গল্প হলেও সত্যি
কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলে যে সমস্যা হয়, সুদর্শনের হয়েছে সেই জ্বালা। ডান চোখের নীচে, গাল আর নাকের ডান পাশটা জুড়ে সাদা একটা বদখত দাগ। মা’র কাছে শুনেছে, ওর যখন বছর পাঁচেক বয়স, তখন ছোট্ট একটা দাগ দিয়ে শুরু। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে বাড়তে, না, সারা শরীরে নয়, মুখের ওই অংশেই একটা বেশ বড় জায়গা দখল করে থমকে আছে দাগটা। সবাই হাসাহাসি করে সুদর্শনকে নিয়ে। সুদর্শন ঠিক করেছে, এবার নিজের নামটাই বদলে ফেলবে এফিডেবিট করে। তাতে যদি সমস্যাটা একটু কমে!
সেবার কালীপুজোয় শৈবাল গিয়েছিলেন ওর মামারবাড়িতে। প্রতিবারই যায়। বেশ ধুমধাম করে কালীপুজো হয় সেখানে। আর হয় বেশ জমজমাট একটা আত্মীয় সমাগম। মামাতো-মাসতুতো ভাইবোনেদের এক বিশাল ব্যাটেলিয়ান। সবাই মিলে হইহই করে বাজি পোড়ানো হয়। আর সে বাজির বেশির ভাগটাই তৈরি করা হয় বাড়িতেই। তো, সেই তুবড়ি বানাতে গিয়েই হয়ে গেল কেলেঙ্কারি। আগুন লেগে সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ভাগ্য ভালো, আগুনটা ছড়াতে পারেনি। শুধু শৈবালের ডান হাতটা গেল বিশ্রীভাবে পুড়ে। ঘা সেরে গেল, শুধু রয়ে গেল একটা সাদা দাগ। হাতটা লুকিয়ে রাখে শৈবাল। রাখতে হয়। কারণ কারও চোখ পড়লেই সেই এক প্রশ্ন—কী করে হল ওই দাগটা?
সমস্তিপুরের সম্বন্ধটাও ভেঙ্গে গেল। ওরাও ‘না’ বলে দিয়েছে। রামেশ্বর প্রসাদের চোখে ঘুম নেই। একমাত্র মেয়েটার এখন একুশ বছর বয়স। দেখতে যেমন সুন্দর, স্বভাবেও তেমন। পড়াশোনাতেও খুব তেজি। শাদী-বিয়ের কথাও চলছে। তবে যেখানেই সম্বন্ধ হয়, সেটাই ভেঙ্গে যায়। এই চলছে আজ বেশ কিছুদিন। না, মেয়ের কোনও দোষ নেই।
দোষ রামেশ্বর প্রসাদের নিজের। দোষ মানে একটা দাগ। সাদা দাগ। নীচের ঠোঁটে, ডান দিকে। জ্বর-ফোস্কা উঠেছিল। তারপর সেরেও গিয়েছিল। যেমন যায়। সেরে গিয়ে জায়গাটা সাদা হয়ে গেল। তারপর কত ডাক্তার-বদ্যি-হাকিম-কবিরাজ। কিচ্ছু হল না। দাগটা যেমন, তেমনি থেকে গেল। আর এই দাগটার জন্যই একের পর এক সম্বন্ধ ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর মেয়েটার।
শবনম এখন কী করবে? কাকে বলবে এই সমস্যার কথা? আজ দিন দশেক হল ও লক্ষ্য করছে ওর বাঁ কাঁধের ঠিক নীচের অংশটায় একটা সাদা দাগ। প্রথমে আবছা ছিল, এখন বেশ স্পষ্ট। কী যে হবে! কী করে হল কে জানে!
এটা কি কুষ্ঠ রোগ?
সাদা দাগ, কালো অক্ষর
সাদা দাগ—এই ক’টা মাত্র অক্ষর। অথচ অজস্র মানুষের কাছে তো বটেই তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও এ এক মস্ত বড় সমস্যা। বিপদ। অভিশাপ।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা ভুল ধারণা। যেমন, সাদা দাগ মানেই কুষ্ঠরোগ, ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে তো বটেই, বংশগতও। ফলে সামান্য নিরীহ একটা চর্মরোগ আজ রীতিমতো এক সামাজিক সমস্যা হয়েই দেখা দিয়েছে।
কেন হয়?
কেন হয় এই সাদা দাগ? প্রথমেই বলি—শ্বেতী মানেই সাদা দাগ, কিন্তু সাদা দাগ মানেই কিন্তু শ্বেতী নয়।
যেমন শৈবালের পুড়ে-গিয়ে-হওয়া সাদা দাগের ডাক্তারি পরিভাষা ‘পোস্টবার্ন লিউকোডার্মা’, আদৌ শ্বেতী নয়।
আবার রামেশ্বর প্রসাদের ঠোঁটের দাগটাও হারপিস সিমপ্লেক্স-এর সংক্রমণজনিত লিউকোডার্মা। এছাড়া কিছু জডুল জাতীয় সাদা দাগ, যেমন-নিভাস অ্যানিমিকাস বা নিভাস ডিপিগমেন্টোসাস, সেগুলোও কিন্তু শ্বেতী নয়।
আরো অজস্র কারণ আছে সাদা দাগের। যেমন জন্মগত ত্রুটির কারণে হওয়া অ্যালবিনিজম। এর আবার কয়েকটি ধরন আছে।
এছাড়া পাইবলডিজম। আর কিছু দুষ্প্রাপ্য সিন্ড্রোমগত অসুখে সাদা দাগ হতে দেখা যায়। বিপাক জনিত গোলযোগ, যেমন—ফিনাইল কিটনিউরিয়া, হরমোন-সংক্রান্ত কিছু অসুখ, যেমন—হাইপারথাইরয়েডিজম-এ সাদা দাগ দেখা দিতে পারে। অপুষ্টিজনিত অসুখ কোয়াশিয়রকর-এ ভোগা শিশুর গায়ে দেখা দিতে পারে সাদা দাগ।
হ্যালো নিভাস নামে একটা অদ্ভুত অসুখে শরীরে কোনও অংশে কালো তিলের চারদিকের ত্বকের রং সাদা হয়ে যায়। মনে হয় যেন জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে তিল্টা। আবার আর একটা অদ্ভুত অবস্থার কথা বলি। নামটা খুব লম্বা। ইডিওপ্যাথিক গাটেট হাইপোমেলানোসিস। অজানা কারণে খুব ছোট-ছোট সাদা দাগ হতে থাকে শরীরের এখানে-সেখানে। দাগগুলো সংখ্যায় বাড়ে, আয়তনে নয়। আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এটাও শ্বেতী নয়।
তাহলে শ্বেতী কী?
