চারমাসের যুদ্ধের পরে ক্ষীণ একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের তাবড়-তাবড় গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টায় এবং বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সেই প্রচেষ্টায় অনেকটা দূর অবধি এগিয়েও গেছে।
এই মুহূর্তে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনার ইন্সটিটিউট এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক পোস্টডক্টরাল-মাইক্রোবায়োলজিস্ট এলিসা গ্রানাটোর শরীরে ভ্যাক্সিন-ক্যান্ডিডেটটিকে প্রবেশ করানোর সাথে সাথেই তাঁরা পা রেখেছেন ভ্যাক্সিন তৈরি সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার হিউম্যান ট্রায়ালের ধাপটিতে। কয়েক মাসের মধ্যেই এর ফলাফল সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যাবে।
এরই সাথে আরও একটি সুখবর রয়েছে। কল্যাণীর কাছেই ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’-এর দুই বাঙালি বিজ্ঞানী ডঃ পার্থপ্রতিম মজুমদার ও ডঃ নিধানকুমার বিশ্বাস করোনা ভাইরাসের জিন-ম্যাপ তৈরির কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এই কাজের জন্য তাঁরা ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের গোড়া অবধি ৫৫টি দেশের ৩,৬৩৬ জন করোনা-রোগীর দেহ থেকে প্রাপ্ত ভাইরাস-নমুনার RNA সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। আর সেই গবেষণা লব্ধ ফলাফল অতি সম্প্রতি নথিবদ্ধ হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এ। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিরাট সাফল্য, কারণ এই অদৃশ্য জীবাণুটিকে ঘায়েল করার জন্য তার খোল-নলচে জানাটা খুব দরকারি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই জানাটা কেন জরুরি? নোভেল করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন তৈরি বিষয়টিই বা কতটা কঠিন এবং কেন?
আমরা এতদিনে প্রায় সকলেই জেনে গেছি যে, নোভেল করোনা ভাইরাস (nCoV-2019) একটি RNA ভাইরাস। এই RNA এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘রাক্ষসের প্রাণভোমরা’। যখন কোনো ব্যক্তির দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তখন সে প্রথমে ব্যক্তির বিশেষ দেহকোষের সাথে নিজেকে আটকে নেয়, এরপর শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে এবং RNA এর অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করার মধ্য দিয়ে সংখ্যায় বাড়ে। এখন এই কপি তৈরির সময় একটু-আধটু ভুল-চুক হয়েই থাকে। ফলতঃ, সন্তান-প্রতিলিপিরাও একটু-আধটু আলাদা হয়ে যায় মা – বাবার আসল রূপটির থেকে। বিজ্ঞানীরা একেই বলে থাকেন ‘মিউটেশন’। যদিও করোনা ভাইরাসটির ক্ষেত্রে এর প্রভাব কিন্তু আর একটু-আধটু হেরফেরের মধ্যে আটকে থাকছে না। ক্রমশ, ভিন্ন চেহারা নিচ্ছে ভাইরাস এবং আদতে, বাদুড় জাতীয় প্রাণীর শরীরে এতকাল বাসা বেঁধে থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের দেহে ভালো ভাবে বাসা বাঁধবার আয়োজনও জোরালো মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে থাকছে।
মাত্র এই ক’মাসের মধ্যেই এই দুষ্টু ভাইরাসটি মোট ১০ বার মিউটেশন করে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর চিনের ইউহানে যে নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক ব্যক্তির মৃত্যু হলো, সেটি ঘটিয়েছিল ‘ও’ টাইপ। তারপরে এই কয়েকমাসের ভেতরেই তৈরি হয়েছে আরও ১০টি টাইপ। এদের মধ্যে বর্তমানে সব চেয়ে সংক্রামক ‘এ২এ’। ৬০ শতাংশ দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে এরা একাই।
এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। করোনা ভাইরাস কিন্তু পৃথিবীতে নতুন আবির্ভূত কোনও ভাইরাস নয়। প্রথম করোনা ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৩১-এ গৃহপালিত মুরগীতে। তখন ভাবা হত যে, Corona viridae পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য মূলত গরু, শুয়োর, উট, মুরগী কিংবা বাদুড় ইত্যাদি পশু-পাখিদের মধ্যেই সংক্রমণ ছড়ায়, এদের জ্বর-ডায়ারিয়া ইত্যাদি করে থাকে। ১৯৬৫ তে মনুষ্যদেহে প্রথমবার খোঁজ মেলে করোনা ভাইরাসের (HCoV-229E)। এই মুহূর্তে, করোনা ভাইরাস পরিবারে মোট সাত ধরণের সদস্যকে সনাক্ত করা গেছে, যারা মনুষ্যদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এদের মধ্যে চার সদস্য পুরনো এবং আপাত নিরীহ। তারা আমার-আপনার শরীরে সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি (common cold)-এর জন্য দায়ী। জটিল রেসপিরেটরি সিনড্রোম এরা করে না। ২০০২ সাল অবধি তাই করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের তেমন মাথা-ব্যথাও ছিল না।
