শেষ পেশেন্ট যাওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরোনোর তোড়জোড় করছিল নিশা। এমন সময় বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে কলকাতার ভিড়ে বেরোনোর সাহস জোগাড় করা আদপেই সহজ কাজ নয়। কাজেই, মোটা গদি আঁটা আরামচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল সে। আজ আবহাওয়া ভালো না থাকায় অন্যদিনের চাইতে বেশ কমসংখ্যক পেশেন্ট এসেছিল।
বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে ক্যামেরার রিলে একের পর এক ছবি যেমন সাজানো থাকে ঠিক তেমন করে তার মনের মধ্যে এক এক করে উঁকি মেরে যেতে থাকল রিয়া, নলিনী, রিশভ, সামন্ত্যকরা। কত টুকুটুকু সব জীবন, কিন্তু তারই মধ্যে কত কিছু অনুভব করে ফেলেছে তারা–কত রকম ঘটনা দাগ কেটে গেছে তাদের নিষ্পাপ মনগুলোতে, আর সেই সব শৈশব হারানো ছেলেমেয়েদের হাত ধরে একটা শান্তির ছোটবেলায় ফিরিয়ে দেওয়াই নিশার কাজ।
নিজের অজান্তেই ভাবনার প্রবাহটা আটকে গেল তুলিকার কথা মনে পড়ায়। ছোট থেকেই ভীষণ প্রাণবন্ত, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে কখনও পড়তে বসতে বলতে লাগেনি তার মা বাবার। পড়াশোনা থেকে নাচের ক্লাস, ছবি আঁকা থেকে আবৃত্তি সবেতেই সে অবলীলায় অসাধারণ। সবাই তার মায়ের থেকে জানতে চায় মেয়েকে তিনি ঠিক কি খাওয়ান আর কীভাবে শাসন করেন। তৃণাদেবী খানিক হেসে, খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, “ও তো ছোটবেলা থেকেই এইরকম, ওকে আমরা কিছুই বলিনা।“ আর এই অনায়াসে ভালো হওয়ার কারণে সকলের প্রিয় তুলিকার থেকে সবার প্রত্যাশাও অনেকখানি। ক্লাসে সে প্রথম হবেই, সবার মধ্যে তার আঁকাটাই সেরা হবে, নাচের অনুষ্ঠানে সে সবার সামনে নাচবে এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। সবেতেই পারদর্শী এই দ্বাদশবর্ষীয়া এহেন প্রত্যাশায় অভ্যস্ত। কিন্তু তার এই ভীষণ ভালো হওয়ার ফলে বন্ধুত্ব পাতানোটা তার পক্ষে মুশকিল হয়ে ওঠে দিনকেদিন। সে যতই সবার সাথে মিশতে চাক, তার ক্লাসমেটরা তাকে কেমন একটা অন্য চোখে দেখে। এমনভাবে তাকে আলাদা করে দেয় যেন তার এই প্রথম হওয়া একধরনের অপরাধ। কেউ বা তাকে অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাবে, কেউ ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী,কিন্তু তার সাথে একটা সাদামাটা বন্ধুত্বের কথা যেন কেউ ভাবতেই পারেনা। নিজের এই একাকীত্বের কথা সে কাকে ঠিক বলবে বুঝতে না পেরে ডাইরির পর ডাইরি ভরায় নিজের মনের কথা লিখে। আগে সে এক ক্লাস থেকে পরের ক্লাসে ওঠার সময় ভাবত যে নিশ্চই নতুন ক্লাসে তার কোনও নতুন বন্ধু হবে। কিন্তু ক্লাস সেভেনে উঠতে উঠতে সে বুঝতে শিখে যায় যে বাকি সবকিছু পেলেও বাকিদের মতন বেস্ট ফ্রেন্ড কিম্বা ফ্রেন্ডগ্রুপ তার ভাগ্যে নেই। ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে থাকে নিজেকে। নিজের এই বন্ধু না বানাতে পারার কথা মা বাবাকে বলে না এই ভেবে যে তাঁরা হয়ত অকারণে ব্যতিব্যস্ত হবেন।পড়াশোনা চালিয়ে যায় আগের মতই, কিন্তু নাচতে কিম্বা ছবি আঁকতে আর কেমন জানি তেমন ভালো লাগে না তার। মা বাবা ভাবেন পড়ার চাপ বাড়ায় পড়ার দিকে বেশী মন দিচ্ছে মেয়ে। পরীক্ষায় এখনও প্রথম স্থান বজায় থাকায় এসব খুব একটা কিছু চিন্তার বিষয় বলে মনে হয় না তাঁদের। আগের চাইতে চুপচাপ থাকাটাকে তাঁরা নেহাতই বয়ঃসন্ধির নিয়ম বলে এড়িয়ে যান। নিজেদের কাজ এবং মুঠোফোনের দেওয়াল টপকিয়ে মেয়ের মানসিক অবস্থার কথা ভাবার প্রয়োজন তাঁদের মাথায় আসে না, কারণ তাঁরা এতো দিনে মেনে নিয়েছেন যে তাঁদের মেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণা।
কয়েক মাস গড়াতে গড়াতে তাঁরা লক্ষ্য করেন যে মেয়ে একা ঘরে বসে হেসে যেন কার সাথে গল্প করছে। প্রথমে ভাবেন কারুর থেকে নিশ্চই ফোন নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরে চুপি চুপি দেখতে গিয়ে দেখেন কোথায় কি- একলা ঘরে সাদা দেওয়ালের দিকে চেয়ে গল্প করে যাচ্ছে তাঁদের তুলি। কাছে যেতেই হতচকিত হয়ে তাড়াতাড়ি চুপ করে যায় সে। “কিছু না, পড়া বলছিলাম”, বলে এড়িয়ে যেতে চায় খানিক। কিন্তু দিনের পর দিন যখন এই “পড়া বলা”চলতেই থাকে, এমনকি হঠাৎ হঠাৎ খাবার টেবিলেও যেন কোথায় অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে, বিড়বিড় করে কি যেন বলে নেয়, রাতেও না ঘুমিয়ে একা একা জেগে ঘুরে বেড়ায় বাড়ির ছাতে,
তখন খানিক বিভ্রান্ত হয়েই তৃণাদেবী পরিবারের অনেকদিনকার ডাক্তারবাবু ডক্টর নিয়োগীর পরামর্শ নেন ফোন করে। তুলিকার ব্যবহারের কথা শুনেই তিনি তাড়াতাড়ি কোনও এক সাইকিইয়াট্রিস্টের কাছে দেখাতে বলেন। কিন্তু এই কথা তুলিকার বাবা অর্পণের কাছে পাড়তেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি। তাঁর এরকম অসাধারণ মেয়ের মানসিক রোগ হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা! বরং ক’দিন বেড়িয়ে এলেই মেয়ের মন ভালো হয়ে যাবে ভেবে নর্থ বেঙ্গল যাওয়ার টিকিট বুক করে ফেলেন তিনি। তৃণাদেবী খানিক অসহায় হয়ে নিজের বোনের কাছে কথাটা চুপিচুপি বলতে তিনি বারাসাতের এক বাবার খোঁজ দেন, যিনি নাকি স্বয়ং শ্রী সাঁইবাবার আশীর্বাদধন্য। সেই বাবার কাছে তুলিকে কোনোমতে মানিয়ে বুঝিয়ে নিয়ে যেতেই তিনি ১০০% গ্যারান্টি সহকারে বলেন যে তাঁর মেয়ের ওপর নিশ্চই কারুর কুনজর লেগেছে, হাজার কুড়ি টাকা খরচ করে একটা গোমেদের আংটি বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলে পরিয়েদিলেই কেল্লাফতে।
