ডেভিড স্যান্ডার্স (১৯৪৫-২০১৯), স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন, সেই আন্দোলনের এক অগ্রণী কর্মী। ডেভিডের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে তাঁর বড় হয়ে ওঠা রোডেশিয়ায় (বর্তমানে জিম্বাবুয়ে)। সেই দেশেই তাঁর ডাক্তারি পাশ করা। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই র্যাডিকাল ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। গ্রেট ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল থেকে রোডেশিয়াবাসীর মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম অংশীদার হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন ডেভিড। তিনি মনে করতেন স্বাধীনতার সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক।
১৯৭০-এর দশক। রাজনৈতিক হুমকির মুখে পড়লো তাঁর জীবন। রোডেশিয়া থেকে নির্বাসিত হলেন ডেভিড; রাজনৈতিক অভিবাসী হয়ে আশ্রয় নিলেন ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে। তবে তিনি রোডেশিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর সওয়াল অব্যাহত রাখলেন। যুক্তরাজ্যে গিয়েও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। ডেভিড ছিলেন শিশুরোগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ব্রিটেনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস-এর বিরুদ্ধে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউকে পলিটিক্স অফ হেলথ গ্রুপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনে থাকাকালীন, তিনি মার্কসবাদী চিকিৎসক ভিসেন্তে নাভারোর লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত আলমা আটা ঘোষণার জোরালো সমর্থক ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্যে, ডেভিড ‘ন্যাশনাল হেলথ সিস্টেম’-এও কাজ করেছেন।
১৯৮০ সাল। স্বাধীনতা পেলো ডেভিডের দেশ। সদ্য স্বাধীন জিম্বাবুয়েতে ফিরে এলেন তিনি। জনমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। আলমা আটা ঘোষণাকে সামনে রেখে ডেভিড ও তাঁর সহযোগীরা কাজ শুরু করলেন। তাঁরা জোর দিলেন সম্প্রদায়-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর, যেখানে রোগ প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ বেশি প্রাধান্য পাবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারের ‘যেখানে ডাক্তার নেই’ বইটি ব্যবহার করতেন। তাছাড়া পিয়াক্সটলা প্রকল্প সম্পর্কেও খুব ভালো করে জানতেন তিনি। তাই তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নারকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ওয়ার্নার ভাগ করে নিয়েছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের অনেকেই পশ্চিমি বা ওয়ার্নারের ভাষায় বলতে গেলে ঔপনিবেশিক চিকিৎসা মডেলের সমর্থক ছিলেন। ডেভিড স্যান্ডার্স মনে করতেন এই পশ্চিমি চিকিৎসা মডেলে স্বাস্থ্যের পরিবর্তে অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি।
ডেভিড ও তাঁর সহযোদ্ধাদের উদ্যোগের ভালো অগ্রগতি হতে দেখা গেল। আসলে এই অগ্রগতি ছিল স্বাভাবিক। কেননা দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব তখন সদ্য জয়ী স্বাধীনতার বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাই তাঁরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও গণতান্ত্রিক করতে চেয়েছিলেন; জোর দিয়েছিলেন জনগণের ক্ষমতায়নের ওপর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইতিহাসের নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না সেই দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই বীর বিপ্লবীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ধীরে ধীরে নিজেরাই অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। সম্পদ আবার শীর্ষে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করলো এবং রাষ্ট্র হয়ে উঠলো আরও কর্তৃত্ববাদী। সময়ের সাথে সাথে, জিম্বাবুয়েতে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে এগিয়ে নেওয়ার পথের বাধাগুলি প্রকটভাবে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। সকলের জন্য স্বাস্থ্য ও সাধারণ মানুষকে ন্যায্য চিকিৎসা পরিষেবার দেওয়ার যে স্বপ্ন ডেভিড দেখেছিলেন তা আর পূরণ হলো না। ফলে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে ডেভিড যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলেন সেই সময়ে সেখানে বর্ণবাদী শাসন চলছে। তিনি দেখলেন শ্বেতাঙ্গ অভিজাত ও কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে সম্পদ এবং স্বাস্থ্যের বিরাট বৈষম্য। সেখানে চলছে বর্ণ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। বর্ণবৈষম্য-এর জন্য সেই সময় চিকিৎসকদের সংগঠনও ভেঙে যাচ্ছে। ব্ল্যাক কনসায়েন্স মুভমেন্টের একজন স্পষ্টভাষী নেতা স্টিভ বিকুর নির্যাতনকে কেন্দ্র করে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ আফ্রিকা (MASA) থেকে কিছু সদস্য বেরিয়ে আসেন এবং ন্যাশনাল মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন (NAMDA) গঠন করেন। নামডা জাতিগত সমতার জন্য লড়াই শুরু করেছিল। তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন কমিউনিটি বা সম্প্রদায়-ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবা নেটওয়ার্ক। প্রথাগত শিক্ষাহীন স্থানীয় মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্য কর্মী তৈরি করা হচ্ছিল। ডেভিড যুক্ত হলেন নামডার কর্মসূচির সঙ্গে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংহতি জ্ঞাপন করার জন্য আহ্বান জানালেন আন্তর্জাতিক চিকিৎসক সম্প্রদায়ের কাছে। ডেভিডের ডাকে সাড়া দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। সম্প্রদায়-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁরা।
১৯৯১ সালে নিকারাগুয়া ইন্টারন্যাশনাল পিপলস হেলথ কাউন্সিল (আইপিএইচসি) এবং ২০০০ সালে বাংলাদেশের পিপলস হেলথ মুভমেন্ট (পিএইচএম) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ডেভিড। তিনি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একাধিক বই ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বই ‘দ্য স্ট্রাগল ফর হেলথ: মেডিসিন অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অফ আন্ডারডেভেলপমেন্ট’। সেই সময় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল বইটি। সকলের জন্য স্বাস্থ্যের দাবিতে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের। ১৯৯৭ সালে তিনি ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেছিলেন ‘কোশ্চেনিং দ্য সলিউশন: দ্য পলিটিক্স অফ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এন্ড চাইল্ড সারভাইভাল’। এই বইতে বলা হয়েছে ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন)-এর ব্যাপক উৎপাদনে ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর অনেক কমে গিয়েছে। পাশাপাশি শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিগ ফার্মাগুলি এই জীবনদায়ী ওআরএস প্যাকেট থেকে প্রচুর মুনাফা করছে। আর এই মুনাফা অর্জনে সহযোগিতা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ। ফলে আদর্শের চেয়ে মুনাফা বেশি গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে। এই মুনাফা করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবনহানি হতে পারে। তাই ডেভিডরা গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেন ‘কম ব্যয়বহুল, আরও দ্রুত উপলব্ধ, এবং সম্ভাব্য আরও কার্যকর হোম সলিউশন’এর ওপর।
কৃতজ্ঞতা
ডেভিড ওয়ার্নার, “ডেভিড স্যান্ডার্স: পাইওনিয়ার অফ হেলথ ফর অল”, ওয়ার্ল্ড নিউট্রিশন, ভলিউম ১০, নং ৩, পৃপৃ. ১০২-১০৫।
ঋদ্ধ হলাম🙏