ক্যান্সারকে অনেক সময় প্রাথমিক অবস্থায় ধরে ফেলে আটকে দেওয়া যায়, হারিয়ে দেওয়া যায়, লিখছেন ডাঃ প্রদীপ্ত ঘোষ।
বাড়ছে। হ্যাঁ, অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই, দিন দিন ক্রমশই আরও বেশি করে থাবা বসাচ্ছে। রাশিবিজ্ঞানের নীরস তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ না জেনেও এটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়, প্রতি বছর বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা।
চিকিৎসক বা বিজ্ঞানী না হয়েও, কেবল চোখ কান খোলা রাখলেই আপনি বুঝতে পারছেন ক্যান্সারের ঘটনা কিন্তু বেড়েই চলেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। রোজ। প্রতিনিয়ত ।
ঠিক যে পাড়াটায় আপনি থাকেন , ভেবে দেখুন তো গত কয়েক বছরের মধ্যে সেই পাড়াতেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন কতজন?
আপনার অফিসে, আপনার আড্ডার ঠেকে, আপনার চেনা পরিচিতের বৃত্তে ভেবে দেখুন তো, কতজন শেষ কয়েকটা বছরে এই রোগের শিকার হয়েছেন?
আর, আপনার পরিবার? আপনার প্রিয়জন? আপনার আত্মীয়? হিসেব করে দেখুন, বিগত কয়েক বছরে কতজন?
হ্যাঁ, বাড়ছে। এটা আজকাল জলের মতো পরিষ্কার। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, এই রোগ আঘাত হানছে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের উপরে।
ICMR কী বলছে? ২০১২ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে ভারতে রিপোর্টেড ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ষোল শতাংশ বেড়েছে। হ্যাঁ, আমরা সবাই বেশ বুঝতে পারছি, বেড়েছে। বাড়ছে।
কিন্তু, বাড়ছে কেন?? কী করছেন তবে চিকিৎসক আর বিজ্ঞানীরা? তারা এই রোগটার রূপ, প্রকৃতি, কারণ নির্ধারণ করবার জন্য উদয়াস্ত চেষ্টা করে চলেছেন । নিত্যনতুন চিকিৎসা , অত্যাধুনিক ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে। লড়াই চলছে ।
তাহলে, বাড়ছে কেন?
কারণ – যে যে কারণগুলোর জন্য ক্যান্সার হয় বলে বহুদিন ধরেই লোকে জানে, সেই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো উত্তরোত্তর বাড়ছে।
কীরকম সেই রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো? খুব বিশদে না জানলেও সেগুলোর কয়েকটা আমরা জানি…
১) বয়স
২) বংশগত
৩) বিড়ি সিগারেট
৪) নানা রকমের রেডিয়েশন
৫) নানা ধরণের ভাইরাস
ইত্যাদি ইত্যাদি…
বয়স , হেরিডিটি এদের নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের অসাধ্য। কিন্তু যেগুলো করা যায়? আমরা নেশা কমাচ্ছি না, দিন দিন আরও আসক্ত হচ্ছি। রোজ নিত্যনতুন রেডিয়েশন আমাদের জিনের কাঠামোয় এমন রদবদল করছে , নানা ধরণের দূষণ আমাদের জিনে এমন পরিবর্তন আনছে যার পরিণতি ক্যান্সার। অসতর্ক , অসচেতন আমরা ভোগবাদী জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে ক্যান্সারের জন্য দায়ী নানা ভাইরাসকে ডেকে আনছি শরীরে।
অথচ, একটু, আর একটু বেশি শরীর সচেতনতা আটকে দিতে পারে ক্যান্সারের মূল কারণগুলোকেই।
আমরা বুঝেও বুঝছি না, শুনেও শুনছি না। ক্যান্সারের শেষ স্তরে পৌঁছে যাওয়া ,যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মৃত্যু পথগামী, চেনা মানুষটাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, আতঙ্কিত হচ্ছি । তবু শোধরানোর চেষ্টা করছি না।
‘ প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’ – এই প্রবাদ আর সব রোগের মতোই ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও সত্যি। হওয়ার আগেই বাধা দাও; যতটা সম্ভব । যেটুকু সম্ভব ।
