আরও একটি পুণ্য পূর্ণিমা আগত, তবু, তথাগত, আমার তো কিছুই শেখা হলো না!
শৈশব কৈশোর তারুণ্য যৌবন সব পর্যায় অতিক্রম করে এসে, মধ্যবয়স থেকে প্রৌঢ়ত্বের দরজায় কড়া নাড়ার মুহূর্তে পেছন ফিরে চেয়ে দেখছি, সবই তো হারিয়ে গিয়েছে, সবই হারিয়ে যায় – সকলই বিলীয়মান – কিছুই স্থায়ী নয়, কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয় – একেই কি অনিত্যতা বলে, তথাগত? আঁকড়ে রয়েছি স্মৃতি, আর অনুভব করছি ক্রমশ, স্মৃতিই বলি বা বিস্মরণ, উভয়ই, স্থায়িত্বের অঙ্কে ক্ষণিক মাত্র। আমার অপ্রাপ্তবয়সী দিনগুলোর অর্ধেক নিয়ে চলে গিয়েছে বাবা আর বাকি অর্ধেক বইতে বইতে ক্রমশ বুড়ি হয়ে যাচ্ছে মা – বিস্মরণের গ্লানিতে আচ্ছন্ন হতে হতে আমাকেও মুছে যেতে হবে আর আগের বাক্যটুকু সত্য হয়ে উঠবে আমার সন্ততির জীবনে, সে দিনেরই বা কতটুকু দেরি আর, তবু, তথাগত, কিছুই তো জানা হলো না আমার!
আমার অতীত বিগত – ভবিষ্যৎ অনাগত, অতএব অপরিজ্ঞেয় – অস্তিত্ব বলতে শুধুই বর্তমান – রূপ অনুভূতি সংস্কার চেতনা ধারণা, পঞ্চস্কন্ধ বশত এই জন্মানুভব, এই অস্তিত্ব – তবু সে অস্তিত্ব অনর্থক নয়, অনিত্য তবু দায়বোধহীন নয় – অনন্ত প্রবাহের মাঝে, মনুষ্যকুল প্রাণী উদ্ভিদ জড়বস্তু প্রকৃতি সব, সবকিছুর সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীল আমাদের এই এতটুকুনি অস্তিত্ব, হাতে থাকা বলতে শুধুই এই বর্তমানটুকু, দায়বদ্ধতার এই বর্তমান, অনিবার্য সে সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ আমার এই মন ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি, জানতেন তো আপনি। মনে করিয়ে দিতে পারতেন তো, তথাগত, আরও একটিবার!
প্রিয় তথাগত, আমি তো জেনেছি, এই সূর্যালোক, এই বাতাস, জল, মৃত্তিকার রস আহরণ করা বৃক্ষরাজি, সালোকসংশ্লেষ, শ্রমের শস্য, শস্য থেকে আহৃত পুষ্টি, আরও কত কী – এর যে কোনও একটি উপাদানের অনুপস্থিতিতে আমি সম্ভব হতাম না। অথচ আমি সূর্যালোক নই, আমি বায়ু নই, আমি জল নই, আমি উদ্ভিদ নই, আমি মৃত্তিকা নই, আমি শস্য নই, এমনকি আমি অন্য কিচ্ছুটি নই – হয়তো বা বাকি সকলের মধ্যে পৃথক, তবু আমার সবকিছুই বাকি সকলের উপর নির্ভর, এই সবকিছুর জন্য সকলের প্রতিই আমার দায়বদ্ধ ও কৃতজ্ঞ থাকা কর্তব্য – এটুকু তো আমার নিজেরই উপলব্ধি করার কথা ছিল, তবু পারিনি। তথাগত, এসব কথা আপনি বলে গিয়েছেন, বলেছেন অনেক অনেএএক বার, আমারই সময় হয়নি শোনার।
তথাগত, প্রিয় আমার, একেকটি দৃশ্য আমার দর্শনেন্দ্রিয়ের জন্ম দেয়, একেকটি সুরে জেগে ওঠে আমার শ্রবণেন্দ্রিয়, সুপক্ক ফল থেকে গড়িয়ে আসা রসে আমার স্বাদকোরকের জন্ম – সেই ফলের বীজ মাটিতে পড়ে সূর্যালোক জল মৃত্তিকায় মিলেমিশে জন্ম নেয় চারাগাছ, চারাগাছ বেড়ে বৃক্ষ, শাখায় শাখায় নবতরুদল, পল্লবে পল্লবে হরিৎবর্ণ সবুজের কত না প্রকারভেদ, ডালে ডালে মুকুল আসে, উড়ে আসে মৌমাছি, ফলে পরিণতি পায় ফুল, সুপক্ক ফলের রসে জন্ম নেয় কত স্বাদকোরক আরও কত জিহ্বায়, সেই স্বাদে তৃপ্ত হয় আরও কত হৃদয়… তথাগত, তখন আমি কোথায়! একদা সেই যে বীজটি মাটিতে পড়েছিল, তা-ই বা কোথায়? ফলভারে ন্যুব্জ বিপুল বৃক্ষের গভীরে সেই বীজটিকে চিনতে চাওয়া, সে কি অবান্তর অনুসন্ধান নয়? সূর্যালোক জল মৃত্তিকা বৃক্ষ পর্ণরাজি মুকুল অজস্র ফলের গভীরে লুকিয়ে থাকা অজস্রতর বীজ অজস্রতর জীবনের সম্ভাবনা … কার মধ্যে খুঁজে চলব সেই বীজের অস্তিত্ব? অজর অমর আত্মা, সেই বীজটির মতোই, অলীক। থেকে যাওয়া বলতে কিছু না – অথবা প্রবাহ।
নির্বাণের পর কিছু অবশিষ্ট থাকবে কি? না! নির্বাণের পর কিছুই কি থাকবে না? না! নির্বাণ বলতে থাকা-না-থাকার মাঝামাঝি কোনও অবস্থা হবে কি? না! কিছু থাকা-না-থাকা এই দুইয়েরই বাইরে কোনও বিশেষ অবস্থা-ই কি তবে নির্বাণ? না! উপর্যুপরি এই চারখানা ‘না’ তো আপনারই বলা, তথাগত!
হয়তো নির্বাণ বলতে মুক্তি। অনির্বচনীয় এক মুক্তির আলোকানুভব। সে মুক্তি একের নয়, বহুর। একত্রে মুক্তি। যে মুক্তি এমনই, যা অপরকে অতিক্রম করে সম্ভব হয় না – সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তবেই সম্ভব। পথ খুঁজতে হয়। নিজেকেই, নিজেদেরও। আপনি পথ দেখাতে চাইছিলেন – যে পথের শেষে নির্বাণ থাকলেও থাকতে পারে, আর নির্বাণ যদি না-ও মেলে, সে পথে চলতে পারলে এক সুন্দর জীবন ও সুন্দরতর পৃথিবীর নিশ্চয়তা আছে। প্রিয় তথাগত, আপনি তর্জনী তুলে পথের দিকনির্দেশ করছিলেন আর কেউ কেউ তর্জনীটিকেই পথ ভেবে তৃপ্ত হচ্ছিল, কেউ বা অন্য কিছু – আর অর্বাচীন এই আমি, আমার মতো হয়তো আরও অনেকে, আমাদের তো কিছুই অনুসরণ করে ওঠা হলো না।
আপনি তো অমোঘ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন, তথাগত! সত্য নয়, সত্যসমূহ। অনন্ত প্রবাহের মাঝে সে সামূহিক সত্য অনুভব করার পরিবর্তে নিজের অস্তিত্বকে সর্বস্ব জ্ঞান করেছি, ঈর্ষা দ্বেষ বৈরিতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে বর্তমানের কর্তব্য বিস্মৃত হয়েছি। যত্নশীল হওয়ার কথা ছিল যত, উদাসীন হয়েছি ততোধিক। আত্মগত বিভ্রমে আচ্ছন্ন এই আমি – না, আমার শুনে ওঠা হয়নি আপনাকে।
আবারও একবার বুদ্ধ পূর্ণিমা আগত, কিন্তু, প্রিয় তথাগত, আমার যে কিছুই শেখা হলো না!!









