অভয়া’ আন্দোলন প্রসঙ্গে আলোচনায় দুটো শব্দবন্ধ বারবার উঠে আসছে, ‘নাগরিক আন্দোলন’ আর ‘শ্রমজীবী আন্দোলন’।
‘নাগরিক’ কিন্তু সকলেই। ‘নগরের বাসিন্দা’ এই অর্থে যদি নাগরিক হয়, তবে citizen অর্থে গ্রামের মানুষও কিন্ত নাগরিক। তাছাড়া, নগরেও অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ থাকেন।
সাধারণভাবে, যাঁরা কলমজীবী তাঁদেরই বুদ্ধিজীবী বলা হয়। নানা ক্ষেত্রে যাঁরা রুজি-রোজগারের জন্য প্রধানত কলমের উপরেই নির্ভরশীল। যাঁদের পেশায় কলম দরকারই নেই, তাঁদের যেন বুদ্ধি না থাকলেও চলে! অথচ, শারীরিক পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে যাঁদের বেঁচে থাকতে হয়, সেই শ্রমজীবীদের কাজে অসাধারণ বুদ্ধির প্রয়োজন।
একটা উদাহরণ। একদিন আগেই ঝাড়খণ্ডে দেখলাম, ধান রোপনের সময় জমিতে যথেষ্ট জল জমে আছে। পাশের নদী বর্ষার জলে টইটম্বুর, প্রচণ্ড স্রোতে জল বইছে। দুয়েকদিনের বৃষ্টিতেই হয়তো সেই জল ছয় ইঞ্চি বেড়ে যাবে জমিতে। এই সমস্যা সমাধানের উত্তর কোনও বইতে বা তত্ত্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না; অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বুদ্ধি খাটিয়েই কৃষকদের পথ বের করতে হয়। অর্থাৎ, বাস্তবজীবনে এই মানুষগুলো অনেক বেশি ‘বুদ্ধিজীবী’, আমাদের চেনা-পরিচিত কলমজীবীদের চাইতে।
দ্বিতীয় উদাহরণ। আমি নিজে দেখেছি, ছত্তিশগড়ে দল্লী-রাজহারার ‘শহীদ হাসপাতাল’-এ। শ্রমজীবী মানুষের বুদ্ধিতে, কামারশালার মামুলি হাপোরকে কাজে লাগিয়ে (এবং ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডাঃ শৈবাল জানা ইত্যাদিদের উদ্যোগে) কী অসাধারণ প্রযুক্তিতে, রুগীদের জন্য সাকশন মেশিন তৈরি করা হয়েছে সেখানে। তাই দিয়ে নিয়মিত কাজ চলে হাসপাতালে। যে মেশিন বাজার থেকে কিনতে গেলে কতো হাজার বা লক্ষ টাকা খরচ হতো, আমার জানা নেই।
প্রচলিত কু-শিক্ষার কারণে, শ্রমজীবীদের খাটো করে দেখা, তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সমাজের ধাতস্থ হয়ে গেছে! বাস্তব এটাই শেখায়, নানারকম ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে, কলমজীবীদের উপর খুব বেশিদিন ভরসা করা যায় না। তাঁরা কখন এবং কী কারণে যে পাল্টি খাবেন, তা সম্ভবত ‘ভগবান-আল্লাহ্’ কেউ-ই জানে না! তৃণমূল কংগ্রেস, ‘নকশাল’, বিজেপি, সিপিআই (এম), কংগ্রেস ইত্যাদির মধ্যে অনবরত ‘বুদ্ধিজীবী’ আয়ারামগয়ারাম-দের দেখলেই তা বোঝা যায়।
ব্রিটিশ আমলে আমরা দেখেছি, ৩০-এর দশকে শোলাপুর কমিউন; ৪০-এর দশকে নৌ-বিদ্রোহ। ব্রিটিশ-বিরোধী এইসব লড়াইয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন এবং সংগ্রামের নতুন রাজনৈতিক ভাবনা হাজির করেছিলেন জনগণের সামনে। ব্রিটিশ রাজের পরে, ১৯৪৮-১৯৫২ সালে তেলেঙ্গানায়, কয়েক লক্ষ কৃষক সংগ্রাম করেছেন শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং পুলিশ ও ভূস্বামীদের অত্যাচারে কয়েক হাজার কৃষক নিহত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে, দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি অঞ্চলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে, পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮-জন কৃষক-শ্রমিক রমণী, ২-টি শিশু এবং ১-জন পুরুষ সহ মোট এগারোজন শ্রমজীবী মানুষ। ২০০৭ সালে, মেদিনিপুরের নন্দীগ্রামে জমিকে কেন্দ্র করে লড়াইয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দিলেন ১৪-জন শ্রমজীবী মানুষ।
উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। মোদ্দা কথা যেটা বলতে চাইছি তা হলো, বহু কলমজীবী এইসব আন্দোলনের সমর্থনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, ঠিকই। কিন্তু কলমজীবীদের আন্দোলন স্বাধীনভাবে শ্রমজীবীদের সংগ্রামের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি কখনও।
