মেডিক্যাল কলেজের নানা হস্টেলের কোন একটার পাশের বাড়িতে কোন এক (বাঙালি) মা, তার ছেলেকে খুব মেরে ধরে পড়াতেন। সেই মারধর এবং তৎপরবর্তী কান্নাকাটির শব্দে হস্টেলের উদীয়মান ডাক্তাররা নিজেদের পড়া করতে পারতেন না বলে বিরক্ত হতেন, কিন্তু রোজ সন্ধ্যায় এই মারামারিটার জন্য অপেক্ষাও করতেন। সবচেয়ে মজা ছিল, মা পড়াতেন ইংরিজি বর্ণমালা – কিন্তু তাতেই সারা সন্ধে কেটে যেত। তারও চেয়ে মজা ছিল এই, যে পড়া হত যেটা সেটা পাশের বাড়ি থেকে শোনাত এমন: ‘এ–বি–সি–ডি… অটর্ বটর্ পট্!” এই অটর্ বটর্ পট্ যে ই, এফ, জি, এইচ… ইত্যাদি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু কী করলে ই, এফ ইত্যাদিকে অটর্ বটর্ পট্ বানানো যেতে পারে তা আমরা বুঝতাম না। হস্টেলবাসীদের কথায় যারা সন্দেহ করতেন, তাঁরা নিজেরা স্বকর্ণে শুনে বিবাদ ভঞ্জন করতে গিয়ে নিজেরাই ‘অটর্ বটর্ পট্ – অটর্ বটর্ পট্’ আওড়াতে আওড়াতে ফিরে আসতেন। শেষ দিন অবধি আমরা এ রহস্য সমাধান করতে পারিনি।
হস্টেলের ছেলেরা একদিন সাংঘাতিক বিরক্ত হয়ে গিয়েছে পাশের বাড়ির মারধরের ফলে। সামনে কোন পরীক্ষা–টরিক্ষা ছিল না নিশ্চয়ই, তাই সকলে মিলে ঠিক করেছে, যাই বাইরে খেয়ে আসি, হস্টেলের মেস–এ খাব না। চার পাঁচ জন মিলে গিয়েছে সামনের কুমার্স ক্যান্টিনে খেতে, খেয়ে দেয়ে ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ করে বেড়িয়েছে, এ–বি–সি–ডি– অটর্ বটর্ পট্ আওড়াতে আওড়াতে। বেরিয়েই দেখে রাস্তার ধারে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে এক জন সার্জেন্ট সিগারেটের দোকানে গিয়েছেন। দিনের শেষ, ক্লান্ত সার্জেন্ট সবে সিগারেট ধরিয়ে বাইকে ফিরেছেন, এমন সময় অভিজিৎ – ওর মাথাতেই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সিম্পল বদবুদ্ধিগুলো আসত – ধড়ফড় করে গিয়ে জানতে চেয়েছে, “আচ্ছা দাদা, মিছিলটা কি চলে গিয়েছে?”
রাত্তির প্রায় সাড়ে ন’টা – এ হেন সময়ে এমন বিদঘুটে প্রশ্নে হকচকিয়ে গিয়ে পুলিশ বলল, “কিসের মিছিল? এত রাতে?”
অভিজিৎ একেবারেই সিরিয়াস মুখ করে বলল, “শ্যামবাজার থেকে আসছে, এসপ্ল্যানেড ঈস্ট যাবে,” হাত উলটে ঘড়ি দেখে (উনিশশো আশির দশক। লোকে কব্জিতেই হাতঘড়ি পরত) বলল, “কী মুশকিল বলুন তো! বেরিয়ে গেলে এখন কোন দিকে দৌড়ব?”
স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের কাছে অত রাতে কোন মিছিলের খবর নেই। তাই সার্জেন্ট বললেন, “কাদের মিছিল?”
অম্লানবদনে অভিজিৎ, একেবারে না হেসে বলল, “অটর্ বটর্ পট্।”
হতভম্ব সার্জেন্ট বললেন, “কীঃ?”
অভিজিৎ বলল, “দেখেননি কখনও? ওদের স্লোগান হল, ‘এ–বি–সি–ডি–অটর্–বটর্–পট্।”
এমনটা কতক্ষণ চলত জানি না, তবে এখানে অভিজিতের সঙ্গীদের হাসি চাপা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। সার্জেন্ট খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন, “আপনারা পড়াশোনা জানা ভদ্র ঘরের ছেলে। আমাদের সঙ্গে এমন ইয়ার্কি মেরে কী লাভ হয় আপনাদের?” বলে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন।