বুবুনের বাবা সরকারী চাকুরে। বুবুন যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন তিনি মালদা থেকে বদলি হয়ে গেলেন কোলকাতায়।কোলকাতায় আসার পর থেকে বুবুনের কেমন একটা দমবন্ধ লাগতে থাকে। স্কুলে তো ভর্তি হল, কিন্ত বন্ধু সেরকম কেউ হচ্ছে না। উল্টে নতুন স্কুলের আদব কায়দা আগের স্কুলের থেকে অন্যরকম।বুবুন একটু মুখচোরা গোছের ছেলে আর চেহারাটাও হাড় -জিরজিরে। এর ফলে এক নতুন উপদ্রবও দেখা দিয়েছে। সপ্তর্ষি নামে তার ক্লাসেরই একটি ছেলে তাকে নিয়ে কারণে-অকারণে ঠাট্টা-তামাশা করে। যাই হোক বুবুন তবুও পড়াশুনো চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জ্বরের কারণে স্কুলের এক মক টেস্টে অঙ্কে সে পঞ্চাশে মাত্র তেরো পাওয়ার পরে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টার পরিমাণ গেল আরো বেড়ে। সপ্তর্ষি ও তার কয়েকজন বন্ধু বুবুনকে দেখতে পেলেই বলছে “বুবুন তুমি অঙ্কে তেরো”।
অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য বাড়িতে বাবা প্রায়ই থাকেন না আর মা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন ছোট ভাইকে নিয়ে। তাই বুবুন বাবা-মাকে কিছু বলতে পারে না। আবার স্যাররাও এত গম্ভীর যে বুবুন তাঁদেরকেও কিছু বলতে পারে না। সেদিন আবার সপ্তর্ষি যখন তাকে নিয়ে মজা করছিল, বুবুন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিশাল চেহারার সপ্তর্ষি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। তাই বুবুনের আজকাল আর স্কুলে যেতে ভাল লাগে না। স্কুলে গেলেও ঠিকমত পড়াশুনো করতে পারে না, সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে। আরো কয়েকমাস পরে বুবুনের বাবা-মা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। বুবুনের মনখারাপের চিকিৎসার জন্য তাঁরা গেলেন এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিনি দীর্ঘক্ষণ বুবুন ও তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে জানালেন যে বুবুন আসলে স্কুলে “বুলিং”-এর শিকার।
“বুলিং” কথাটির অর্থ হল ক্ষতি করার ইচ্ছে নিয়ে (সাধারণত সমবয়সী ) কাউকে শারীরিক বা মানসিক উৎপীড়ন বা হয়রানি করা।অত্যাচারিত সাধারণ ভাবে অত্যাচারীর তুলনায় শারীরিক বা মানসিক ভাবে দূর্বল হয় এবং এই জাতীয় উৎপীড়নের ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে। “বুলিং” বিভিন্ন রকমের হতে পারে। শারীরিক উৎপীড়নের উদাহরণ হল কারো গায়ে হাত দেওয়া, ধাক্কা দেওয়া, লাথি মারা, ফেলে দেওয়া ইত্যাদি। আবার খারাপ কথা বলা, ভয় দেখানো, কটাক্ষ করা ইত্যাদি মৌখিক ভাবে উৎপীড়নের উদাহরণ।
আবার কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, সহপাঠীদের সাথে মিশতে না দেওয়া ইত্যাদিকে “রিলেশনাল বুলিং” বা আবেগীয় উৎপীড়ন বলা যেতে পারে। বর্তমানে আবার এক নতুন ধরনের “বুলিং “দেখা যাচ্ছে যার নাম “সাইবার বুলিং”, যেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করে শিশু-কিশোরদের ভয় দেখানো, হেয় প্রতিপন্ন করা ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।
যে সমস্ত শিশু-কিশোররা শারীরিক ভাবে দুর্বল, রুগ্ণ বা অতিরিক্ত স্থূলকায়, যারা অন্য কোন শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, যাদের স্কুলে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কম, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি বিষয়ে ক্লাসে সংখ্যালঘু তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই জাতীয় অত্যাচারের শিকার হয়।
অন্যদিকে যে সমস্ত কিশোর-কিশোরী এই জাতীয় উৎপীড়ন করে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিত্বের সমস্যা ও অন্যের প্রতি সহমর্মিতার অভাব খুব বেশি করে পরিলক্ষিত হয়।
আবার অনেক সময় “বুলিং”- এর শিকার হওয়া শিশু-কিশোরেরাই ভবিষ্যতে অন্য শিশু -কিশোরদের “বুলি” করে।
এটেনসন ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এ ডি এইচ ডি) হল একপ্রকার মানসিক রোগ যার প্রধান লক্ষণগুলি হল মনযোগের অভাব, অতি চঞ্চলতা ও হঠকারী আচরণ।
আবার কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার নামক রোগের মূল লক্ষণগুলি হল-অসামাজিক আচরণ, নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করা, ঔদ্ধত্য প্রদর্শন, জীবজন্তু বা অন্য কোন মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন ও ক্ষতি করার প্রবণতা, মিথ্যে কথা বলা, স্কুল থেকে পালানো, চুরি করা ইত্যাদিI
এই দুই রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যে অত্যাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি।
যে সমস্ত শিশু-কিশোর “বুলিং”-এর শিকার হয় তাদের মধ্যে স্কুল না যাবার প্রবণতা বাড়ে, পরীক্ষায় ফল খারাপ হতে থাকে। এর সাথে সাথে খিদে ও ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের সমস্যা, মানসিক অবসাদ ও উদ্বিগ্নতার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় তীব্র মাত্রার মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।
অনেক সময় শিশু ও কিশোরেরা বাবা-মা কে “বুলিং”- এর ব্যাপারে বলতে পারে না।এতে সমস্যা আরো বাড়ে। বাবা-মা বাচ্চার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে মিশতে পারলে এই জাতীয় ঘটনাগুলি তৎক্ষণাৎ জানতে পারা যায়, যা ভবিষ্যতে এই জাতীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমায়।
হঠাৎ করে বাচ্চার পড়াশুনো খারাপ হতে থাকা, খিদে বা ঘুম কমে যাওয়া, অকারণে স্কুল যেতে না চাওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া গেলে বাবা- মা কে নিয়মিত স্কুলের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং এই জাতীয় ঘটনা ঘটলে তৎক্ষণাৎ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সে বিষয়ে জানতে হবে। শিক্ষক-ছাত্রদের সুসম্পর্ক,ক্লাস ও খেলার মাঠে উপযুক্ত নজরদারী এই জাতীয় ঘটনা কমাতে পারে। এছাড়া “বুলিং”-এ জড়িত ছাত্র- ছাত্রীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভবিষ্যতে এই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমায়। মোবাইল ও ইন্টারনেটের উপযুক্ত ব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহারে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির “বুলিং” বিরোধী নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও সেগুলির সঠিক রূপায়ণ সাইবার বুলিং-এর মত সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।