শ্বেতী হল ত্বকের এমন একটি বিশেষ অসুখ, যেখানে ত্বকের সাদা দাগটার অথবা দাগগুলোর কোনও সরাসরি কারণ নির্দিষ্ট করা যায় না।
আপনা থেকেই রং হারিয়ে যায় আক্রান্ত অংশ থেকে। কেন হয় সেটা না জানা গেলেও কীভাবে হয় অথবা হলে কী হয়, সেটা জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
আমাদের ত্বকের বাইরের দিকের ভাগটাকে বলে এপিডার্মিস। এই এপিডার্মিসের আবার সবচেয়ে নীচের স্তরটি হল বেসাল স্তর। মেলানোসাইট নামের অদ্ভুতদর্শন কোষগুলো থাকে এই বেসাল স্তরেই। এদের কাজই হল রং তৈরি করা। রঙের দানা মালানোজোম তৈরির সেই জটিল প্রক্রিয়াটার নাম হল মালানোজেনেসিস। আশেপাশের ত্বক-কোষ কেরাটিনোসাইটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করে এক-একটি ইউনিট। আমাদের গায়ের রং কেমন হবে না-হবে, সেটা নির্ভর করে এই এপিডার্মাল মালানিন ইউনিট-এর ওপর।
কারখানায় লক-আউট হবার মতো রং তৈরির এই কারখানাতেই কিন্তু কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে আপনা-আপনি। ফলে বন্ধ হয়ে যায় মালানোজেনেসসিস বা ত্বকের রং তৈরির প্রক্রিয়া। এর জন্য রং হারিয়ে যায়। ফুটে ওঠে ধবধবে দুধ সাদা দাগ। ব্যাথা হয় না, জ্বালা হয় না, শুধু সাদা দাগ। নিঃশব্দে বাড়তে থাকে। সংখ্যায়, আয়তনে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধীরে ধীরে।
এই হল শ্বেতী।
শ্বেতীর রকম-সকম
পৃথিবীর যে-কোনো দেশেই জনসংখ্যার দুই থেকে আট শতাংশ মানুষ এ-রোগে আক্রান্ত হন। তবে সাদা চামড়ার তুলনায় কালো বা বাদামী ত্বকে এ-রোগ বেশি প্রকট হয় বলে আমাদের মতো দেশে এ-নিয়ে সমস্যাটাও বেশি। বেশিরভাগ সময়েই ‘নির্দিষ্টভাবে সীমাবদ্ধ সাদা দাগ’—এভাবেই প্রকাশ পায় অসুখটি। আবার অনেক সময় এর প্রকাশভঙ্গিতে কিছু বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। যেমন—অনেক সময় শ্বেতীর সাদা দাগটিকে ঘিরে থাকে একটা আপাত গাঢ় রঙের অঞ্চল। ঈষৎ লাল হয়ে সামান্য প্রদাহমূলক পরিবর্তনও দেখা যেতে পারে দাগটিতে।
ট্রাইক্রোম ভিটিলিগো আবার রঙের স্তরবিন্যাসের এক আশ্চর্য প্রকাশ। এক্ষেত্রে শ্বেতীর দাগের চারপাশে হাল্কা রঙের একটা স্তর দেখতে পাওয়া যায়, আবার তারও চারপাশে গাঢ় রঙের আর একটা স্তর। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন শ্বেতীর বিস্তারে একটা সামাঞ্জস্যের ছাপ। যেমন ডান হাতের কনুইয়ে হলে বাঁ হাতের কনুইয়েও হতে পারে। ঠিক তেমনভাবে দু’দিকের হাঁটু, পা, স্তনবৃন্ত, দু’হাতের আঙ্গুল আক্রান্ত হতে দেখা যায় অনেক সময়েই।
মাথা, হাঁটুর নীচের পায়ের অংশ, গোড়ালির পাশে, আঙ্গুল, কনুই, ঠোট, লিঙ্গের অগ্রভাগ, সত্যি বলতে কী, শরীরের এমন কোনো অংশ নেই যেখানে শ্বেতী হয় না।
শ্বেতীগ্রস্ত ত্বকের লোম সাদা হয়ে যেতে পারে। একে বলে লিউকোট্রিকিয়া বা অ্যাক্রোমোট্রিকিয়া। লোমের গোড়ায় থাকা হেয়ার ফলিকল হল মেলানোসাইট তৈরির উৎসস্থল। সেই লোমই যদি সাদা হয়ে যায়, তার অর্থ হল উৎসস্থলে খরা। অর্থাৎ রং তৈরি হওয়ার ব্যাপারে গোড়াতেই গলদ। তাই শ্বেতীর দাগে সাদা লোম, খুব একটা ভালো চিহ্ন নয়।
(চলবে)