এটা প্রমাণিত যে পারস্পরিক দূরত্ব কম করে ১ মিটার বজায় রাখলে এবং ঘন ঘন সাবান জলে (কিংবা আলকোহল যুক্ত স্যানিটাইজারে) হাত ধুলে কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ অনেকটাই কমানো যায়। মুখে মাস্ক পরে থাকলেও সংক্রমণ কিছুটা কমানো যায় বিশেষত কেউ যখন ঘরের বাইরে হাটবাজার কিংবা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। কিন্তু লকডাউন করলে এর থেকে বাড়তি কিছু উপকার হবে, তেমন বিশ্বাস আমাদের অনেকের মনের ভিতরে গেঁথে থাকলেও সেটা আজও প্রমাণিত হয়নি।
লকডাউনের কি ও কেন?
প্রথমে লকডাউনের বিষয়টা একটু খোলসা করে নেওয়া যাক। মানুষকে বাড়িতে বন্দি করে রাখার ক্ষেত্রে এক এক দেশ এক এক রকমের ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রায় সব দেশেই লকডাউনে যে সাধারণ নিয়মগুলো পালিত হয়েছে, তা হল স্কুল, কলেজ, খেলাধূলার জায়গা, অফিস, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি বন্ধ রাখা এবং যেসব ক্ষেত্রে জনসমাগম বেশি হয়ে থাকে তা সে উপাসনালয়, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা বা সেসব জায়গায় জমায়েত নিয়ন্ত্রিত করতে বলা হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকায় লকডাউনে দোকানপাঠ, বাস, ট্রাম বা মেট্রো কিন্তু চালু থেকেছে। এসব কর্মকান্ডের একটাই উদ্দেশ্য তা হলো যে কোনো দুজন বা ততোধিক ব্যক্তি মানুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। সেই অর্থে ঘর বন্দি আলাদা কোনো মাত্রা আনে না। শুধুমাত্র ঐ দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখে।
কেন আমরা লকডাউনের পক্ষে?
সারা পৃথিবীতে তো বটেই এদেশেও লকডাউনের পক্ষে একটা জনমত গড়ে উঠেছে বা পরোক্ষে গড়ে তোলা হয়েছে। এর পিছনে মিডিয়ার এক চতুর ভূমিকা রয়েছে। তারা নানান প্রক্রিয়ায় এবং ভয় পেও না বলে কার্যত কোভিডকে ঘিরে মানুষের মনে গভীর ভয় তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম একে ‘মারণ রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়াও পাশাপাশি মানুষের অসহায়তার জায়গাটা নাড়িয়ে দিতে পেরেছে, তৈরি করেছে মৃত্যুভয়। মানুষ শুনেছে অজানা, অচেনা এবং অদেখা এক বিপদের পদধ্বনি। অন্যদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলাররা আঁক কষে দেখিয়েছেন আগামী দেড়/দুমাসে কত লক্ষ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হবেন, কত জন মারা যাবেন ইত্যাদি। এ দুয়ের যুগলবন্দি এমন এক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে তাতে যে কোনো মানুষের পক্ষে বিহ্বল ও দিশেহারা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ধরণের অবস্থায় মানুষ যে কোনো শক্তির কাছে নতজানু হয়ে যায়, সরকার প্রশাসন কিংবা অন্য যে কোনো ক্ষমতাবানের কাছে আমরা ভেঙে পড়ি। কোনো প্রশ্ন তোলা বা বিরুদ্ধ কোনো মত প্রকাশ তো বহুদূরের কথা। এ যেন সেই জাদুকরের খেলা, দর্শকভর্তি প্রেক্ষাগৃহে স্টেজের ওপর কাউকে সম্মোহিত করে তাকে জাদুকর যে নির্দেশই দিক না কেন তাই সে পালন করে চলে। আমাদের অবস্থাটা প্রায় সেরকমই, ফলে লকডাউন সহ আর যা কিছু কোভিড নিয়ন্ত্রণের নামে চালানো হচ্ছে আমরা নত মস্তকে তা মেনে চলেছি। মনে করেছি এ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু … …
এটা ঠিকই যে কোভিড দ্রুত ছড়ায়, এ রোগের কারণে কিছু লোকের মৃত্যু হয়, বহু রোগের কারণেই মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ টিবিতে মারা যায়, প্রায় সমপরিমাণে এডস রোগেও। এদেশে কুড়ি থেকে পঁচিশ লক্ষ মানুষ প্রতিবছর টিবিতে আক্রান্ত হন। ফুসফুসের সংক্রমণে চল্লিশ লক্ষেরও বেশি শিশু পৃথিবীতে মারা যায়। প্রতি বছর সত্তর থেকে আশি লক্ষ মানুষ মারা যায় হার্টের রোগে, আর প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হন গড়ে বারো থেকে পনেরো লক্ষ মানুষ। কিন্ত এসব রোগ আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে – তাছাড়া এই রোগগুলো পুরনো, এতে কোনো নতুনত্ব নেই। তাই মিডিয়া এ নিয়ে উৎসাহ পায় না, আমজনতারও এসব নিয়ে আগ্রহ কম। করোনা সেক্ষেত্রে ‘হিট আইটেম’। আর তা রুখে দিতে লকডাউনই নাকি একমাত্র উপায়। আমরা এসব বিশ্বাস করেছি।
আর বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি? নামীদামি লোকজনেরা টিভি চ্যানেল এসে যখন লকডাউনের পক্ষে ওকালতি করেন তখন কি সেটা আমান্য করা যায়। এর মধ্যে ডাক্তারবাবুরাও রয়েছেন। তারা রেখাচিত্র তুলে ধরে বোঝান লকডাউন করে রোগীর সংখ্যা কতটা কমানো যাবে ইত্যাদি। আমার বিশ্বাস তারা ঐ সব মডেল কিসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, তার খোঁজ রাখা তো দূরের কথা, ঐ সব মডেলে কি বলা রয়েছে তাও পড়েন নি। তারা এ-ওর মুখে মুখে শুনে ঐ সব লেখাচিত্রে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন এবং অন্যদের প্রভাবিত করছেন, এ সেই অন্ধের হস্তী দর্শনের গল্প।
কোন মাপকাঠিতে লকডাউন চালু হলো?
লকডাউন জনগণকে খাওয়ানো গেছে। অনেকেই হয়তো বলবেন, সামান্য কিছু লাভ হলেও তা করা দরকার। কারণ বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। প্রশ্ন হলো লকডাউনে কি লাভ হয়েছে বা হচ্ছে আর কতটা ক্ষতির বিনিময়ে, সেটাতো বিচার করতে হবে। অন্য কথা তো ছেড়েই দিলাম শুধু কত মানুষ অন্য কোনো রোগে ভোগের জন্য চিকিৎসা পেল না কতজন বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, কতজনের টীকাকরণ হলো না, কত টিবি রুগী, এইচআইভি-তে আক্রান্ত ব্যক্তি ওষুধ না পাওয়ার কারণে তাদের শরীরে রোগের পুনরবিস্তার ঘটল, এবং এর ফলে এইসব রোগজীবাণু চলতি ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে কি ধরণের প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্স গড়ে তুলল সেসবের হিসেব তো করতে হবে, যা আগামীদিনে টিবি এবং এডস নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পকে বানচাল করে দেবে, মৃত্যু ঘটাবে অসংখ্য মানুষের সে হিসেব কে করবে। রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে যাচাই করা হয় ওই ওষুধের কারণে রোগীর কতটা লাভ হতে পারে আর কতটা ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। একে বলা হয় বেনিফিট রিস্ক রেশিও। মহামারীর ক্ষেত্রেও যে ওষুধের ব্যবহার হচ্ছে (লকডাউন) তারও লাভ ক্ষতির বিচার হওয়া দরকার। এটি প্রয়োগের পূর্বে এসব আলাপ আলোচনা যে আদৌ হয়নি তা বলাই বাহুল্য। তা না হলে তিনদিন পর সরকারের টনক নড়ে যে সারা দেশ জুড়ে সাত/আট কোটি পরিযায়ী শ্রমিক অন্যরাজ্যে আটকে পড়েছে। লকডাউন হলে গরিব মানুষের রুটিরুজির জোগান কিভাবে বহাল রাখা হবে সে সব চিন্তা মাথাতেই আসে নি। কিন্তু এইসব শ্রমিকদের মধ্যেও তো করোনা সংক্রমণ ঘটতে পারে, এ-চিন্তা কেন তাদের মাথায় এল না সেটাই আশ্চর্যের।
লকডাউন আমাদের দেশে কতটা প্রযোজ্য?