প্রাথমিক স্তরেই আটকে দেওয়া যাক প্রাণঘাতী এই রোগকে। চিকিৎসা বিজ্ঞান দিন দিন অস্ত্র বাড়িয়ে নিচ্ছে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে । ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে চিকিৎসকরা আর হার মানছেন না আগের মতো। শুধু যতটা সম্ভব আগে রোগটাকে নির্ণয় করতে হবে, আগেভাগে ক্যান্সারের উপস্থিতি বুঝে নিতে হবে, যতটা আগে সম্ভব চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছে যেতে হবে। তাহলেই, বিশ্বাস করুন তাহলেই, অনেকাংশে আটকে দেওয়া যাবে ক্যান্সারকে।
আর, এই আগেভাগে বুঝতে গেলে আপনাকে হতে হবে সচেতন। ক্যান্সার বিষয়ে অবগত হোন। সারা বিশ্বে ‘early diagnosis, early treatment’ হচ্ছে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বপ্রধান অস্ত্র। আগে থাকতেই ডায়াগনোসিস করতে হবে। যত সম্ভব দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
কিভাবে বুঝবেন? বিভিন্ন ক্যান্সার এডুকেশন প্রোগ্রাম জানাচ্ছে কতগুলো বিপজ্জনক উপসর্গের কথা… যেগুলো দেখতে পেলেই, বুঝতে পারলেই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হোন। তৎক্ষনাৎ । রোগটা নির্ণয় হোক আগেই। চিকিৎসা শুরু হোক আগেই।
কী সেই বিপজ্জনক লক্ষণ গুলো? জানতেই হবে।
১ ) স্তনে কোনও রকম শক্ত বা ফোলা অংশ। হ্যাঁ, পরীক্ষা করুন নিজেই। নিয়মিত ভাবে। বিশেষত, যাদের বংশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী আছেন,তারা অবশ্যই ।
২) তিল বা আঁচিলের আকার, আয়তন বা রঙের পরিবর্তন। হ্যাঁ লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩) কিছুদিন ধরেই ধারাবাহিক খাওয়ার ইচ্ছে কমে যাওয়া, বদহজম ,অজীর্ণ, কনস্টিপেশন বা বারংবার মলত্যাগ। এগুলোকে আর সহজ ভাবে নেওয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৪) অনেকদিন ধরে কাশি বা পরিবর্তিত কন্ঠস্বর। মোটেই সুবিধের নয়।
৫) পিরিয়ড কালে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা পিরিয়ডের নির্ধারিত সময় ছাড়া অন্য সময় রক্তস্রাব হওয়া। কিছুদিন ধরে এরকম চলতে থাকলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
৬) শরীরের কোনও অংশ থেকে রক্তক্ষরণ। নাক দিয়ে রক্ত, কাশির সঙ্গে রক্ত, প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত। মনে রাখবেন, বিপজ্জনক হতে পারে।
৭) হঠাৎ করেই শরীরের ওজন কমে যাওয়া। এটা অনেক কারণেই হতে পারে। তবে ক্যান্সার অন্যতম একটা কারণ।
৮) কিছুদিন ধরেই শরীরের কোনও ঘা বা ফোলা জায়গা, যা সারছে না । সতর্ক হোন।
এগুলো অন্তত মাথায় রাখুন। বিশ্বাস করুন, বহুক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো দিয়েই ক্যান্সারের বাসা বাঁধা শুরু হয় আমাদের শরীরে।
এর বাইরেও আরও নানান ধরনের উপসর্গ হয়, যার পরিণতি ক্যান্সার। কিছু লক্ষণ দেখে আগে থেকে বুঝতেই পারা যায় না। দুঁদে , অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাও বুঝতে পারেন না। কিন্তু , নিদেনপক্ষে এই বিপজ্জনক লক্ষণগুলো মনে রাখতে হবেই। এরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘাতক ক্যান্সারের আভাস দেয়।
তাহলে, সচেতনতা । ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কে জীবন থেকে বাদ দেওয়া।
আর, সতর্ক হওয়া। উপরোক্ত বিপজ্জনক উপসর্গ বুঝতে পারলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
বিশ্বাস করুন, অনেকক্ষেত্রে আমরাই জিতব ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। তাই আজ থেকে নয়, এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হোক ক্যান্সার নিয়ে সচেতন হওয়া, সচেতন করা। সাবধান হওয়া, সাবধান করা।
কে বলতে পারে?
এইদিন হয়তো আর দূরে নয়…যখন ক্যান্সারকে আমরা আর ভয় পাবো না। হারবো না ক্যান্সারের কাছে। উলটে ক্যান্সারকেই হারিয়ে দেবো অবলীলায় ।