কিন্তু, কখনো কখনো ভাইরাসগুলি পশু-পাখিকে সংক্রমণ করার ফাঁকেই নিজেদের বিবর্তিত করে মানুষের দেহে সংক্রমণ করবার ক্ষমতা লাভ করে ফেলে। এই পরিবারের বাকি তিন সদস্যই সাম্প্রতিক সময়ে সেভাবেই উঠে এসেছে বলে অনুমান।
এরা হলো,
১. SARS-CoV— Severe Acute Respiratory Syndrome-এর জন্য দায়ী। প্রথম ধরা পড়ে চীনে, ২০০২ সালে।
২. MERS-CoV–Middle East Respiratory Syndrome-এর জন্য দায়ী। প্রথম ধরা পড়ে সৌদি আরবে, ২০১২ সালে।
এবং
৩. 2019-nCoV–অর্থাৎ যেটি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচিত COVID -19 রোগের এর জন্য দায়ী।
এই ত্রয়ী বাকিদের মতো আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে ঘাঁটি গেড়ে মামুলি সর্দি-কাশি নয়, বদলে আরও গভীরে গিয়ে আমাদের লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে থাবা বসায়। এদের মধ্যে সার্স-২০০২ করোনা এবং নোভেল করোনা মানুষের শ্বাসনালীর কোষে Angiotensin-Converting Enzyme 2 (ACE2) নামে যে প্রোটিনটি আছে তাকে আংটার (receptor) মত ব্যবহার করে নিজেদেরকে সেটির সাথে বেঁধে ফেলে। ভাইরাসের দেহের বাইরে যে গ্লাইকোপ্রোটিন দ্বারা নির্মিত স্পাইক বা কাঁটা থাকে, সেগুলির সাহায্যেই জুড়ে যাওয়ার এই কাজটা হয়ে থাকে। এই তিন ভাইরাসের স্পাইকের অণু-প্রোটিনগুলির রসায়নে কিন্তু খানিক তফাত থাকে (differences in amino acids of the receptor binding domain/motif)। তাই শ্বাসযন্ত্রের ঐ আংটার সাথে এদের কুটুম্বিতাও আলাদা আলাদা মাপের। দেখা যাচ্ছে, nCov-2019-এর বাঁধনের জোর SARS-CoV (2002) থেকে ১০-২০ গুণ বেশি। তাই সংক্রমণের হারও অনেক বেশি।
এখন, এই ভাইরাসের ঘন ঘন মিউটেশন করতে পারার ক্ষমতাটাই ভ্যাক্সিন তৈরির ক্ষেত্রে আসল চ্যালেঞ্জ।
কারণ, ভ্যাক্সিনের মারফত আসলে মানুষের শরীরে ভাইরাসের কিছু অংশ-বিশেষ কিংবা খোদ ভাইরাসটিকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চমকে গেলেন নাকি? উঁহু! ঘাবড়ানোর কিছু নেই। হয় শত্রুর অস্ত্র-শস্ত্র কেড়ে-কুড়ে হাত-পা পিছমোড়া করে বেঁধে অথবা তাকে মেরে ফেলে তার লাশটা শুধু শরীরে ঢোকানো হয়! উদ্দেশ্য একটাই। ভাইরাসটিকে শত্রু হিসেবে শরীরের রোগ-প্রতিরোধকারী কোষগুলোকে চিনিয়ে দেওয়া। আমাদের দেহে যখনই কোন অচেনা বস্তু (foreign bodies) প্রবেশ করে, দেহের ইমিউন সিস্টেম শত্রু (অ্যান্টিজেন)-জ্ঞানে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রক্তের শ্বেতকণিকা (white blood cells) বা লিউকোসাইটস এই যুদ্ধের সেনানী। দেশের ডিফেন্স সিস্টেমে যেমন নৌসেনা, বায়ুসেনা, সীমান্তরক্ষাকারী সেনা ইত্যাদি বহুবিধ সেনা থাকে, শরীরের ডিফেন্স সিস্টেমেও অনেক ধরনের সৈন্য-কোষ থাকে।
এদের মধ্যে লিম্ফোসাইটস-সেনারা শুধু অস্ত্র বানিয়ে শত্রু-অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করে আমাদের প্রাণই বাঁচায় না, উপরন্তু শত্রুকে রীতিমতো স্মৃতিতে ধরে রাখে! পরবর্তীকালে আবার একই শত্রুর আগমন ঘটলে আস্তিন থেকে সেই বিশেষ অস্ত্রটিই বের করে, যা দিয়ে শত্রু আগেরবার ঘায়েল হয়েছিল।
ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে নিরস্ত্র/মৃত শত্রুকে শরীরে প্রবেশ করিয়ে ঐ শত্রুর জন্য সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি বানিয়ে দেহকে আগে থেকে প্রস্তুত রাখা হয় পরবর্তীতে সশস্ত্র শত্রুর মোকাবিলার জন্য।
কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাসটি জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে যেভাবে দ্রুত নিজেকে বদলাচ্ছে, তাতে দেহের মেমোরি সেলগুলিকে একবার চিনিয়ে দিলেও পরের বার ভাইরাসের মিউটেটেড ফর্ম এসে তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ধরুন আপনি জেনে এসেছেন, আপনার শত্রুটি ৫ ফুট লম্বা, শ্মশ্রু-গুম্ফহীন, ফর্সা একটি লোক। আপনি সেইরকম একটা লোককে পেটাবার জন্য ওত পেতে আছেন। অথচ, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল শত্রু ভোল বদলে ৪ ফুট লম্বা, চাপদাড়ি-গোঁফ সমেত কৃষ্ণকায় এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। আপনি কি তখন আর চিনতে পারবেন আপনার শত্রুটিকে? এই বিষয়টিও সেরকমই।
ভাইরাসটির রকম-ফেরগুলো এজন্যই পুরোপুরি জানা প্রয়োজন। না-হলে প্রতিষেধক তৈরি হলেও তা কিছুদিন পরে আর কাজ করবে না। বাঙালি বিজ্ঞানীদের হাত ধরে ভাইরাসটিকে আরও ভাল করে চেনার এই পাঠ নিঃসন্দেহে দুনিয়া জুড়ে ভ্যাক্সিন তৈরির দৌড়কে ভিক্ট্রি ল্যাপের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে।
আমরা আশাবাদী।