ঢেলে পরিষ্কার করেছিলাম সেই একাত্তরে।
সেলিমের সঙ্গে অনেক বছর পরে একবার দেখা হয়েছিল। সেই পাটা সামান্য টেনে হাঁটছিল। বই মেলায়। ওর নাকি একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। ওই আমাকে চিনতে পেরেছিল। আমি জানতে চাইনি, তবু ওর বৃত্তান্ত শোনাতে চাইছিল আমাকে। আমি ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে কেটে পড়েছিলাম তড়িঘড়ি। পাছে কেউ ওর সঙ্গে আমাকে দেখে ফেলে।
শিবুদি মানে শিবানী রায় আমার পিসতুতো দিদি। নিজের ভাইয়ের মত দেখত আমাকে। ওর বর দেবুদা’ আমাকে ক’বছর আগে প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে বিশহাজার টাকা দিয়েছিল, এক কথায়, শিবুদি বলেছিল বলে। ফেরত দেওয়া হয়নি।
সেই দেবুদা’ যখন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মরমর হয়ে ভর্তি, শিবুদি আমাকে খবর দিয়েছিল।
পাড়ার লোকেরা আর অন্য আত্মীয়রা ছোটাছুটি করছে। আমি অন্তত গিয়ে সাহস তো দিতে পারতাম। দিইনি। যাইইনি। গেলেই , যদি সেই টাকার কথা উঠে পড়ে?
এই রকমের হাজার বাহানায় পিছিয়ে গেছে সাহস দেবার মত একটা মামুলি কাজ।
আজ এতদিন বাদে সেই কাজটা পারলাম। ব্যাপার সাধারণ। আমার বউ বীথি মারা গেছে। কীসে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। সবাই যে অসুখে মারা যায় আজকাল, তাতেই মারা গেছে। কোভিডে।
বাড়িশুদ্ধ সবার হয়েছিল। খারাপ হল ওই একা। যখন হাসপাতালে নেওয়া হল, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ষাটের নীচে। কিন্তু জ্ঞান ছিল।
তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ভালো হত। কর্পোরেট হাসপাতালে সিট ছিল। কিন্তু ওরা প্রথমেই খোঁজ নেয় ইনসিওর্যান্স আছে কিনা। সেই কথা বীথির কানে গেছিল।
ও আমাকে বারবার বলছিল, “চিন্তা কোরো না। খোকা গতবছর ইনসিওর্যান্স করিয়েছে।”
বেচারা বীথি জানতও না, যেটা করানো হয়েছে সেটা লাইফ ইনসিওর্যান্স। খোকাই নমিনি। মোটা টাকার। প্রিমিয়ামও লেগেছে অনেক।
সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বেশ ঝামেলা হল। এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল দৌড়োদৌড়িতে ফালতু কিছু সময়ও গেল।
হাসপাতালে খরচ বেশি হল না। পরের দিনই মরে গেল। তখন চারিদিকে ডামাডোল। চিকিৎসায় ডামাডোল। মরে গেলেও তাই। পলিথিনে মুড়ে বার করা হচ্ছে বডি। মুখটুকুও দেখতে দিচ্ছে না শ্মশানে। খোকা কাকে যেন হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে তার মায়ের মুখটা দেখবার ব্যবস্থা করেছে। মুখাগ্নি করেছে। সেই সবও খুব যত্ন করে ভিডিওতে তুলে রাখিয়েছে।
বাড়িতে ফিরে খোকা বলল, শ্রাদ্ধ করবে। আমি আপত্তি করতে বলল, বেশি কাউকে বলবে না, কিন্তু কার্ড ছাপাবে।
মায়ের ছবি সামনে রেখে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ভিডিও তোলালো যত্ন করে।
খোকা খুব চিন্তিত। সে রাত জেগে ইনসিওর্যান্স পলিসির কাগজে ছোট ছোট অক্ষরের লেখাগুলো পড়ে। তার মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট আর হাসপাতালের চিকিৎসার কাগজের জেরক্স মেলায়।
ফোন করে এজেন্টকে। বলে, “সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। ভিডিওতে তোলা আছে সব। শ্রাদ্ধের কার্ড অবধি আছে।”
আসলেই এই সব বেশি টাকার ক্লেম পাবার নানান প্যাঁচঘোচ রয়েছে। খোকা খুব চিন্তিত।
আমি ওর পিঠে হাত দিয়ে বলি, “সব পেয়ে যাবি। চিন্তা করিস না।”
খোকাকে সাহস দিই।
এত দিনে আমি সাহস দেবার কঠিন কাজটা করতে পেরেছি। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম।