যে কোনো মোবাইলে ফোন করলেই শুনতে পাবেন। ভ্যাকসিন অবতারে নতুন আশার আলোকে একুশ সাল অবতীর্ণ। শুধু টীকাতেই শেষ নয়। অটুট হওয়া চাই আত্মরক্ষার বর্ম। দাওয়াই ভি কড়াই ভি। হক কথা। কিন্তু আসলে হচ্ছেটা কী? বিশের শিক্ষা কি আমরা একুশে কাজে লাগাতে পারছি? ছয় রাজ্যে ভোট। সব মিলিয়ে আঠারো কোটি ভোটার। তাঁদের হিতার্থে ব্রিগেড, পথসভা অথবা রোড শো। চলছে তো চলছেই। দীর্ঘ লকডাউনের শেষে মৃত্যুমিছিল যখন সামান্য সংক্ষিপ্ত ঠিক সেই সময় কোভিড বিধি শিকেয় তুলে আমরা মেতে উঠলাম ভূমিপূজনে বা দুর্গাপুজোয়। অযোধ্যায় বৃহত্তম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন হলো মহা সমারোহে। বলা যায় জেনে বুঝে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে চলেছি।
এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সুনামি বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সর্বাধিক দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে গত বছর রাজ্যে রেকর্ড হয় ২২ অক্টোবর। ৪১৫৭ জন আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যু হয় ৬৪ জনের। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে তখন কোভিড হাসপাতালের সংখ্যা ছিল ৯৩ আর কোভিড বেড ১২৭৫১ সব মিলিয়ে। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অসংখ্য মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন বেডের আশায়। তবে ভয়েই হোক আর প্রচারের সাফল্যেই হোক মাস্ক বা দূরত্ববিধি চোখে পড়তো অপেক্ষাকৃত বেশি। আর এখন মানুষ যেন বেপরোয়া। চৈত্র সেলে মাস্কবিহীন ভিড় দেখে বোঝার উপায় ছিল না আমরা এখনো অতিমারীতেই আছি। সার্বিক পরিস্থিতি এবছর আরো ভয়ানক। রাজ্যে এখন দৈনিক আক্রান্ত আট হাজারের বেশি। আর আমাদের পূঁজি মাত্র ৫৬টি কোভিড হাসপাতাল! বেড সংখ্যা ৭৪২৮ মাত্র। সরকার পক্ষপাতদুষ্ট এমন অভিযোগ অনেক শুনেছি। আর এখন কি প্রশাসন পক্ষাঘাতগ্রস্থ বা ভোটঘুমে আচ্ছন্ন? মাস্ক না পরার দোষে নিউমার্কেট থেকে পনের জন গ্রেপ্তার হলেন। কিন্তু নাকের ডগায় গন্ডাখানেক ব্রিগেড আর রং বেরং এর রোড-শো হয়ে গেল সেগুলো আটকানো গেল না বা তাঁদের সকলকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা গেল না। স্কুল-কলেজ বন্ধ।স্খগিত পরীক্ষার জেরে ছাত্রছাত্রীরা আতান্তরে। বিবাহে, শ্রাদ্ধে সমাগম নিয়ন্ত্রিত অথচ ভোট উৎসব অব্যাহত পুরো মাত্রায়। বৃহত্তম গণতন্ত্র আধুনিকতার বড়াই করে, আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন দেখায়। আর নির্বাচন এলেই লোকতন্ত্রের পূজারীরা ভরসা করেন পেশী শক্তিতে। দেখাতে হয় কার সভায় কত ভিড়।
অপবিজ্ঞানে ভরসা তো এখন প্রায় জাতীয় চরিত্রে পরিণত। গত সনে আমরা “গো করোনা গো” বলে কুলোর বাতাস দিয়েছি। থালি বাজিয়েছি। নানা উপচারে গো-নিদান দিয়েছি। আর এবছর কুম্ভস্নান আটকানোর চেষ্টা তো করিইনি বরং গঙ্গা জলের গুনাগুন নিয়ে বুজরুকি ছেড়েছি। গত বছর তবলিগিদের তুলোধনা করেছি। আর এবছর হরিদ্বারে তার চেয়েও কয়েকশ’ গুণ ভিড় জমিয়েছি। কিন্তু করোনা যে কাউকে রেয়াত করে না। তার কাছে ভিনদেশী তবলিগি আর স্বদেশী সাধুসন্ত সবাই সমান। তার হাত থেকে ভূমিপূজনের মহন্তও রক্ষা পান নি। স্নানপূণ্যার্থীরা কাত হয়েছেন কাতারে কাতারে। কৃষি বিল বিরোধীদের জমায়েত রুখতে রাজপথ কেটে দেওয়া যায় কিন্তু পুণ্যস্নান রোখার সাহস দেখান না সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও তথৈবচ। প্রচার বন্ধ শুধু সন্ধ্যা ও সকালে। দিনের আলোয় মেতে থাকুন বিলকুল কোলাহলে।
পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন রেকর্ড সংখ্যায়। ভোটপ্রার্থী, সমর্থক, শিশু, কিশোর কেউ ছাড়া পাচ্ছেন না। টীকাকরণ চলছে তবে অত্যন্ত মন্থর। কঠিন সময়ে কঠিন পদক্ষেপের ভক্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যর্থ। “মন কি বাত” এর স্রষ্টা বৈদ্যুতিন চ্যানেলে বক্তব্য রেখে দেখতেই পারতেন কত জন তাঁর বাণী শুনেছেন। সাংবাদিক সকাশে তিনি বিশেষ আসেন না তবে নির্বাচনী বিতর্কে তো আসাই যেত। এদিকে রাজ্য প্রশাসনও বোধহয় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। সবার চোখ যেন দোসরা মে’র দিকে।
- টেস্ট এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
- প্রভুত পরিমাণে কোভিড বেড দরকার।
- শুধু হাসপাতাল থাকলেই চলবে না। থাকতে হবে আই সি ইউ পরিষেবা। অক্সিজেনের সাপ্লাই নিশ্চিত করতে হবে।
- জনসাধারণকে মাস্ক ও দূরত্ববিধির ব্যাপারে আরও সচেতন করতে হবে।
- টীকাকরণে গতি আনতে হবে।
প্রতিটি দিন এখন গুরুত্বপূর্ণ।
রমজান মাস চলছে। আসতে চলেছে খুশীর ঈদ। ধর্মীয়, রাজনৈতিক সকল নেতৃত্বের সময় এসেছে প্রাণ বাঁচানোর বার্তা দেওয়ার। দেশে এখন সংকটকাল। করোনোয় মৃতের সংখ্যা দুলাখ হতে চলল। অসুস্থ বা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকারি তরফে এবং ব্যক্তিগত স্তরে চূড়ান্ত সাবধান না হলে ফল হবে মারাত্মক। নির্জন মুজফফরপুর রেল স্টেশনে সেই অসহায় শিশুটির কথা মনে পড়ছে? যার মা প্ল্যাটফরমে একলা নিথর পড়েছিলেন। আর অবুঝ শিশুটি মুখের ঢাকা সরিয়ে তাঁকে জাগানোর চেষ্টা করছিলো। মে মাসের সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্য একুশে বারবার ফিরে আসবে না তো? চিকিৎসকমহল অনেক দিন ধরেই চেতাবনি শোনাচ্ছেন। ওঁদের কথা কানে তোলার সময় এসেছে এবার।
প্রবন্ধটির পরিবর্তিত রূপ ‘এই সময়’-এ প্রকাশিত।।