নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তারা Daisy নামে একটি গরুর জন্ম দিয়েছেন যার দুধে বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন নামে একটি প্রোটিন অনুপস্থিত। পাঠক হয়ত ভাববেন যে এটা আর এমন কি ঘটনা? কিন্তু না, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
বর্তমান বিশ্বে গরুর দুধের থেকে অ্যালার্জি একটা বিরাট চর্চার বিষয়। Cows Milk Protein Allergy (CMPA) বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে পশ্চিমী দেশগুলোতে যেখানে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর প্রবণতা কমছে। আমাদের দেশও হয়ত এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। গরুর দুধে এমন কিছু প্রোটিন থাকে যা আমাদের মাতৃদুগ্ধে নেই। তাই অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই এই গরুর দুধ নানা রকম অসুবিধে সৃষ্টি করে থাকে। অনেক শিশুই এর ভুক্তভোগী হয়—পেটে ব্যাথা, বমি, পায়খানা (এবং পায়খানার সাথে রক্তপাত), স্কিন অ্যালার্জি ইত্যাদি তো হয়ই, অনেক ক্ষেত্রে শিশুর বেড়ে ওঠাও (growth) ঠিকমত হয় না। একশ জন শিশুর মধ্যে গড়ে তিন জন এর শিকার হয় এবং সাধারণত এটা হয় শিশুর তিন বছর বয়সের মধ্যে। ৫০ শতাংশ শিশুর এই অসুবিধে দূর হয় ৮ বছর বয়সের মধ্যে কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই অসুবিধে চলে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। যে শিশুর বাড়ীতে ভাই, বোন, বাবা, মা’র eczema বা asthma থাকে তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মায়ের দুধ খেলে কি এই সমস্যা হয় না? হয় কিন্তু তার সম্ভাবনা অনেক কম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা’কে দুগ্ধ জাতীয় জিনিষ খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হয় শিশুর স্বার্থে। অনেকে প্রশ্ন করেন যে ছাগলের দুধ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান কি সম্ভব? দু:খের ব্যাপার যে ছাগলের দুধেও প্রায় একই ধরণের প্রোটিন থাকে কাজেই যে শিশুর গরুর দুধের প্রোটিনে অ্যালার্জি তারা ছাগলের দুধ খেলেও একই রকম অসুবিধেয় পড়বে। দু’ধরণের প্রোটিন থাকে গরুর দুধে। প্রথমটির নাম Casein—এটা দুধ টকে ছানা কেটে গেলে যা থাকে; আর Whey—সেই ছানা কাটা অংশ সরিয়ে ফেললে যে জলীয় অংশ পড়ে থাকে। শিশুরা এই দুই প্রোটিনের যে কোনটির প্রভাবেই অ্যালার্জির শিকার হতে পারে। তাহলে পৃথিবীতে এখন কীভাবে এই সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে? মাতৃদুগ্ধে ফিরে যাওয়া এবং মা’কে দুগ্ধজাত সব খাদ্য সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা হল সর্বপ্রথম পদক্ষেপ। তাছাড়া দুধের প্রোটিনকে ছোট অংশে বিভাজিত করে হাইড্রোলাইজড (hydrolysed) ফর্মুলা তৈরী করা হচ্ছে। এই দুধ যথেষ্ট দামী-আমাদের মত দেশে অধিকাংশের আয়ত্তের বাইরে- তাছাড়া অ্যালার্জির সম্ভাবনা এতে নির্মূল হয় না।
CMPA বাড়ছে কেন ? নানা মুনির নানা মত। আজকের পৃথিবীতে বিশেষত পশ্চিমী জগতে অধিকাংশ নারী পড়াশোনা করে চাকরি জীবন পালন করেন। চাহিদাবৃদ্ধির সাথে অর্থের প্রয়োজনও সংসারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীপুরুষ দুজনে উপায় না করলে আজকের জগতের চাহিদা মেটানো বেশ কঠিন কাজ। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে কিছুদিন পরেই মাসমাইনে ভীষণভাবে কমে যায়। মায়েরা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে চান সন্তানের জন্মের পরে। সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কোথায়? ব্রেস্ট ফিডিং যত কমছে গরুর দুধের অ্যালার্জি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য তার মানেই একটা থেকে আরেকটা হচ্ছে এটা বলা মুশকিল। Cause and effect এত সহজে প্রমাণ করা যায় না। সব ধরনের অ্যালার্জির প্রাদুর্ভাব (prevalence) বাড়ছে কাজেই গরুর দুধের অ্যালার্জিই বা বাড়বে না কেন?
বিজ্ঞানীরা তাই বহুদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উন্নত ধরণের দুধের সন্ধানে। বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন (যা Whey protein এর মধ্যে থাকে) অ্যালার্জির অন্যতম কারণ বলে ধরা হয়। নানা পদ্ধতিতে বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিনকে নষ্ট করার চেষ্টা চলেছে অনেক দিন ধরে- যেমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি, উচ্চচাপ, উৎসেচক দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি। দুঃখের বিষয় যে এই সব পদ্ধতি অন্যান্য প্রোটিনকেও ধ্বংস করে ফেলে- যা গরুর দুধের উপকারিতা অনেক কমিয়ে দেয়। নতুন চিন্তাধারার উদ্ভাবন দরকার। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে শুরু করলেন কীভাবে বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিনের জিনকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়- সেই সুত্রেই আজকের লেখা আর Daisy’র জন্মকাহিনী। তবে এই নিয়ে জানতে গেলে জেনেটিক্সের গোড়ার দুচার কথা আলোচনা করা দরকার।
আমাদের কোষের অভ্যন্তরে থাকে নিউক্লিয়াস- যার মধ্যে ২৩জোড়া ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমে জড়ানো থাকে DNA’র ফিতে। মজার কথা DNA’র বর্ণমালা হল চার অক্ষরের। A (Adenine), C (Cytosine), G (Guanine) আর T (Thymine)- এদের আমরা বেস (base) বা নিইক্লিওটাইড বলি। DNA’র দুটো ফিতে (strand)-একটা আরেকটাকে জড়িয়ে থাকে- সেই থেকেই এসেছে double stranded DNA কথাটা। জড়িয়ে থাকার এক অদ্ভুত নিয়ম আছে- এক ফিতের A সব সময় অন্য ফিতের T’র সাথে লেগে থাকে আর C’র সঙ্গী সব সময় G. সেই কারণেই একটা ফিতেয় কোন base আছে জানা থাকলে অন্য ফিতের base গুলোর অবস্থান সহজেই অনুমান করা যায়।
জিন কাকে বলে? ধরুন আমরা DNA’র ফিতে বরাবর বানান পড়ে যাচ্ছি- সেগুলো যেভাবে ইচ্ছে সাজানো থাকতে পারে-এমনকি পরপর একই অক্ষরও থাকতে পারে। সেই বর্ণ সমন্বয় কখন প্রোটিন তৈরীর সংকেত (code) বহন করে কখনও বা করে না। সংকেত বহন করলে তাকে আমরা জিন (gene) বলি- না করলে আমরা বলি junk DNA. সব জিন একই মাপের নয়-কিছু ছোট কিছু বড়। কোন ক্রোমোজোমের কোথায় তারা আছে, কি তাদের বানান এসব জানা ভীষণ জরুরী। আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি জিনিষের জন্য জিন কোথাও না কোথাও আছে- যেমন ধরুন চুলের রং, নাকের আকৃতি বা কানের চুল। কিন্তু ইনসুলিন তৈরীর জিন আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ পাওয়া গেলেও নাকের আকৃতির জিন আবিষ্কারে তার সম্ভাবনা কম।
জিনের কাজ কী? জিনের কাজ প্রোটিন তৈরী কিন্তু সে তা নিজে করে না- সে শুধু প্রোটিন তৈরীর সংকেত বহন করে এবং সেই code পরের প্রজন্মে পাঠায়। প্রোটিন তৈরী করে রাইবোজোম যা থাকে কোষের সাইটোপ্লাজমে। DNA বা জিন থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে। DNA নিউক্লিয়াসের বাইরে বেরোয় না। এ অনেকটা লাইব্রেরির রেফারেন্স বই এর মত- আপনি লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পারেন কিন্তু বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু আপনার যদি বাড়ি নিয়ে গিয়ে পড়ার দরকার হয় (ভাল ছাত্রছাত্রীদের হয়, আমার প্রয়োজন পড়েনি) –তখন আপনাকে ফটোকপি করে তা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইতে হবে। DNA’র ফটোকপিও এভাবে নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমে বেরিয়ে আসে- যাকে পরিভাষায় বলে messenger RNA (mRNA)- এই পদ্ধতির প্রযুক্তিগত নাম হল ট্রান্সক্রিপশন (transcription). RNA’র সাথে DNA’র কিছু তফাত আছে কাজেই তাকে ফটোকপি বলাটা হয়ত ঠিক নয়। RNA’র একটা ফিতে (DNA’র দুটো ফিতের জায়গায়), বানানেও সামান্য তফাত- T’র জায়গায় U (Uracil). T থেকেই U এর সৃষ্টি, তফাত শুধু একটা মিথাইল (CH3) গ্রুপের। নিয়ম একই থাকে- U দরকারে শুধু A’র হাত ধরে। কিন্তু জিনের কোড নিঁখুতভাবে সাইটোপ্লাজমে চলে আসে এবং রাইবোজোম সেই mRNA’র কোড পড়ে পলিপেপটাইড প্রোটিন তৈরী করে। এই পদ্ধতিকে পরিভাষায় বলে ট্রান্সলেশান (translation)।
কোষ বিভাজনের সময় অনেক সময় বানান ভুল হয়ে যায়। নতুন বানানের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও মানে হয় না – যাকে বলে nonsense mutation এবং আমাদের spellchecker তাকে মুছে দেয়। কখন আবার অন্য মুশকিল হয়- নতুন বানান হয়ত নতুন কোনও অজানা প্রোটিনের কোড হয়ে ওঠে- যে প্রোটিন হয়ত আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক-কখন তা ক্যানসার প্রোটিনের সংকেত বহন করে। এই নতুন বানান কিন্তু spellchecker মুছে দেয় না – একে বলা হয় missense mutation. আপনি ধরুন Word এ ছুটির দরখাস্ত করছেন এবং সেই চিঠিতে আপনি ভুল করে কিছু অশ্রাব্য কথা লিখে ফেললেন- আপনার spellchecker তা correct করবে না। কিন্তু আপনি কখনই চাইবেন না যে সেই চিঠি আপনার অফিসের বসের চোখে পড়ে।এই missense mutation (পরিব্যক্তি) থেকেই নাকি oncogene এর সৃষ্টি। Oncus এর অর্থ টিউমার তাই যে জিন ক্যানসার প্রোটিনের কোড বহন করে তাকে আমরা oncogene বলি।
বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্ষতিকারক জিনের কাজ বন্ধ করে দিতে- এর নাম দেওয়া হয়েছে post transcription gene silencing (PTGS) – অর্থাৎ mRNA থেকে ক্ষতিকারক প্রোটিন তৈরী বন্ধ করা। RNAi এই ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
দুই মার্কিন বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ফায়ার আর ক্রেগ মেলো এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন mRNA বাহিত জিনকে আটকে দেওয়ার জন্য। এই পদ্ধতির নাম RNA interference বা সংক্ষেপে RNAi. ২০০৬ সালে এই দুজনকে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয় এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে ক্যানসার সহ বহু রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।