প্রশ্ন হলো লকডাউন কি সব দেশে সমান ভাবে প্রযোজ্য ? কলকাতা শহরে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ ফুটপাথবাসী, বস্তিতে বসবাস করেন ৪৩ শতাংশ মানুষ। দিল্লি ও মুম্বই শহরে এই হার শতকরা ৫০। বস্তির এক-একটা ঘরে পাঁচ থেকে দশজন বাস করে থাকেন। রাত্রে সেখানেই তাদের শুতে হয় ঠিকই কিন্তু সারাদিন ওই খুপরিতে বসে থাকা যে কোনও মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। আর যার ঘর নেই তাকে তো ঘরবন্দি করা যাবে না। তবে মডেলারদের অঙ্ক অনুযায়ী যদি লকডাউন পঞ্চাশ শতাংশ সফল হয়, তবে ওই সময় জুড়ে রোগবিস্তারের সম্ভাবনা ২৬ শতাংশ নামিয়ে আনা যাবে। তবে তার সঙ্গে দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে রুগীকে শনাক্ত করা ও তাদের আলাদা করা এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের কোয়রান্টাইনে রাখতে পারলে এই সাফল্য নাকি ৭১ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। আমাদের দেশের মতো ঘনবসতি পূর্ণ জায়গায় লকডাউন প্রয়োগ করার সুযোগ খুবই সীমিত। ইউরোপ আমেরিকায় যেটা সম্ভব হয়েছে সেটা এখানে করা অযৌক্তিক। এ দেশের মেট্রোপোলিসগুলোয় প্রতি বর্গ মাইলে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ বাস করে এবং সেই অনুযায়ী শুধু ঘিঞ্জি বস্তি নয়, হাট-বাজার, স্কুল কলেজ উপাসনাগার ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। সর্বত্রই জায়গার অভাব। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের শতকরা ৯৩ ভাগ অসংগঠিত শ্রমে যুক্ত (ইউরোপে যা মাত্র ৭ থেকে ১২ শতংশ) এইসব শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনের রোজগার ঐ শহরগুলোর মধ্যেই গড়ে উঠেছে, তা সে গৃহশ্রমিক, নির্মাণকর্মী, মুটে-মজুর ইত্যাদি যাই ভাবা হোক না কেন, পেটের দায়ে তাদের ঘরের বাইরে যেতেই হবে। এদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই, নেই বেকারভাতা যা আমেরিকা বা ইউরোপের শ্রমিকরা পেয়ে থাকেন। এই ধরণের কাঠামোগত বাধা লকডাউন প্রয়োগের বিপক্ষে যায়। দু-চারদিন পুলিশ দিয়ে ঠেঙিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা গেলেও সপ্তাহ বা মাস জুড়ে তা সম্ভব নয়। তাই ঝট করে উন্নত বিশ্বের অনুকরণে লকডাউন করলে যে কাজ হবে সে ভাবনাটা ভুল। আর লকডাউন যত দীর্ঘায়িত হবে তত অকার্যকর হয়ে উঠবে।
লকডাউনের প্রয়োগ পদ্ধতি
প্রথম দফার লকডাঊন যদিও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এর প্রয়োগপদ্ধতি কিছুতেই মানা যায় না। সরকার কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তিন ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করলেন। না ছিল কোনো পরিকল্পনা, না কোনো চিন্তা ভাবনা। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার লকডাউন বাড়ানোর সময়ও তারা যে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট জোগাড় করতে পারেন নি, তা জানা সত্ত্বেও কেন তারা ফের লকডাউনের সময় বাড়ালেন তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন?
