(মহামারী নিয়ন্ত্রণ করাটা যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবশ্যকর্তব্য এটা কেউই অস্বীকার করবেন না! তবে সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে কোভিড নয় এমন অসুখ, ক্ষুধা, অনাহার, বা এমনকি হতাশা থেকে মৃত্যুও সমান মর্মান্তিক। এই লেখাটি মহামারিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য নয়, বরং অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করার একটা চেষ্টা)
–নন্দিনী! আমার খুব ভয় করে ,বড় ভয় করে!
কোনও একদিন বুঝি জ্বর হবে ,দরজা দালান ভাঙ্গা জ্বর
তুষার পাতের মত আগুনের ঢল নেমে এসে
নিঃশব্দে দখল করে নেবে এই শরীরের শহর বন্দর।
বালিশের ওয়াড়ের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে ফেলা তুলো
এখন হয়েছে মেঘ,উঁড়ো হাস, সাঁদা কবুতর।
সেই ভাবে জ্বর এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে অন্য কোন
ভুমন্ডলে
নন্দিনী! আমার খুব ভয় করে ,বড় ভয় করে।
-পূর্ণেন্দু পত্রী (কথোপকথন – ৩৮)
মোটামুটি দুটো মত এখন চালু ,
এক ,
বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর অবস্থা, পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, মনুষ্য প্রজাতি অবলুপ্ত হবে বা নিদেনপক্ষে কলিযুগের অবসান তো হবেই ! আর কারো কিছু হোক না হোক, আমাদের বাড়িতে কারো কিছু যেন না হয় বাবা !
আর দুই,
ধুর, কিস্যু হবে না ! সব ফালতু ! ভারি তো পাঁচটা লোক মরেছে, আর তার আদ্ধেক হয় তবলিগি, না হয় বিলেত ফেরৎ ! তাতে আমাদের বয়েই গেছে ! বাজারটা তো করতে হবে নাকি !
কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে কয়েকটা পরিসংখ্যান তুলে ধরা যাক !
1. এ লেখার সময় পর্যন্ত সারা বিশ্বে নোভেল কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাতচল্লিশ লক্ষ তেইশ হাজার মানুষ আর প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় তিনলক্ষ তের হাজার মানুষ !
2. আর যাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সেই
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান চারকোটি মানুষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় সাড়ে আট কোটি !
3. ১৯১৮ র সেই কুখ্যাত স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় পাঁচকোটি মানুষের প্রাণ নেয় !
4. মধ্যযুগের ভয়ঙ্কর বিউবোনিক প্লেগের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তৎকালীন ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ! অর্থাৎ প্রায় ১৫-২০ কোটি মানুষ !
5. গতবছর ভারতে দেড়লক্ষ মানুষ মারা যান পথদুর্ঘটনায়, দিনে গড়ে ৪১৪ জন, আমরা লক্ষ্যই করিনি ! কোনো আলোচনাও করিও নি, শুনিও নি !
6. বছরে প্রায় লাখতিনেক শিশু আমাদের দেশে মারা যায় ডায়ারিয়া ও অপুষ্টি জনিত কারণে, প্রতিদিন ৮২১ জন, আমরা গুনেও দেখিনি !
খবরের কাগজে কোনো হেডলাইন দেখেছি এই প্রসঙ্গে ?
টিভির পর্দায় স্ক্রোল ? ব্রেকিং নিউজ ? মনে পড়ে ?
7. সাহিত্যে বা সিনেমাতেও আজকাল আর টিবিতে মৃত্যু দেখা যায় না, কিন্তু আজও দিনে প্রায় ১২০০ আর বছরে প্রায় সাড়ে চারলক্ষ মানুষ আমাদের দেশে মারা যান
টিউবারক্যুলোসিসে !
তার জন্য একদিনের জন্যও কি লকডাউন হয়েছে ? অথবা শেয়ার বাজারে ধ্বস ?
এই সব তথ্যে আমরা আতঙ্কিত বা চিন্তিত কিনা সেটা কোনো প্রশ্নই নয় ! প্রশ্ন হলো, আমরা কি আদৌ এই সব তথ্যগুলি জানি ?
কিন্তু আমাদের এটা মুখস্থ যে এই মুহুর্তে সারাদেশে প্রায় একানব্বই হাজার জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন আর গত সাড়ে চার মাসে মারা গেছেন ২৮৭২ জন !
8. আমৱা নির্দ্বিধায় ভুলে গেছি ,উনিশশো তেতাল্লিশের ‘ম্যানমেড’ দুর্ভিক্ষে এই বঙ্গদেশে তিরিশ লক্ষ মানুষকে না-খেতে-দিয়ে খুন করা হয়েছিল !
9. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয়েছিল আজ থেকে
ঠিক আড়াইশো বছর আগে, ইংরেজি ১৭৭০(বাংলা ১১৭৬ সন) সালে ! প্রায় এককোটি (বঙ্গদেশের তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ)মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান !
10. আমরা হয় জানতাম না অথবা জেনেও ভুলে গিয়েছিলাম, ভারতের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ (প্রায় ১৩.৪ কোটি) পরিযায়ী শ্রমিক !
আর এটাও মনে ছিল না যে, মানুষের ইতিহাসটা আদতে পরিযানেরই !
পরিযায়ী, আমরা সবাই, কোনো না কোনো ভাবে !
এটা একটা প্রেক্ষিত, এবার অন্য আরো কয়েকটা প্রেক্ষিতও জেনে নেওয়া যাক !
এর একটা হলো এক্সপোনেনশিয়াল বৃদ্ধির !
সংক্ষেপে বলি ।
ধরুন, একটা দাবার ছকে প্রথম ঘরে একটি চালের দানা, দ্বিতীয়টিতে দুটি, তৃতীয়টিতে চারটি, চতুর্থঘরে আটটি, তার পর ১৬, ৩২ ,৬৪ করে দানা সাজাতে থাকলে চৌষট্টি নম্বর ঘরে কটি দানা লাগবে জানেন ?
৯,০০০,০০০,০০০,০০০ টি অর্থাৎ ন’লক্ষ কোটি !
হ্যাঁ, কোভিড বাড়ছে এই ভাবেই !
এখনও পর্যন্ত গত সাড়ে চার মাসে আমরা আমাদের ২৮৫৭ জন সহনাগরিককে হারিয়েছি এবং তাঁদের বেশিরভাগই হয় বয়স্ক বা অন্য অসুখে ভোগা অশক্ত মানুষ অথবা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী, যাঁরা সুদীর্ঘ এক্সপোজার অথবা খারাপ সুরক্ষাকবচের শিকার ।
কোভিড পূর্ববর্তী পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ভারতে প্রতি হাজারে মৃত্যুহার প্রায় ৭.৩০৯ ।
অর্থাৎ প্রতি বছর দেশে প্রায় ৮,৪০০,০০০ জন মানুষ মারা যান বিভিন্ন কারণে।
অর্থাৎ প্রতি দিন ২২,৫০০ এবং মাসে মোটামুটি ৬,৭৫,০০০ জন ।
গত সাড়ে চার মাসে কোভিডে মারা গেছেন ২৮৭২ জন !
কোভিড 19 একটি ফ্লু
ঠিকই , কিন্তু এটি সাধারণ ফ্লু নয়!
এটি অত্যন্ত সংক্রামক কিন্তু আমাদের অতীতের অনেক মহামারীর যেমন সার্স, মার্স বা এমনকি ইবোলা থেকেও কম প্রাণঘাতী ।
কিন্তু কিছু সংক্রামিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোভিড অতিদ্রুত এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে । আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসের গ্রাউন্ড গ্লাস অস্বচ্ছতা সত্যিকার অর্থেই একটি অশুভ লক্ষণ । কিছু রোগীর মেথেমোগ্লোবিনেমিয়া কারো আবার শিরায় থ্রম্বো এম্বলিজম । কোভিড থেকে হওয়া মায়োকার্ডাইটিস এবং ভ্যাকুলাইটিস ইতিমধ্যেই এ রোগের স্বীকৃত জটিলতা ।
কিন্তু, আমাদের আরও কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে
1. এটি সোস্যাল মিডিয়া যুগের প্রথম মহামারি
2. প্রতিমুহুর্তে সংখ্যা, গ্রাফ এবং বিস্তারিত ব্রেক আপ সহ সারা পৃথিবী থেকে কোভিডের পরিসংখ্যান আছড়ে পড়ছে আমাদের ওপর !
কিন্তু স্ট্রোক,হার্ট অ্যাটাক,ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর,ড্রাগ সংবেদনশীলতা সিন্ড্রোম, পেমফিগাস , পথ দুর্ঘটনা, যক্ষ্মা, আগুনে পুড়ে যাওয়া , আত্মহত্যা, অপুষ্টি, নিউমোনিয়া সম্পর্কে তেমন কোনো পরিসংখ্যান আমরা জানি না , আমাদের জানানোও হয় নি !
মনে রাখতে হবে কোভিড এসেছে বলে এসব রোগ (এবং আরো কিছু অসুখ ) একটিও কিন্তু উধাও হয়ে যায়নি ।
3. মানবজাতির ইতিহাসে এর আগে কখনও এত দিন এত মানুষ একটানা এতদিন বাড়িতে বসে থাকেন নি !
4. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সাম্প্রতিক ইতিহাসে কখনও আমরা মাত্র একটি বিষয় নিয়েই এমন তথ্য-সুনামির মুখোমুখি হই নি !
