বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে থাকা ব-দ্বীপ আমাদের বাংলা। অসংখ্য নদী – শাখা নদীর উদার বিস্তার আর পেলব পলিমাটির সমৃদ্ধি অঞ্চলের মানুষের যাপনের পথে তুলে দিয়েছে প্রকৃতির অকৃপণ পাথেয় । উর্বর দক্ষিণবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ চার সমান্তরাল নদী (হুগলি, মাতলা, বিদ্যেধরী, ইচ্ছেমতি) ‘র অববাহিকা জুড়ে সেই কারণেই গড়ে উঠেছে মাছ চাষ ও কৃষিভিত্তিক জীবন ও জনপদগুলো । আর জন্ম নিয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ধুঁদুল, কাঁকড়া, গোলপাতা, খাগড়া – ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ গাছ সঞ্জাত বনভূমি : সুন্দরবন । সেই জঙ্গল আশ্রয় দিয়েছে বাঘ, সাপ, হরিণ, বাঁদর, মাছরাঙা, ঈগল, কুমির, কচ্ছপ, ডলফিন এবং আরো অনেক স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপের বিভিন্ন প্রজাতিকে। আন্তর্জাতিক স্তরে ভূতাত্ত্বিকদের চোখে এই সুন্দরবন ও তার বাস্তু (ecosystem) পৃথিবীর এক অনন্য সম্পদ । আমাদের ভারতীয়দের তথা বাঙালিদের কাছে এই অরণ্য একান্ত গর্বের বিষয় হয়ে ওঠার কথা ।
কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই বারবার বঙ্গোপসাগর থেকে উৎসারিত ঘূর্ণিঝড়ে এই নদী সমৃদ্ধ এলাকায় নেমে আসে চরম বিপর্যয়। সেখানকার চাষ বা মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ; স্থানীয় মানুষের বাড়ি ঘর ধ্বংস হয় – প্লাবিত হয় ; জীবন ও জীবিকার সর্বনাশ হয়।
গত দশকে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ যেমন এই অঞ্চলের মানুষের ও অরণ্য-বাস্তুর ক্ষতি করেছিল (সেবার যদিও অনেক বেশি সংখ্যায় বাঁধ ভেঙেছিল – কারণ সেবার ঝড় এসেছিলো ভরা কোটালে), এই দশকেও ঘূর্ণিঝড় ‘উম-পুন্’ তছনছ করে দিয়ে গেছে এলাকার জনজীবন ও নিসর্গ বিন্যাস। এবং সবচেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয় হলো, যখন বিশ্বজুড়ে ‘করোনা প্যান্ডেমিক’ – এর সংক্রমণ সার্বিকভাবে মানুষকে পর্যদুস্ত করছে ও দেশের তথা রাজ্যের অর্থনীতি অথৈ জলে তখন প্রকৃতি নিঃস্ব ভাতের পাতে ঝড় দিলো । তাতে এলাকার প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই যুগপৎ আঁধারে আশার আলো জ্বেলে দিলো মানুষই । সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই নয়া উদারনীতির অর্থশাস্ত্ৰ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী করে তোলার যে চক্রান্ত করছিলো – তা অচিরেই ভেঙে দিলো এই মহামারী ও ঘূর্ণিঝড় । ধর্ম-জাত-বর্ণ-লিঙ্গ ও মূলত শ্রেণী যে বিভেদের জাল বুনছিলো – তা যেন আজ ছিঁড়তে শুরু করেছে । সাম্যের জন্যে কোথাও যেন আবার একটা রব উঠতে শুরু করেছে ! সে কথা নিজে চোখে দেখছি বা শুনছি বা অনুভব করতে পারছি বলেই – ছোট মুখে এই বড়ো কথা বলছি ।
WBDF (West Bengal Doctor’s Federation), শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, আস্থা, ড: ভাস্কর রাও জনস্বাস্থ্য কমিটি, অগ্নিভ ফাউন্ডেশন, স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ ও রাসবিহারী শৈলুষিক – এর সমবেত উদ্যোগে আয়োজিত বিনামূল্যের চিকিৎসা শিবিরে গিয়ে সেই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো । শ’দুয়েক রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হলো। যাঁরা করলেন তাঁরা জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বয়সের ডাক্তার ও সমাজকর্মী । বিভিন্ন এলাকায় এমন শিবির হলো এই নিয়ে প্রায় পয়ঁত্রিশটা । সব’কটা শিবিরেই এলাকার প্রান্তিক মানুষ এলেন এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন সহনাগরিক হয়ে । সংখ্যাটা বড়ো কথা নয় – এই উদ্যোগ, এই দর্শন, এই স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিকতা – এই মানবতাই শেষ কথা ।
আর শুধু স্বাস্থ্য শিবির কেন ? এই বিপর্যয়ে প্রান্তিক মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কত মানুষ ! দেখে রক্ত টগবগ করে ফুটছে – কত ছাত্র, ছাত্রী, যুবক, যুবতী, বর্ষীয়ান অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছেন; সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দিকে । বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ছাত্র-যুব সংগঠন, সংস্কৃতিক কর্মীরা, গণমাধ্যমের যোদ্ধারা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকারকে সজীব রাখতে ছুটেছেন পাড়ায় পাড়ায় – গ্রামে গঞ্জে – অকৃপণ আর্থিক সাহায্য করেছেন । নিজের চোখে দেখেছি রাজ্য জুড়ে চতুর্দিকে তাঁরা তৈরী করে ফেলেছেন সামাজিক রান্নাঘর (community kitchen) । কেউ এগিয়ে এসেছেন কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ার মানুষের বা কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের সাহায্যে – কেউ সহনাগরিক হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন নাটক কিংবা টেলিভশন ধারাবাহিক বা চলচ্চিত্রের কর্মীদের। কেউ নিজেদের আঁকা ছবি বা তোলা ফটোগ্রাফ বিক্রি করে অর্থসাহায্য করেছেন। প্রশ্নটা নিজের চেষ্টায় কে কতটুকু করতে পেরেছেন – তা নয়; কথা হলো আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার পরাজয় ঘটছে – সামাজিক সমন্বয়ের বিকাশ হচ্ছে। ইতিহাস এই অধ্যায় ভুলবে না।
তাই আমি মনে করি, ‘এ বড়ো সুখের সময় নয় ‘ ঠিকই – তবু মানুষ বুঝি ‘সাতটা রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন’।
চমৎকার লেখা।
আরো বেশি করে লিখুন।
The author has shown the light at the end of the tunnel -the silver lining.As always there is magic in his pen.We request him to keep on writing such positive pieces so that we are rejuvenated
Thank you Kamalesh.
কি আর মন্তব্য করবো। বরং এই অসাধারণ লেখাটি শেয়ার করি যাতে আরও অনেক মানুষ পড়তে পারেন।