একটা গোড়ার কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। কলমজীবী মানুষ চাইলে, সমাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে – ঘরে বসেও একাএকা রুজি-রোজগার করতে পারেন। কিন্তু শ্রমিক-কৃষক শ্রমজীবী মানুষ, তাঁদের রুজি-রোজগারের জন্যে কখনোই একা একা বাঁচতে পারেন না। কী কৃষক, কী শ্রমিক। তাঁদের যেকোনও ‘সৃষ্টি’ সবসময়েই সংঘবদ্ধ উৎপাদনশীলতার ফসল। তাই, বাঁচার তাগিদেই তাঁদের একসঙ্গে থাকতে, চলতে ও কাজ করতে হয়। কলমজীবী মানুষ ‘ঠিক-বেঠিক’ বিচার করে ঐক্যবদ্ধ হন। কিন্তু শ্রমজীবীরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষা পান প্রতিদিন কাজের ময়দানে; জীবনের তাগিদে; চলতেচলতে। তাই বৃহত্তর সামাজিক কারণে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পথ চলার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে শ্রমজীবীদের মধ্যে।
‘যুক্তফ্রন্ট’ কিম্বা ‘বামফ্রন্ট’ সরকারের অনেক অপরাধ ছিলো। কিন্তু তার থেকে রেহাই পাবার জন্য যাঁরা হাজার হাজার বামপন্থীদের হত্যাকারী ও অত্যাচারী সিদ্ধার্থ রায় ও রঞ্জিৎ গুপ্ত’র মন্ত্রশিষ্য প্রিয়-সুব্রত-সোমেন – এই ‘ত্রিরত্ন’-র উত্তরসূরিদের বদান্যতার উপর ভরসা রেখেছিলেন, তাঁরা অনেকেই আজ হাড়েহাড়ে বুঝছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত ভাবেই সিদ্ধার্থ রায়ের মন্ত্রশিষ্যা। সুব্রত মুখার্জী ও সোমেন মিত্র তাঁর দলের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। শূণ্যগর্ভ ভাষণবাজি যাঁদের অন্যতম ‘সম্পদ’ হিসাবে বহুদিন ধরেই প্রমাণিত। ‘অভয়া’-র ধর্ষণ ও মৃত্যুর ভয়াবহতা, এবং তাকে কেন্দ্র করে অসভ্য বর্বর শাসক পক্ষের সর্বনাশা ভূমিকার দিকগুলো যদি শ্রমজীবী সমাজের কাছে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পৌঁছে দেওয়া যেতো, সত্যিই যদি “রাজপথ থেকে আলপথ” এই ঐতিহাসিক আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে পারতো বা পারে, ‘অভয়া’ আন্দোলনের মোড় ঘুরে যাবে। প্রতিটি সংসারের মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, কেউই যে বর্তমান আমলে নিশ্চিন্ত-নিরাপদ না, সেই বার্তা যদি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যেতো! শুধু ‘আরজিকর’ বা কলকাতা কেন্দ্রিক না হয়ে, এক বৃহত্তর গণ-আন্দোলনে পর্যবসিত হতে পারে। শাসকপক্ষের অশ্লীল গুমোর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। অন্য এক ইতিহাস রচিত হতে পারে।
সমাজে চোর-জোচ্চোর-জালিয়াত-খুনী-ধর্ষক ইত্যাদি সবসময়েই থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের অনেককে কাজেও লাগায় নানা সময়ে। কিন্তু তারাই যে একটা রাজনৈতিক ‘দল’ (!) তৈরি করবে এবং রাজনীতির জগতে ছড়ি ঘোরাবে, এমনটা কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি বঙ্গবাসী! কিন্তু প্রশাসনকে এই অন্ধকারের শক্তিগুলোকে মদত যোগাতে ও বাড়তে সুযোগ দেবে কিনা জনগণ, সেটাই আজ প্রধান ও জরুরি কথা। ‘অভয়া’-র ধর্ষণ ও খুন, আর পাঁচটা ধর্ষণ-খুন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা হলো প্রশসনিক তৎপরতায় সংঘটিত অপরাধ। এক বৃহত্তর ও বীভৎস চক্রান্তের ফসল। কিছু ডাক্তার, কিছু সরকারি দপ্তর, বহু আমলা, বেশকিছু পুলিশ অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কিছু মন্ত্রী, প্রশাসনবহির্ভুত লুম্পেন – সকলের যোগাযোগ, মদত ও তৎপরতা ছাড়া এই ভয়াবহ অপরাধ ঘটানো এবং তথ্য-প্রমান লোপাটের মতো ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতেই পারতো না। সিবিআই, পুলিশ, গোয়েন্দাদপ্তর… সকলের অপদার্থতা ও অনিচ্ছা প্রমাণিত! সেইজন্য, ‘অভয়া’ কাণ্ডের প্রকৃত বিচারের দাবিতে, শ্রমজীবী সমাজের সমর্থন, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি শুধু না, বরং সেটাই পথ। প্রশাসনের ঘেঁটি ধরে শেষপর্যন্ত “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” আদায়ের একমাত্র পথ সেটাই। সেই চেষ্টাই করতে হবে সকলকে। আরএসএস ও বিজেপির সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে যে ‘দল’ (!)-এর সৃষ্টি ও বৃদ্ধি, তাঁদের কাছ থেকে সহজসরল ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই বিন্দুমাত্র কোনও সুবিচার আশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। এঁদের তরফ থেকে নামিয়ে আনা প্রশাসনিক তথা রাষ্ট্রীয় হামলাকে প্রতিহত করা শুধুমাত্র কলমজীবীদের পক্ষে অসম্ভব।
মিথ্যা-টাকা-জালিয়াতি-পেশীনির্ভর নির্বাচনের মাধ্যমে বিধানসভায় কোন দল ক’টা আসন পেলো, কিম্বা লোকসভায় কাদের কতজন প্রতিনিধি আছেন, এইসব মামুলি হিসেবনিকেশ দিয়ে জনজীবনের নরকযন্ত্রণা থেকে আজও উদ্ধার পাওয়া যায় নি, যাবেও না। ধর্ষণ-খুনের মতো লাগাতার ঘটনাবলী থেকে রেহাই পেতে গেলে, কলমজীবীদের থেকে শ্রমজীবীদের দিকে মুখ ঘোরাতেই হবে। তাঁরাই আমাদের প্রকৃত রক্ষাকর্তা হয়ে উঠতে পারেন। গতবছর ১৪ অগাস্টে “মেয়েদের রাতদখল” কর্মসূচিতে শাসকগোষ্ঠীর পিলে চমকে গিয়েছিলো। আজও পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে, একদিনে লক্ষলক্ষ মানুষের এমন জমায়েত কেউ-ই দেখেন নি। শুধু মহিলা না। ওইদিন রাতে নারী-পুরুষ-রূপান্তরকামী-শিশু, কলমজীবী-শ্রমজীবী অসংখ্য মানুষ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রিক্সাওয়ালা, ছুতোর, কামার, মজুর, কলমিস্ত্রী, ওয়েল্ডার, প্লাম্বার ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণও ছিলো উল্লেখ করার মতো।
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে, পশ্চিমবাংলার প্রায় প্রতিটি জেলের মধ্যে ১৩-বার হত্যালীলা চালিয়ে, ৬৭-জন বিচারাধীন বামপন্থীদের হত্যা করা যাঁদের অতীত; বারাসত, ডায়মন্ড হারবার, কোন্নগর, বরাহনগর-কাশীপুর, হাওড়া, বেলেঘাটা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় কয়েকশো বাঙালি বামপন্থী মানুষকে গণহত্যায় খুন করা যাঁদের কীর্তি; আজও যাঁরা এইসব নারকীয় গণহত্যাকাণ্ডের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চান নি; বর্তমানেও নিত্যদিনই নিজেরা খুনোখুনির রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকেন, – তাঁরাই যখন অপরের দিকে ‘খুন’ করার অভিযোগ তোলেন, তখন এঁদের বেহায়া ও কদর্য রাজনীতির মুখোশটাই খুলে যায়। যাঁদের রাজনৈতিক দীক্ষাই হয়েছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধারায়; বৃদ্ধি আর পরিণতি ঘটেছে একই জনবিরোধী রাজনীতির একনিষ্ঠ সেবক হিসাবে; তাঁদের কাছ থেকে অবশ্য এর বেশি কিছু আশা করাও অর্থহীন।
এইসব লুম্পেন শক্তির উপর যাঁরা ‘সুশাসন’-এর দুরাশা করেন, তাঁদের জন্য ইতিহাসে শুধু একরাশ অনুকম্পাই জমা হয়ে থাকবে। ধুতরো গাছে আম আশা করলে হতাশ তো হতেই হবে।।
——————————————————————
১১ জুলাই ‘২৫, ডক্টরস ডায়ালগের ফেসবুক লাইভে পেশ করা বক্তব্যের পরিমার্জিত রূপ।










অনেক সম্ভাবনার কথা বলেছেন।কিন্তু কে করবে,কি ভাবে? এ প্রশ্ন এর উত্তরের কাছে অসহায় আজও।আর একটা প্রশ্ন ভাবায় e আন্দোলনের মধ্যে কোন রাজনৈতিক সমীকরণের খেলা নেই তো? লালগড়,নন্দীগ্রাম,সিঙ্গুর আন্দোলনের ফসল উঠল কাদের ঘরে? All these questions are blowing in air.