লকডাউনের পর যখন সারাদেশ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা যে যার ঘরে ফেরার জন্য যখন বিভিন্ন শহরের বাসস্ট্যান্ডে ভিড় জমাল, তখন অনেকের খেয়াল পড়ল যে পরিযায়ী শ্রমিক বলে কিছু মানুষ রয়েছে। লকডাউনে তাদের কি হবে সেটা সরকারি হিসেবের মধ্যে আসেনি। এরপর দুমাস লাগল তাদের, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, দুমাস তাদের এক জায়গায় গাদাগাদি করে রেখে যখন দেশে পাঠানো হচ্ছে, তার ফলাফল কি ভয়ঙ্কর হচ্ছে সেটা বিহারে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে কোভিডের সংখ্যা দেখলে চমকে উঠতে হবে। গুজরাত মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্য থেকে কোভিড বয়ে নিয়ে তারা ফিরে এল নিজের রাজ্যে। অন্য রাজ্যেও একই চিত্র অচিরে আমরা দেখতে পাব। এত সহজে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, শহর থেকে গ্রামে পৌছনো যে সম্ভব তা কোভিড ভাইরাসও ভাবতে পারে নি, সে যদি হোয়াটসআপ অ্যাপ ব্যবহার করত তাহলে ৫টা নয় ৫০টা থাম্বস আপ উপহার দিত সরকার বাহাদুরকে। কোভিড নিয়ে এই ছেলেখেলা অন্য কোনো দেশে ঘটলে বোধহয় বিপ্লব হয়ে যেত।
মডেলারদের ভবিষ্যতবাণী বনাম বাস্তব চিত্র
মার্চ-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে এদেশের মডেলাররা যেসব ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে,আগামী পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দিনের মধ্যে দিল্লিতে চল্লিশ লক্ষ থেকে এক কোটি দশ লক্ষ মানুষ করোনাতে আক্রান্ত হবেন। কলকাতায় এর থেকে একটু কম হলেও সংখ্যাটা বেশ মারাত্মক।
ঐ সংখ্যার করোনা রোগীকে আগামী ৩০০ দিনে ছড়িয়ে দিতে তারা লকডাউনের সুপারিশ করেছিলেন। এতে হাসপাতালের উপর করোনা রোগীর চাপ কমবে। এখন বাস্তবে কী ঘটল সেটা যাচাই করা যাক।
দিল্লিতে লক ডাউনের জন্য ২৬ শতাংশ যদি কমে তবে তা দাঁড়ায় ২৯.৩০ লক্ষ। বাস্তবে, কিন্তু সংখ্যাটা ১০ হাজারেরও কম। অর্থাৎ মডেলের বাণী আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ আসমান-জমিন। কিন্তু লেখচিত্রে আমাদের এত ভক্তি যে, আমরা প্রশ্ন করতে ঘাবড়ে যাই। সরকারি আম্লারা ঐ মডেলকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়ে লকডাউনের ভূমিকা সম্পর্কে বাগাড়ম্বর করে চলেছেন। আমরা অন্ধের মতো তা শুনে চলেছি।
ইতালি কিংবা স্পেনে লকডাউন চললেও করোনার বৃদ্ধি এবং বিকাশ দুমাসের মধ্যেই তুঙ্গে পৌঁছে গেছে, এখন তা ধীর গতিতে কমার দিকে; নিউইয়র্কে লকডাউন কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। তবে মডেলারদের অভিযোগ তারা নাকি দেরিতে লকডাউন করেছেন। কিন্তু যারা আগে শুরু করেছিলেন যেমন আয়ারল্যান্ড,, ডেনমার্ক, তাদের দেশেও হেরফের ঘটেনি। ইউরোপের নানান দেশের অভিজ্ঞতা বিচার বিশ্লেষণ করে ইংল্যান্ড লকডাউন শুরু করলেও রোগবিস্তারের চালচিত্রে কোন ছাপ ফেলেনি। করোনা তার নিজস্ব গতিতে রোগবিস্তার ঘটিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা বিস্তারের লেখচিত্রগুলি যদি এখন পাশাপাশি সাজিয়ে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে ইতালি, জার্মানি, স্পেন থেকে শুরু করে সুইডেন, সুইজারল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডের লেখচিত্রের চরিত্রেরমধ্যে কোনও তফাত নেই। সুইডেন ছাড়া এইসব দেশে বিভিন্ন মাপের ও ধাঁচের লকডাউন চালু ছিল বা আছে।
লকডাউনের উদ্দেশ্য প্রথম বিশ্বে কতটা সফল হয়েছে?