5. শান্তি সময়ের ইতিহাসে আগে কখনো এত মানুষ চাকরি হারিয়ে এত তাড়াতাড়ি বেকার/কর্মহীন হয়ে পড়েন নি ।
6. আমাদের সাম্প্রতিক স্মৃতিতে এর আগে কখনো আমরা এতো লক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের অসহায় মিছিলের সাক্ষী হইনি ।
এবার আর একটি দিক থেকে ভাবা যাক ।
1. ভারতে আমাদের জনসংখ্যা একশ চৌতিরিশ কোটি ।
2. যদি দশ শতাংশ ভারতীয়ও সংক্রমিত হন (যার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না ) তাহলে সংখ্যা টা দাঁড়ায় এক কোটি চৌতিরিশ লক্ষ মানুষ !
3. আমরা সবাই জানি তাঁদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ হবেন কোনো রকম রোগলক্ষণহীণ এবং তাঁদের কোন রকম চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজনও হবে না ।
4. কিন্তু বাকি ২০% মানে ছাব্বিশলক্ষ আশিহাজার মানুষের হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে ।
5. যদি তাদের মধ্যে আবার ৫ শতাংশ মানুষের আই সি ইউ প্রয়োজন হতে পারে, অর্থাৎ এক লক্ষ চৌতিরিশ হাজার আই সি ইউ !
6. আক্রান্তদের তিন শতাংশেরও যদি ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের প্রায় আশি হাজার ভেন্টিলেটর লাগবে ।
7. বর্তমানে ভারতে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে হাসপাতালের মোট শয্যা সংখ্যা প্রায় উনিশ লক্ষ, আইসিইউ শয্যা প্রায় পঁচানব্বই হাজার আর আছে সাড়ে সাতচল্লিশ হাজার ভেন্টিলেটর ।
8. সঙ্কটকালে সাধ্যের সীমানা ছাড়ানো প্রতিটি সংখ্যাই!
9. আর কোভিড ছাড়াও আরো বহু অসুখে কিন্তু হাসপাতাল, আইসিইউ এমনকি ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হবেই !
আসল দুশ্চিন্তা এটাই।
তার ওপর প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে সংবাদমাধ্যম-সামাজিক মাধ্যমে বাহিত-জারিত হয়ে আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছে পরিসংখ্যান-সুনামি !
তাদের সবগুলিই যে সঠিক এমনও নয়!
তাদের কোনোটির উদ্দেশ্য সত্য গোপন করা আর কোনটির উদ্দেশ্য ভয় দেখানো ।
আমাদের এটা বুঝতে হবে যে কোভিড থাকবে এবং হঠাৎ করে উবেও যাবে না ।
মনে রাখতে হবে,এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে এই ভাইরাসের কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই ।নিকট ভবিষ্যতে যে হবেই, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই ।
তবে লকডাউনও একদিন উঠে যাবে এবং তারপরই শুরু হবে আসল যুদ্ধ !
কিন্তু শুধু লকডাউনও কোনো কাজে লাগবে না যদি না আমরা
1. আরো (এবং আরো, এবং আরো) পরীক্ষা করি এবং করেই চলি
2. যে কোন মূল্যে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে (ষাটোর্ধ মানুষ, বিশেষ করে যাঁদের অন্যান্য রোগ আছে ) সুরক্ষিত রাখি
3. চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর শারীরিক , মানসিক এবং সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করি
4. টেস্ট করি
5. সংক্রমিত মানুষটিকে আলাদা করি
6. যাঁর প্রয়োজন তাঁর দ্রুত চিকিৎসা করি
7. তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন প্রতিটি মানুষকে চিহ্নিত করি
8. করোনা-রাজনীতি পরিহার করি
9. সামাজিক নৈকট্যকে দৃঢ় করে অর্থবহ দৈহিক দূরত্ব মেনে চলি
10. একটি সুপরিকল্পিত, কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করি !
আমাদের মাথার মধ্যে এতো যে মচ্ছপুছারে আর কাঞ্চনজঙ্ঘা, এতো মেঘ, রোদ্দুর আর কালবৈশাখী ,এতো ঝড়খালি আর আয়লা, এতো যে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ ভালোবাসা, অভিমান আর ঝগড়াঝাঁটি, কানের ভেতর এতো যে রহো রহো সাথে, ফিফ্থ সিম্ফোনি আর ক্যা করুঁ সজনী, জিভের ওপর এতো রকমের কোয়াইজদাস, সিন্নি, হামাম মশিহ, ঝিঙ্গেপোস্ত আর দস্তরখানের আদর, এতো যে রেলগাড়ি দেখা অপু-দূর্গা, চিলাপাতার জঙ্গল, শিলাবৃষ্টি, অন্তাক্ষরী, এতো রকমের বেড়া আর নিঃসীমানা…
এই সব মুছে দেবে কোরোনা ?
ধুর !
তথ্যসূত্র :
1. https://tbfacts.org/tb-statistics-india/
2. https://morth.nic.in/sites/default/files/Road_Accidednt.pdf
3. https://www.who.int/bulletin/volumes/90/10/12-101873/en/
4. https://www.worldometers.info/coronavirus/country/india/
5. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Demographics_of_India
6. https://cddep.org/wp-content/uploads/2020/04/State-wise-estimates-of-current-beds-and-ventilators_20Apr2020.pdf