দু-ফিতের RNA (double stranded RNA) কোষের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়- যাকে ডাইসার (dicer) উৎসেচক ছোট ছোট টুকরোর dsRNA-তে ভেঙ্গে ফেলে- এদের পোষাকি নাম small interfering RNA (siRNA). সেই siRNA কে দু-ফিতে থেকে দুটি এক-ফিতেতে পরিবর্তন করা হয় যার নাম single stranded RNA (ssRNA)- এদের একটির নাম passenger (sense) strand আর অন্যটির নাম guide (antisense) strand. Passenger strand-কে নষ্ট করে ফেলে Argonaute 2 নামের এক প্রোটিন। Guide strand প্রবেশ করে RNA induced silencing complex (RISC) এর মধ্যে। এর পরের ব্যাপার বেশ নাটকীয়।Guide strand-RISC complex জুড়ে যায় টার্গেট mRNAর সাথে। এবার একটু বৈজ্ঞানিক কারিগরি দরকার। mRNAর যে জীন (code) আমরা আটকাতে চাই তার বানান আমাদের জানা দরকার। Guide strand এমনভাবে ঠিক করা হয় যাতে তার নিউক্লিওটাইড base যেন mRNA-র পরিপূরক হয়- মানে mRNA-তে A থাকলে Guide strand-এ U থাকতে হবে, G থাকলে C. ইংরিজি পরিভাষায় একে বলে pairing with complementary sequence in a mRNA molecule. RISC তখন mRNA-কে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙ্গে ফেলে- কাজেই mRNA-র সেই code থেকে প্রোটিন translated হতে পারে না- মানে সেই জিনের প্রকাশকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
সেইভাবেই বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন প্রোটিনের জিনকে শনাক্ত করে RNAi পদ্ধতির মাধ্যমে সেই জিনকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই Daisy-র দুধে বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন নেই।
Daisy-র দুধে কিন্তু Casein প্রোটিনের অনুপাত বেশী। আমরা জানি না Daisy-র মত transgenic গরুর দুধ স্বাদে আলাদা কিনা – কারণ transgenic গরুর দুধ পান করার অধিকার এখনো নেই। আমরা এইটুকু জানি যে এই দুধ একটু বেশী হলুদাভ (সাধারণ গরুর দুধের তুলনায়)। বিজ্ঞানীরা মনে করেন casein-এর আলোকবিচ্ছুরণই নাকি এর জন্য দায়ী। একটা মজার ব্যাপার- Daisy জন্মায় লেজহীন। বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন জিনকে স্তব্ধ করার সাথে লেজহীনতার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা তা বিজ্ঞানীদের এখনো জানা নেই। অনেকে তাই এই লেজহীনতাকে epigenetic phenomenon বলছেন আপাতত।
পাঠক হয়ত ভাববেন- এত কাঠখড় পোড়ানো একটা নতুন ধরনের গরুর দুধ বানাবার জন্য যা অল্প কিছু শিশুর হয়ত প্রয়োজনে লাগতে পারে? না, ব্যাপারটা তা নয়-এটা হল একটা নতুন যুগান্তকারী পদ্ধতির সফল প্রয়োগ। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগে অনেক জিনকে স্তব্ধ করে দেওয়া যেতে পারে তার থেকে polypeptide protein translated হওয়ার আগে। এই ব্যাপার oncogene-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য- ভবিষ্যতে হয়ত এই RNAi পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের genetic cancer এর চিকিৎসা সম্ভব হবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে বিভিন্ন ক্যানসারের জিন নিয়মিত আবিষ্কার হচ্ছে এবং হবে। Daisy তাই এক বৃহৎ প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ। তবে এই নিয়ে এখনো প্রচুর গবেষণা চলছে- আমাদের তো জানতে হবে যে Daisy-র লেজ গজালো না কেন ?
(ছবি internet থেকে সংগৃহীত)
Great starting. Let’s hope this becomes
A successful process for therapeutics
Congratulations to all involved.