লকডাউনের প্রধান উদ্দেশ্য হল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দ্রুত উন্নয়ন ঘটিয়ে বাড়তি করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কতটা করা গেছে ইউরোপ আমেরিকায়? ইতালি,স্পেনে আইসিইউতে বেড না পেয়েও এবং ভেন্টিলেশনের অভাবে রুগী মারা গেছে। আমেরিকা সরকার ঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর কিনে উঠতে পারেনি, এমনকী ডাক্তারদের মাস্ক ও প্রোটেক্টিভ ডিভাইস সরবরাহ করতে আমেরিকা, ব্রিটেন ও স্পেন ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে এশিয়ার দেশগুলো যারা লকডাউন করে নি যেমন সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাই লকডাউন ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই, এ ভাবনায় গলদ রয়েছে।
আগামী কতবছর এই কোভিড নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তা আমরা জানি না। এখন যেটা বেশি প্রয়োজন ছিল, তাহলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষদের ব্যবহার-বিধিতে পরিবর্তন আনা, আর সেই জায়গায় সবাইকে আনতে গেলে দরকার আমাদের মধ্যেকার ভেদাভেদ দূর করে, সহানুভূতি ও সাহচার্যের হাত বাড়ানো। প্রয়োজন, ব্যক্তিমানুষের প্রতিশ্রদ্ধা ও সমদর্শিতার আচরণে যুক্ত হওয়া। কোনো জনস্বাস্থ্য প্রকল্প বাহুবলের ওপর নির্ভর করে সাফল্য অর্জন করতে পারে না। কোভিড নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এক দীর্ঘস্থায়ী জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের হাত ধরে গড়ে তুলতে হবে। আমরা দ্রুত এই জায়গাটা বুঝে উঠতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ সুখের হবে না।
কোভিড নিয়ন্ত্রণের সঠিক রাস্তা
লকডাউনের পক্ষে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তার কারণ এর বিপরীতে কোনো বক্তব্য বা বিকল্পের কথা কেউ বলছেন না, অথচ দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে এই দেশেই মহামারী নিয়ন্ত্রণে এক সুপারকল্পিত ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। লাগু রয়েছে এইচআইভি মহামারী নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প। কোভিড এবং এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি একই মডেলকে ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ এ দুটো রোগ ছড়ানো নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষের ব্যবহার বিধি পরিবর্তনের কৌশল সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।
ব্যক্তি-মানুষের ব্যবহারবিধি পাল্টানো এক জটিল শ্রমসাধ্য বিষয়। শুধু তথ্যের জোগান নয় মানুষের ব্যবহারবিধি পাল্টাতে তথা সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র ব্যক্তি মানুষের অধিকার রক্ষার কারণেই নয়, বিজ্ঞান বলে ব্যক্তি-মানুষের ব্যবহারবিধি চাবুক মেরে পালটানো যায় না, মানুষকে তাই তার নিজের ভালো মন্দের ব্যাপারগুলো বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা দরকার। ব্যবহারবিধি পাল্টানোর জন্য যেসব আর্থ-সামাজিক বাধাবিঘ্ন রয়েছে সেগুলো দূর করা দরকার।
আসলে আমরা যে বিকল্প ব্যবস্থাপনার কথা ভাবতে পারি না, এত কাছের থেকেও যে আমরা চলমান এইচআইভি জনস্বাস্থ্য প্রকল্প যা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত গরিব সীমান্তবর্তী মানুষের ক্ষমাতায়নের রাস্তা ধরে সাফল্য অর্জন করেছে তার গুরুত্ব না বোঝা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। তাই এদেশে জনস্বাস্থ্যের নামে এই নির্মম, অমানবিক এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাপনা কায়েম হয় এবং আমরা পরোক্ষে তার রসদ জুগিয়ে থাকি।
করোনার গতিবিধি এবং আমাদের সীমিত জ্ঞান
আমাদের দেশে যে মাপকাঠিটি সরকার সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেন তা হল ডাবলিং সময় অর্থাৎ রোগগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা দ্বিগুণ হতে যে সময় লাগছে। সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সময়কালে তিন থেকে পাঁচে পৌঁছেছিল ২৩ মার্চ অর্থাৎ গত ২৩ মার্চ থেকে করোনা বিস্তারের গতি মন্থর হয়েছিল। লকডাউনের দুদিন আগের থেকেই। এর ব্যাখ্যা হয়তো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি একটি কারণ হতে পারে, হতে পারে এদেশে করোনা অন্য দেশের তুলনায় একটু দেরিতে ঢুকেছে, যখন এই অতিমারী প্রাকৃতিক কারণে ঢলে পড়ার দিকে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড-এ। পরিসংখ্যানবিদেরা ১৭৮টি দেশের করোনার সংক্রমণের হার যাচাই করে দেখেছেন যে দেশে বিসিজি টিকা দেওয়া হয়, সে দেশের তুলনায় যেখানে দেওয়া হয় না সেখানে সংক্রমণের হার ১৯ গুণ বেশি।
আমাদের দেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ইউরোপের দেশগুলোর থেকে কম (৬ থেকে ১০ শতাংশ)। যা কিন্তু লকডাউন সহ অন্যান্য রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এদেশে ষাটোর্ধ ব্যক্তির হার (১০ শতাংশ) যা উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম সেটা একটা কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত করোনা ভাইরাস আরও অনেক ভাইরাসের মতোই দ্রুত পাল্টে যায় যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘মিউটেশন’ বলে। এই মিউটেশন কখনও ছোটো মাপের হয়। আবার বেশ কিছু সময় অন্তর বড় মাপের মিউটেশনও ঘটে থাকে। ইতিমধ্যে মিউটেশনের মাধ্যমে করোনার প্রায় এগারো রকমের সাবটাইপ পাওয়া গেছে, আগামীদিনে আরও হয়তো বাড়বে। করোনা তার নতুন হোস্টের (মানুষ) শরীরের মধ্যে আনা গোনার রাস্তায় এই মিউটেশন ঘটাচ্ছে এবং আরও ঘটবে। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী যতদিন গড়াবে মিউটেশনের ফলে জীবাণুটি ক্রমশ তার আক্রমণের তীব্রতা হারাবে তখন আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু কম মাত্রায় ঘটবে। যেমনটা রাশিয়ায় দেখা যাচ্ছে। সে দেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হার ১ শতাংশর কম। তৃতীয়ত রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি রোগজীবাণুর ওপর প্রভাব ফেলে। এদেশে লক্ষ কোটি মানুষ খোলা মাঠে কাজ করে, যে পরিবেশে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে হয়তো সংক্রমণ কম হবে। চতুর্থত, জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সহ আরও বহু্বিধ উপাদান রয়েছে। হয়তো এককভাবে কোনো একটি নয় কিন্তু বহু কারণ ও উপাদান সম্মিলিতভাবে মহামারী বিস্তারকে প্রভাবিত করে ফলে আগামীদিনে কোভিড মহামারীর তীব্রতা কমলেও কোভিড কিন্তু আমাদের ছেড়ে চলে যাবে না। বছর বছর কোভিড ঘুরে ফিরে আসবে, হয়তো ঋতু পরিবর্তনের হাত ধরে। কোভিড টিকে রইবে জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তাই আমাদের প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার, অন্তত পক্ষে আগামী ৫ বছরের পরিকল্পনা, যার কেন্দ্রে পুলিশ-প্রশাসন নয়, যা গড়ে তুলতে হবে জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। গরিব সীমান্তবর্তী মানুষদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণের নেতৃত্বের জায়গায় তাদের তুলে আনতে হবে।
শুনতে ভালো না লাগলেও সত্যি কথাটা হলো মহামারী নিয়ন্ত্রণের নামে যে লকডাউন করা হয়েছে তা শুধু এদেশের পক্ষে অনুপযুক্তই নয়, প্রায় অকার্যকর এবং বিচ্ছিন্নভাবে একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা হিসেবে লাগু করার ফলে অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থাপনা সব মানুষের কথা ভেবে করা হয়নি। সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের নিরাপত্তা বজায় রাখতে এই ব্যবস্থাপনা। তাই লকডাউনের বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে যারা মাতামাতি করছেন, তারা সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে এই সহজ সত্যটা এড়াতে চাইছেন।
(ড স্মরজিত জানা, মহামারী বিশেষজ্ঞ, করোনা ন্যাশনাল টাস্ক ফোরস আইসিএমআর-এর সদস্য। প্রাক্তন অধ্যাপক, অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিঊট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাব্লিক হেলথ। ন্যাকো-র উপদেষ্টা। দুর্বার-এর প্রতিষ্ঠাতা।)
সাধুবাদ এমন সত্যটা প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরায়
শ্রদ্ধা নেবেন স্যর
ভীষণ ভালো বললেন। এই কথাগুলো যতো বেশি মানুষের কাছে যাবে, মানুষের সচেতনতা বাড়বে, সত্যিই এই লকডাউনের কোনো মানে হয়, সমাজের অল্পসংখ্যক লোক এটা পালন করে। মানুষের আত্মসচেতনা বাড়ানোর দরকার ছিলো, ওটা এখনও জিরো, শুধু করোনা নয় যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রজ্যোজ্য
কারোর করোনা হলে কাছের মানুষের হৃদয় হীনতা মন খারাপ করে দেয়। লোকের এতো ভয় আর সংস্কার! খুবই খারাপ লাগছে।
ভালো লেখা। আসল সত্য টা শেষে লিখলেন। সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো।