এমডি পাশ করার পর জীবনে প্রথম শূন্যতা অনুভব করি আমি। হাতে কোনো চাকরি নেই। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অ্যানেস্থেসিয়া ডিপার্টমেন্টে সিনিয়র রেসিডেন্টশিপে আবেদন করে যখন জানতে পারলাম আশা নেই তখন তল্পিতল্পা গুটানো ছাড়া আমার সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। এরই মধ্যে আমার ছেলে আলেখ্যর জন্ম হয়েছে আর মামাবাড়িতে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ওর এবং ওর মায়ের পিছনে খরচের কথা চিন্তা না করলেও নিজের চালানোর মতো কিছু একটা করতে হবে ভেবেই আমি হস্টেলের বেডখানা কিছুদিনের জন্য দখল করে রাখলাম। কলকাতা শহরে বিনা পয়সায় থাকার জন্য এর চাইতে উত্তম ব্যবস্থা আর কিছু হয় না।
ওইসময়েই পার্কসার্কাসের ছোটোখাটো দু’একটা নার্সিংহোমে আমি ডাক পেতে শুরু করি। সাতসকালে অপারেশন থাকলে শুধু পয়সা বাঁচাতেই জলখাবার না খেয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে যেতাম। কারণ, তদ্দিনে জেনে গিয়েছিলাম নার্সিংহোমগুলোতে ডাক্তারদের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়।
তখন এমবি নার্সিংহোমে আমাদের জন্য চা জলখাবার বয়ে আনত ফিলকৌস। আরবি ভাষায় এই নামে কোনো শব্দ আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে জিজ্ঞাসা করলেই সারাক্ষণ গুটখা চিবোনো ছেলেটি বলত, “আমার নাম ফিলকৌস।” হয়তো ‘ফিরদৌস’ বলতে গিয়ে দাঁতের ফাঁক দিয়ে ‘ফিলকৌস’ বেরিয়ে যেত। এই ফিলকৌসই সকাল সকাল আমাদের জন্য ফ্লাস্কভর্তি গরম চা নিয়ে এসে বলত, “স্যার ব্রেকফাস্টে কী দেব?”
আমি বরাবর দেখেছি জলখাবারে যাই অর্ডার দিই না কেন ফিলকৌস একটা প্লেটে ডিম, কলা, টোস্ট আর একপিস মিষ্টি দিয়ে যেত। একদিন বিরক্ত হয়ে বললাম, “তুমি তো রোজ একই ব্রেকফাস্ট দাও তাহলে ‘কী খাবেন’ জিজ্ঞাসা করার অর্থ কী?”
ফিলকৌস বলেছিল, “স্যার, ডিমের সেদ্ধ দেব না ওমলেট দেব, টোস্টে বাটার না জ্যাম মাখিয়ে দেব আর বাটার দিলে চিনি দেব না নুন-গোলমরিচ দেব সেটা তো বলতে হবে।”
ধীরে ধীরে এই ব্রেকফাস্টের একটা অ্যাব্রিভিয়েশন চালু করেছিলাম আমরা। ডিকেটিএম (D for ডিম, K for কলা, T for টোস্ট আর M for মিষ্টি)। এরপর ফিলকৌস যতবার এসে জলখাবারের অর্ডার নিত আমরা শুধু বলতাম ‘ডিকেটিএম’।
মানুষের জীবনে সুখের দিন যেমন চিরস্থায়ী হয় না তেমনি এই নার্সিংহোমের পুরনো গ্ল্যামারটাও আগের মতো থাকল না। ফিলকৌসও ক্যান্টিনের কাজ ছেড়ে চলে গেল অন্য কোথাও। বাজেট ছাঁটার কোপ এসে পড়ল ডাক্তারদের ব্রেকফাস্টেও। চারাক্ষরের ডিকেটিএম রূপান্তরিত হ’ল তিনাক্ষরের ডিকেটি-তে। অর্থাৎ মিষ্টি হয়ে গেল উধাও। তারপর থেকে ডাক্তারদের সন্তুষ্ট থাকতে হ’ত ডিম-কলা-পাউরুটিতেই।
ইদানীং এই নার্সিংহোমটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলায় অপারেশন থিয়েটারের সামনেটা আগের মতো গমগম করে। ছেড়ে গিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারে নি বলে ফিলকৌসও ফিরে এসেছে ক্যান্টিনে। আমিও বেশ কিছুদিন পর ডাক পেলাম এই নার্সিংহোমে।
সার্জনস্ রুমে চায়ের ফ্লাস্ক পৌঁছে দিয়ে ফিলকৌস জিজ্ঞাসা করল, “স্যার ব্রেকফাস্টে কী দেব?”
আমি বললাম, “আবার পুরনো প্রশ্ন! যাও চারজনের জন্য ডিকেটি নিয়ে এসো।”
ফিলকৌস বলল, “স্যার, আজ ডিকেটি-র সাথে এনজিএস দেব।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সে কী! নার্সিংহোমের এত উন্নতি! আজ ব্রেকফাস্টে ছয়খানা আইটেম!
একটু পরেই আমার ভুল ভাঙল। ফিলকৌস যখন চার প্লেট ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল তখন দেখলাম প্লেটে একটা ডিমসেদ্ধ, একটা কলা, দু’পিস পাউরুটির সাথে ছোট্ট কী যেন একটা। বললাম, “ফিলকৌস, তুমি যে বললে DKTNGS! তাহলে এটা কী দিলে?”
ফিলকৌস বলল, “স্যার, নলেন গুড়ের সন্দেশ।”
“কিন্তু আমার তো এখন সুগার। তুমি বরং সন্দেশটা তুলেই নাও।”….বললাম আমি।
ফিলকৌস স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “সিজনের প্রথম নলেন গুড় দিয়ে বানানো। একটায় এমন কিছু সুগার বাড়বে না। খেয়ে নিন স্যার, খেয়ে নিন।”