এভাবে রাবাংলা বেড়িয়ে, হাতে গোটাদুই আংটি ধারণ করে, গলায়-কোমরে আরও কিছু নজর-বিন্যাশি তাবিজ মাদুলি পরে মাস ছয়েক বাদে তুলিকা যখন শেষমেশ নিশার কাছে এসেছিল তখন সে নিজের মা-বাবাকেও বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছে। সারাদিন নিজের মনে কথা বলে যায়, খাবার দিলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, চান করে না সপ্তাহের পর সপ্তাহ।মাঝেমাঝে শুধু ডাইরি ভরে লেখে আর কিযেন সব আঁকিবুঁকি কাটে– তৃণাদেবী লুকিয়ে লুকিয়ে তা দেখেও তার মাথামুণ্ডু খুব কিছু বোঝেননি। নিরুপায় হয়ে আবার ডক্টর নিয়োগীকে ফোন করায় তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে নিশার চেম্বারের ঠিকানা দিয়ে অবিলম্বে দেখা করতে বলেন।
নিশার সাথে প্রথম দু’তিনবারের দেখায় কোনও কথাই বলেনি তুলি। তাঁর মা-বাবা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন যে সাইকিয়াট্রিস্টও তো কিছুই করে উঠতে পারছেন না তাঁদের মেয়েকে ঠিক করার মতো। অনেক ধৈর্য-সহকারে নিশা তাঁদের বুঝিয়েছিল যে তুলির যে অসুখ তা সারতে সময় লাগবে, অনেকদিন ধরে যে অসুখকে তিলে তিলে বাড়ার সময় দেওয়া হয়েছে, সে অসুখ সারানোর জন্যও সময় প্রয়োজন। বুঝিয়েছিল স্কিৎজোফ্রেনিয়া নামক অসুখটা প্রায় সমাজে প্রতি ১০০-২০০ জনে একজনের হয়, অল্প বয়সেই বেশীরভাগ সময়ে এই অসুখের লক্ষণ প্রথম দেখা দেয়, এবং কিছু জন্মগত, কিছু পারিবারিক আর কিছু সামাজিক কারণ মিলিয়ে কীভাবে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রায় মাসদুয়েক ওষুধ খাওয়ার পর তুলিকা কথা বলা শুরু করেছিল নিশার সাথে। খানিক ছবি এঁকে, খানিক ডাইরি লিখে জানাতে শুরু করেছিল কীভাবে গত কয়েক মাসে তার কাছে বাস্তব আর কল্পনা যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। অন্তর্লীনা নামের এক মেয়ে নাকি তার সাথে সুখদুঃখের গল্প করত সারাক্ষণ। রাস্তায় বেরোলে কিংবা স্কুলে গেলে সে কানে কানে বলত,” ওই দেখ তুলি, ওরা সব তোমার নামে গুজব রটাচ্ছে”, বাড়িতে বলত “মা-বাবা তোমাকে মোটেই পছন্দ করেনা; করলে কি তোমার কষ্টগুলো বুঝত না?” অন্তর্লীনা সামনে আসত না, আসতে বললে বলত, “সামনে এলে আমিও যদি তোমার আশপাশের সব মানুষগুলোর মতন তোমার থেকে দূরে সরে যাই?”
চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর অল্প অল্প করে বাস্তবে ফিরে আসতে থাকে তুলিকা, বুঝতে পারে অন্তর্লীনা তারই মনের অন্তরবর্তী চিন্তাভাবনার একটা কল্পিত বহিঃপ্রকাশ। নিশার প্রতিনিয়ত সাহায্যে, ভয় কাটিয়ে স্কুলে ফেরত যেতে শুরু করে সে। ক্লাসমেটরা কিংবা টিচাররা তার এই লম্বা ছুটি আর কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া তার মানসিক রোগ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে সে কি বলবে সেও ভেবে বার করে সে নিজেই। একসময় যারা ওকে সবার থেকে ভালো বলে একঘরে করে রেখেছিল, এখন তারা ওকে পাগল বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। কিন্তুতুলিকাওদমবারপাত্রীনয়। স্কুলের আ্যানুয়াল ফাংশানে ক্লাসটিচার মিসেস বাসুর অনুমতি নিয়ে সে নিশার সাহায্যে সবার জন্য সংক্ষেপে বিভিন্ন মানসিক রোগের ওপর একটা বক্তৃতা দেয়। সবশেষে বলে—”আমার পেছনে আমায় নিয়ে কথা না বলে তোমরা আমায় সোজাসুজি যা প্রশ্ন করার করো, আমি তোমাদের সব বুঝিয়ে বলব। শুধু তোমাদের প্রতি একটাই অনুরোধ- যাদের তোমরা তোমাদের মতন করে বুঝতে পার না, তাদেরকে কোনঠাসা করে দেওয়ার বদলে তাদেরকে একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করো- কারণ তারাও তোমার বন্ধু হতে পারে।”
মোবাইলের শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে নিশা। মায়ের ফোন। নিশ্চই বাড়ি ফেরার কতো দেরী জানতে চাইছে। জানলা দিয়ে দেখে বৃষ্টিটা অল্প ধরেছে। টেবিলের ওপর রাখা মিষ্টির বাক্সটা তুলে নেয় হাতে, আর যত্ন করে নেয় ফ্রেমে বাঁধানো ক্যানভাসটা। মাধ্যমিক পেরিয়ে তুলিকা ক্লাস ইলেভেন শুরু করেছে কয়েক মাস আগে, নিজের পছন্দ মতন আর্টস নিয়েছে। সাথে সাথে খুব মন দিয়ে আঁকা শিখছে, তার ইচ্ছে স্কুল শেষ করে আর্ট কলেজে পড়বে। অনেক দোটানার পর তৃণাদেবী আর অর্পণবাবুও মানতে শিখেছেন যে সন্তানকে শুধু পড়াশোনার সুযোগ আর বাকি সবরকম সুবিধে দিলেই হয় না, বাবা-মায়ের দায়িত্ব তাকে একটা ভরসার জায়গা তৈরি করে দেওয়া, যেখানে এসে সে নিজের সবটুকু নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিতে পারে।
ভালো করে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে নিয়ে বেরোনোর আগে তুলিকার নিজে হাতে এঁকে তাকে উপহার দেওয়া ছবিটা আরেকবার মুগ্ধ হয়ে দেখে সে। একটা কালো রাত্তিরের মাঝে একটা একলা মানুষ দাঁড়িয়ে-নীলচে-সাদা তারাদের একটা বৃত্ত তাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে, ঠিক যেন অন্ধকারটাকে ঠেলে দূরে সড়িয়ে দিতে চেয়ে। নীচে পরিষ্কার হাতের লেখায় লেখা-“you showed me the light in my darkness” । সিঁড়ি বেয়ে গ্যারেজের দিকে নামতে নামতে নিজের স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে যায় নিশার। সেই মিসেস দাস, মিসেস মিত্র, মিস ঘোষ কীভাবে তাকে তার একাকীত্ব থেকে ঠেলে বার করে এনেছিলেন, রাস্তা দেখিয়েছিলেন বুক ফুলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সেইখান থেকেই তো তার নিজের স্বপ্ন দেখার শুরু; ‘পাগল’, ‘মেন্টাল’, একঘরেদের বুঝতে চাওয়ার, আপন করে নেওয়ার।
গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাতের কলকাতার বুক বেয়ে ধেয়ে চলে নিশা। মনে মনে ঠিক করে এবারের টিচার্স ডে-তে আবার সেই ছোটবেলার মতন হাতে আঁকা কিছু কার্ড বানাবে সে। সেই মিসেদের জন্য যাঁরা তাকে তার আধো-অন্ধকারে তারা হয়ে আলো দেখিয়েছিলেন এতোদূর স্বপ্ন দেখবার।