এইমাত্র কয়েকটি দিন আগেও ‘মার যবনকে’, ‘মার কাফেরদের’ … ইত্যাদি ইত্যাদি বলিয়া নানাবিধ প্রাণঘাতী অস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া, যাঁহারা উন্মত্তের ন্যায় খুনোখুনি করিতে মাতিয়া উঠিয়াছিলেন, নানা দেশে যেমনি করিয়া মাথাচাড়া দিয়া উঠিতেছিল ভণ্ডামি, উগ্র ধর্ম ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তথা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ভয়াল দর্শন মারণাস্ত্রের শরীর, সব এক নিমেষেই স্তিমিত হইয়া গেল! সৃষ্টিকর্তার ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার তাগিদে যাঁহারা রক্তপিপাসু, মাতাল হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই যখন দেখিলাম শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে মরিতে লাগিলেন, দেখিলাম- তখন আর তাঁহারা ভগবান/আল্লাহ/পয়গম্বর/যীশুখৃষ্ট/বুদ্ধ কাহারো নাম লইতেছেন না !
হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন শিখ ইহুদী আর্য অনার্য ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র শিয়া সুন্নী আহমদীয়া ক্যাথলিক ব্যাপটিস্ট অর্থোডক্স সহ সকল মত ও পথের মানুষ এক ভাষায় মৃত্যু ভয় প্রকাশ করিতেছেন-‘ডাক্তার বাবু গো, এ যাত্রায় বাঁচাও গো- এই আমরা সকল ভুলিয়া তোমাদিগের পূজায় মত্ত হইলাম!’
পৃথিবী মাতার পরিত্যক্ত সন্তানসকল একই স্বরে কাঁদিতেছে! দেখিলাম, মৃত, আক্রান্ত এবং ভীত সমগ্র মানব জাতির সেই অসহায় আর্তিতে মন্দির হইতে সুমধুর দৈববাণী আসিল না, মসজিদ হইতে নামাজের ধ্বনি আসিল না, গীর্জা হইতে ক্ষমাশীলতার বাণী আসিল না, মহানির্বাণের পথ প্রদর্শক বাহির হইয়া আসিল না !
শুধু কতগুলি আপাদমস্তক ভীতু এবং নির্বোধের অপসৃয়মান গোময়পূর্ণ মস্তিষ্ক ও শরীর মৃত্যু ভয়ে ভীত হইয়া, তথাকথিত মনুষ্যসৃষ্ট সৃষ্টিকর্তাকে একাকী উপাসনালয়ে ছাড়িয়া, আপন গৃহের উদ্দেশ্যে পলাইয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গেল- নামাজ পড়িলে, সর্ষের তেল নাসিকায় ঢালিয়া ঘুমাইলে, শিবে ভক্তি রাখিলে, ক্যারল গাইলে করোনা থাকিতে পারিত না!
দেখিলাম, নামাজের নিদান বলিয়া মৌলবী নিজেই আক্রান্ত হইলেন। শিব ভক্তির নিদান দিয়া ভক্ত আপনার মুখ ঢাকিল। পোপ আপনার মৃত্যু ভয়ে অসহায় ভাষণ লিখিয়া আনিলেন এবং ঠকঠক করিতে করিতে পাঠ করিলেন।
তথাপি, উপাসনালয়ের দেয়ালে দেয়ালে এইসব কোন আলোড়ন তুলিতে পারিল না! মূর্তি নড়িল না, কাবা শরীফ নড়িল না, ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি নড়িল না, লাফিং বুদ্ধ হাসিয়া ফাটিয়া পড়িল না।
সহস্র বছর ধরিয়া মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডার ললাটে লেখা এই রক্তকলঙ্ক-রেখাকে মুছিয়া ফেলিবে, বীর? …. যিনি ধর্ম-মাতালদের আড্ডা ওইসব উপাসনালয় ভাঙ্গিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজ-তলে লইয়া আসিবেন!
ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা কুশাস্ত্র নিঃসৃত সোমরস পান করিয়াছে।
দেখিলাম, তেত্রিশ কোটি দেবতা কোয়ারেন্টাইনে পড়িয়া রহিল। একাকী আল্লাহ মসজিদে বন্দী রহিল। একাকী ক্রুশবিদ্ধ যীশুর হাতের পায়ের পেরেক খুলিয়া পড়িল না। কাহারো কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, তথাপি মানুষ ভাবিল উহারা বোধকরি মানুষকে শাস্তি প্রদান করিতেই নিশ্চুপ হইয়া আছেন!
