বর্তমানে প্রতিবন্ধী শব্দটি অবশ্য সরকারি ডিকশনারি থেকে বাদ পড়েছে, ‘ডিফারেন্টলি এবেলড’ ‘বিশেষ ভাবে সক্ষম’ এইসকল প্রচলিত শব্দের পর নবকলেবরে নাম রাখা হয়েছে “দিব্যাঙ্গ”।
প্রতি বছরের মত গত ৩রা ডিসেম্বর সমগ্র বিশ্বে পালিত হলো International Day of Persons with Disabilities বা এক কথায় “প্রতিস্পর্ধি ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস”। প্রতিবছর এই দিনটি সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠান মূলক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শুধু উৎসবের আবহেই ঘটা করে পালন করেই শেষ হয়ে যায় না।
তাহলে কি তাৎপর্য্য বহন করে প্রতিবছর এই দিন টি?
আসলে অঙ্গীকারবদ্ধ হবার দিন হিসাবে পালিত হয়।
অঙ্গীকার একতার!
অঙ্গীকার সমতার!
অঙ্গীকার দায়বদ্ধতার!
অঙ্গীকার মর্যাদার !
অঙ্গীকার অধিকারের !
অঙ্গীকার সুস্বাস্থ্যের !
এককথায়… প্রতিস্পর্ধি ব্যক্তিবর্গের মর্যাদা, অধিকার এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য সমর্থন জোগাড় করা এবং প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলির বোঝাপড়া ও প্রচারের লক্ষ্যেই ১৯৯২ সাল থেকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এই দিনের পালন করে আসছে সংযুক্ত রাষ্ট্র।
২০১৯ সালের থীম ছিল “Promoting the participation of persons with disabilities and their leadership: taking action on the 2030 Development Agenda” অৰ্থাৎ….প্রতিস্পর্ধি ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ এবং তাদের নেতৃত্বের প্রচার: ২০৩০ এর উন্নয়ন বিষয়সূচীমূলক পদক্ষেপ।
এবার আসা যাক রাজ্যের কথায়….২০১১ সালের ডিসবিলিটি সেনসাস অনুযায়ী রাজ্যের প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ ১৭ হাজার চারশো ছয়, যার মধ্যে মানসিক, চক্ষু-কর্ণ গত প্রতিবন্ধকতা বাদ দিলে শুধু চলা ফেরা সংক্রান্ত ও একাধিক অক্ষমতা সংযুক্ত প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যাই যথাক্রমে প্রায় ১ লক্ষ ৩৬ হাজার পাঁচশো তেইশ এবং ২ লক্ষ ৯৬ হাজার পাঁচশো এক।
বিগত ৯ বছরে এই পরিসংখ্যান বেশ কিছুটা বেড়েছে বলেই আমার অভিমত।
কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ তথা উপযুক্ত পুনর্বাসন চিকিৎসা ব্যবস্থার যোগান দিতে পরিষেবার মধ্যে আমাদের রাজ্যে কিছু বহুজাতিক সংস্থা ও এনজিও কাজ করছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থার প্রায় ৬ থেকে ১০ গুণ ব্যয়বহুল পণ্য কিংবা রাজ্যের বিভিন্ন এনজিও গুলির উপকরণের গুণমানের চেয়ে পরিমাণের দিকের অধিক মনোনিবেশ সাধারণ মানুষের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
শেষ পর্যন্ত, নিম্ন বা মাঝারি আয়যুক্ত অধিকাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি পরিষেবাই একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়।
তাও সরকারি ক্ষেত্রে মাত্র দুটি সংস্থান এই রাজ্যে বিরাজমান। একটি কলকাতার বনহুগলিস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘এন এই এল ডি’ ও উন্নতি রাজ্য সরকারের নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থিত “আঞ্চলিক কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন কেন্দ্র” তথা “Regional Artificial Limb Fitting Centre” (আর.এ.এল.এফ.সি.)’।
আর.এ.এল.এফ.সি.-ই হল এক ও অদ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র, যা রাজ্যের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ বিশেষত শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধজন দের শারিরীক পুনর্বাসনে উপযোগী মেডিক্যাল সহায়ক উপকরণ (assistive device) দ্বারা নিখরচায় সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কেন্দ্র টি সরাসরি এন আর এস হাসপাতালের অধীক্ষক তথা উপাধ্যক্ষ এর তত্ত্বাবধানে থাকলেও কার্যসূত্রে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রটি ১৯৭৮ সালের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরে পরিকাঠামো সংস্কার করে আধুনিকতার মোড়কে ২০১৫ সালে উন্নীত করা হয়।
কি এই সহায়ক উপকরণ?
আসলে অত্যাধুনিক কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গের (বিশেষত হাঁটুর নীচে ও ওপরে বা কনুইয়ের ওপরে ও নীচে) পাশাপাশি অত্যাধুনিক অর্থোটিক সহায়ক উপকরণ তথা ব্রেস, বেল্ট, ক্যালিপার, ইনসোল, স্প্লিন্ট, ফ্র্যাকচার গার্ড, অর্থোপেডিক ও মডিফায়েড জুতা, ডায়াবেটিক ফুট কেয়ার উপকরণ সব কিছুই সহায়ক উপকরণের তালিকায় থাকে। মোবিলিটি সহায়তার উপকরণ হিসাবে হুইলচেয়ার, বিভিন্ন ওয়াকিং এইড, ট্রাইপড, কোয়াদ্রিপড, ওয়াকার, ক্রাচ সহ স্ট্রোক, পেশীগত এবং শিরদাঁড়া গত স্নায়বিক ও অস্থিবৈকল্যতার উপকরণও টেকনিক্যালি প্রস্থেটিক অর্থোটিক শ্রেণীভুক্ত।
তাছাড়াও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু সহ মানসিক, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার উপাচারে আছে চক্রপদ ক্লিনিক, ফিজিওথেরাপি(ভৌতিক চিকিৎসা) এবং অকূপেশনাল থেরাপি (ব্যবসায়িক চিকিৎসা)।
দিব্যাঙ্গ ব্যক্তির আর্থিক সঙ্গতি বা আয়ের অনুকূলতা বা প্রতিকূলতা নির্বিশেষে এই কেন্দ্রে সব পরিষেবাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উপলব্ধ করানো হয়। দার্জিলিং, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, দিনাজপুর, ২৪ পরগনা, নদিয়া সহ সমগ্র রাজ্যের অন্যান্য জেলা থেকে শুরু করে প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে কাতারে কাতারে প্রতিবন্ধী ভাই বোনেরা প্রায় প্রতিদিনই রেফার মারফত পৌঁছে যাচ্ছেন এই কেন্দ্রে।
কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়?
সহায়ক উপকরণ সহযোগে পুনর্বাসনের পরিষেবাগুলি এক ছাদের নীচে পেতে এই কেন্দ্রে সরকারি ছুটি বাদে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল-বৃহস্পতি বার (সকাল 10 টা থেকে দুপুর 2টা) ও.পি.ডি. বসে। পোস্ট-পোলিও, পোস্ট স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, রিউমাটয়েড বাত, অস্থিগত ব্যথা, শিরদাঁড়া তথা মেরুদণ্ডের বিকৃতি, গমনশীলতার অসুবিধা, জেরিয়াট্রিক কেয়ার, অঙ্গ বিচ্যুতি, পোস্ট সার্জিকাল পুনর্বাসন, স্নায়বিক প্রতিবন্ধকতা, ভাস্কুলার প্রবলেম, অর্থোপেডিক ডিসঅর্ডার, পেডিয়াট্রিক অক্ষমতা এবং অটিজম সহ সেরিব্রাল প্যালসি, ডাউন সিনড্রোম, বিলম্বিত বিকাশ, সি.টি.ই.ভি. ও ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি- এই সকল সমস্যায় রেফার হয়ে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ফরোয়ার্ড হয়ে এই কেন্দ্রে পুনর্বাসন চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যায়।
কারা এই পরিষেবা দিতে পারেন?
পুনর্বাসন মূলত স্বতান্ত্রিক পরিষেবার বদলে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি বা বহু পেশাদারিত্ব শৃঙ্খলার যৌথ প্রচেষ্টায় লক্ষ নির্ধারণ করে তবেই সাফল্য পায়। সেক্ষেত্রে পরিষেবা নেবার সময় সবথেকে বেশি সচেতন হতে হয় পরিষেবা প্রদানকারীর বিষয়ে। রাজ্য তথা দেশ জুড়ে বাজারে অবৈধভাবে বেড়ে চলেছে হাতুড়ে ব্যবসায়ীদের রমরমা। ব্যবসার স্বার্থে হাতুড়েদের থেকে এই অবৈধ ননস্ট্যান্ডার্ড উপকরণ কিনে ব্যবহার করলে পুনর্বাসনের বদলে সামগ্রিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই পরিষেবা নেবার আগে পরিষেবা গ্রহণকারীর কর্তব্য পরিষেবা প্রদানকারীর যোগ্যতা সঠিক ভাবে যাচাই করে নেওয়া। এই জাতীয় সহায়ক উপকরণের পরিষেবা গুলি দিতে গেলে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার ‘প্রস্থেটিস্ট ও অর্থোটিস্ট’ হতে হয় যারা ভারত সরকারের পুনর্বাসন পরিষদ (Rehabilitation Council of India) কর্তৃক ‘এ’ গ্রেডে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ও স্বীকৃতি প্রাপ্ত। অন্যদিকে থেরাপিউটিক ও শিক্ষাগত পরিষেবা গুলি একমাত্র পেশাদার থেরাপিস্ট তথা ফিজিওথেরাপিস্ট, অকূপেশোনাল থেরাপিস্ট, অডিওলজিস্ট- স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, স্পেশাল এডুকেটর ইত্যাদিদের দ্বারাই নেওয়া উচিত।
সাধারণ জনগণের তথা দিব্যাঙ্গ মানুষজনের সঠিক সময়ে উপযুক্ত পুনর্বাসন পরিষেবার স্বার্থে রাজ্যব্যাপী সার্বিক ভাবে প্রাথমিক পর্যায়েই নির্ণয় এবং ওই সম্পর্কিত সচেতনতার প্রসার করতে পারাই বর্তমান পুনর্বাসন চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।