দেখিলাম, করোনার ভয়ে ভীত হিন্দু নিজ সম্প্রদায়ের ভাইকে সৎকার করিল না, মুসলমান আসিয়া তাহার সৎকার্য সম্পাদন করিল। শত শত মুসলিম মার্কাসের নাম করিয়া একস্থানে থাকিয়া আক্রান্ত হইলো, হিন্দু বলিল উহাদের চিকিৎসা করিতে হইবে।
রক্তের প্রয়োজনে ঠিক এই মানুষগুলিই হাসিমুখে আপনার শরীর হইতে মূল্যবান রক্ত দান করিতে লাগিল। ইতালিতে খ্রীষ্টান মরিতে লাগিল, দেখিলাম চীনের বৌদ্ধ ডাক্তার তাহাদিগের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করিল।
লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে ঘরে ফিরিবার পথ খুঁজিয়া হাঁটিতে শুরু করিল। তাহাদের অভুক্ত উদর, জলশূন্য শরীর লুটাইয়া পড়িল, মরিল- তথাপি কোন উপাসনালয়ের দরজা না কোন সৃষ্টিকর্তা খুলিল, না কেউ আশ্রয় পাইলো!
কে সেই বীর, যে আসিয়া বলিবে, এইসব উপাসনালয় মূর্তি কাবা গীর্জা প্যাগোডা নির্মাণ করিয়া যত অপব্যয় হইয়াছে, তাহাতে যত ভণ্ড আপনাকে মহাপুরুষ বানাইবার সুযোগ পাইয়াছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল না বানাইয়া যে মহাপাপ করিয়াছে মানব জাতি, তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। কে আসিয়া বলিবে, পুরোহিত মৌলভী পাদ্রী সন্ন্যাসী যাজক সব মানুষের পশু-প্রবৃত্তির সুযোগ কাজে লাগাইয়া অগণিত রাজনৈতিক দল ও ধর্মান্ধদের জন্ম দিয়াছে?
দেখিলাম, করোনা আসিল!
এইসব কিছুর অসাড়তা প্রমাণ করিতে তাহার বেশি সময় লাগিল না। সে আসিয়া, সমগ্র মানব জাতির দুই চোখে আঙুল ঢুকাইয়া, মগজের ঘিলু দুধ হাতে মাখন কাটিবার মত নাড়াইয়া, সমস্ত অপশক্তিকে পরাজিত করিয়া, সকল মারণাস্ত্রসম্ভারকে বিদ্রুপ করিয়া, সকল অমিতবিক্রমকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিয়া সকল ভোগবিলাসী মানুষের অপদার্থতাকে জনসমক্ষে আনিয়া, সকল প্রকার দূষণ হইতে পৃথিবীকে বাঁচাইবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিল।
দেখিলাম, এই চরম দুর্ভোগে, সম্বল শুধুমাত্র বুকের বল লইয়া সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাইতে, নিধিরাম সর্দার ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সকল স্বাস্থ্যকর্মীর দল আগাইয়া আসিল। আগাইয়া আসিল পুলিশ নামক সমাজের অন্য এক প্রজাতি- মানুষ যাহাদের দায়িত্বশীল ভাবিতে ভুলিয়া গিয়াছে। দিবারাত্র এক করিয়া তাহারা নিজেরা মরিল, বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অভয় প্রদান করিল, সুস্থ করিল, ঘরে ফিরাইয়া দিতে পারিল, দিতে পারিবে।
অপেক্ষা করিতেছি, এই দুর্যোগ কাটিয়া যাইবার পর, স্বমহিমায় উজ্জ্বল হইয়া, ফুল মালায় সজ্জিত হইয়া, সমস্ত অপদার্থ উপবাসী সৃষ্টিকর্তা কবে আবার এই নির্বোধ মনুষ্যের নৈবেদ্য খাইতে রাক্ষসের মতো হা করিয়া উপাসনালয় আলো করিবেন!
(কাজী নজরুল ইসলামের অমূল্য দুগ্ধে চোনা ঢালিলাম ?)