ডাক্তার মধুবন্তী বসু বেশ নামকরা নিউরোলজিস্ট। কলেজের বন্ধুত্বের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই পেশেন্ট রেফার করেন ডাক্তার নন্দীর কাছে। সেই সূত্রেই তাঁর কাছে কয়েক মাস হল দেখাতে আসছে রিগ্ধা।
রিগ্ধা নিজে আসেনি ঠিক –সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া রিগ্ধা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কিন্তু কলেজ শুরু হওয়ার পর প্রথম একবছরের বেশিরভাগটাই তার কেটে গেছে বাড়িতে থেকেই। আর সেইজন্যেই ভারী চিন্তায় পড়ে বেশ কিছু ডাক্তারের কাছে ঘুরে শেষমেশ তার মা-বাবা তাকে নিয়ে পৌঁছন ডাক্তার নন্দীর চেম্বারে।
তাঁদের বয়ান থেকেই তিনি জানতে পারেন যে রিগ্ধা নাকি খুব ছোটবেলায় একবার পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল, তাই ৬-৭ বছর বয়স থেকে সে মাঝে মধ্যে মাথা ব্যথার কথা বলত। পরীক্ষার আগে, রেসাল্ট বেরোনোর সময়, স্কুলে বকা খেলে কিংবা বাড়িতে মা-বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে এই মাথা ব্যথা বাড়ত, মা খানিক ভালবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে, ব্যথার মলম লাগিয়ে দিলে, মিনিট কুড়ি তিরিশ বাদে ব্যথা কমে যেত। কাজেই তাঁরা সবসময়েই খুব সামলে চলতেন মেয়ের ব্যাপারে, পাছে কোনও কারণে তার মাথা ব্যথা শুরু না হয়ে যায়!
এইভাবে চলতে চলতে, ১৪-১৫ বছর বয়সে, ঠিক পরীক্ষার আগে তার মৃগীর মতন খিঁচুনি শুরু হয়। তখনই ডাক্তার মধুবন্তী বসুর কাছে যান তাঁরা। পরীক্ষা নিরীক্ষায় কিছু না পাওয়া গেলেও বার বার খিঁচুনি হওয়ার কারণে এপিলেপ্সির ওষুধ শুরু করা হয়। তাতে অল্প কমলেও, খিঁচুনি মাঝে মধ্যে চলতেই থাকে। বিভিন্ন ওষুধ কমিয়ে বাড়িয়েও খুব কিছু ফারাক হয়না। তখন বেশ কয়েকবার তাঁদের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে বলা হলেও তাঁরা তখন গা করেননি এই ভেবে যে “এতোটুকু মেয়ে, তার আবার কি মানসিক রোগ হবে!”
১৭ বছর পেরোতে পেরোতে রিগ্ধার খিঁচুনি বেশ কমে আসলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাস খানেক আগে থেকে অন্য একরকম অসুবিধে শুরু হয়। হঠাৎ হঠাৎ সে একদম থম মেরে যায়- তখন তাকে ডাকলে সাড়াও দেয়না, চোখ ও খোলে না, মুখ দিয়ে উঁ উঁ শব্দ করে কিন্তু আশপাশের পরিস্থিতির যেন তার কোন হুঁশ থাকে না। এরকম ১০-২০ মিনিট চলে- মা বাবা হয়রান হয়ে হাত পা মালিশ করেন, মুখে চামচ দেন, মাথায় হাত বুলিয়ে ভগবানের নাম নেন- তারপর নিজের থেকেই মেয়ের হুঁশ ফিরে আসে- কিন্তু তারপর কি যে হয়েছিল কিছুই মনে করতে পারে না সে। আবারও ডাক্তার বসুর তত্ত্বাবধানে সব পরীক্ষা করা হয়। রোগের লক্ষণ খুঁটিয়ে শুনে আর পরীক্ষার রিপোর্ট একেবারে ঠিক আসায় তিনি আবার তাঁদের বলেন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে। কিন্তু মানসিক রোগ বলে মানতে নারাজ রিগ্ধার বাবা-মা কিছু আত্মীয়ের পরামর্শে তাকে বরং নিয়ে যান কিছু মন্দিরে- মসজিদে, ‘উপরির অভিশাপ’ কাটাতে।
আবারও সেই ঝাড়ফুঁকের পর কয়েক মাস ভালো থাকলেও গন্ডগোল বাড়ে কলেজ ভর্তির সময় থেকে। সে বি এস সি পড়তে ইচ্ছুক হলেও উচ্চমাধ্যমিকের নম্বর মনোমতো না হওয়ায় আর্টস নিয়েই ভর্তি হতে হয় কাছাকাছির মধ্যে একটি কলেজে। এদিকে স্কুলের যে ২-৩ জন কাছের বান্ধবী ছিল তারা সকলেই বি এস সি নিয়ে ভর্তি হয়ে যায় অন্যান্য তথাকথিত ‘বড় বড়’ কলেজে। মায়ের কাছে তারপর থেকেই নিজের নম্বর, কলেজ ও কোর্স নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হীনমন্যতার কথা বলতে থাকে রিগ্ধা। মা অনেকভাবে তাকে খুশি করার চেষ্টা করেন, বোঝান এসব কিছুই কিছু না। কিন্তু কলেজের প্রথম দিনেই ক্লাসের মধ্যে খিঁচুনি হয় রিগ্ধার। তাড়াতাড়ি মা-বাবাকে ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন তাকে তার শিক্ষকেরা। তারপর দিন থেকে খিঁচুনি চলতে থাকে প্রতিদিন। তার সাথে সাথে ওই থম মেরে যাওয়া, হঠাৎ করে স্মৃতিভ্রংশও শুরু হয়ে যায়। সবথেকে অদ্ভুতভাবে এইবার রিগ্ধার ওপর ‘ভুত’ ভর করতে থাকে সপ্তাহে দুতিনবার- সে থম মেরে থাকতে থাকতে চেঁচিয়ে ওঠে অন্য এক কণ্ঠস্বরে- করে অশ্রাব্য গালিগালাজ- ছুটে যায় এদিকওদিক- চিনতে পারে না নিজের মা বাবা কাউকে! থামাতে গেলে বলে ‘আমি রিগ্ধা নই- রিগ্ধা মরে গেছে- ওর শ্রাদ্ধ করে দিও’– মাঝে মাঝে হিন্দি-ইংরেজি-মায় ভোজপুরিতেও কথা বলে সে সেই সময়গুলোয়!
কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি, তার সামনে কেউ ভয়ে পড়াশোনার কথাই তোলে না। চিন্তায় দিশেহারা হয়ে তাকে নিয়ে মা-বাবা আবারও ছোটেন মন্দিরে-দরগায়, ভুত ছাড়াতে। এভাবেই এখান সেখান ঘুরতে ঘুরতে কেটে যায় মাস দুয়েক- পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকায় আর কিছু করার না পেয়ে তাঁরা শরণাপন্ন হন ডাক্তার বসুর, যিনি তৎক্ষণাৎ তাঁদের পাঠান ডাক্তার নন্দীর চেম্বারে।
আর কোথাও কোনও ফল না পেয়ে হতাশ হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করতেই তাঁরা পৌঁছন সাইকিট্রিস্টের কাছে।
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে মোড় ঘোরে এই গল্পের।
নাজেহাল মা-বাবাকে শান্ত করে, রিগ্ধাকে আলাপ-পরিচয়ের মাধ্যমে সহজ করে তুলে, নানান কথায় কথায় পরিবারের হালচাল বুঝে যখন ডাক্তার নন্দী নিজে ঠিক বুঝতে পারেন যে রিগ্ধার শুরুর থেকে সব লক্ষণই একটি মানসিক রোগ ‘ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার’-এর কারণেই হচ্ছিল, তখন থেকে শুরু হয় ধাপে ধাপে চিকিৎসা।
তিনি রিগ্ধা এবং মা-বাবাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝান যে ঠিক যেমন হঠাৎ গাড়ির হেডলাইট দেখলে বনের হরিণ স্তম্ভিত হয়ে থমকে যায়- পালানো উচিৎ জেনেও দৌড়তে পারেনা- ঠিক সেইরকমই ‘স্ট্রেস’ অথবা চিন্তা-উত্তেজনা-চাপে মানুষেরও এইরকম হতে পারে। তখন আমাদের যত মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ ভাবে কাজ না করতে পেরে খেই হারিয়ে ফেলে আর আমরা পুরোপুরি অচেতন না হলেও চেতন-অবচেতনের এক মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে যাই- যাকে বলে ‘ট্রান্স’। ডাক্তারি বুলিতে মস্তিষ্কের এই খেই হারিয়ে ফেলাকেই বলে ‘ডিসোসিয়েশান’। এই খেই হারানোর ফলে মৃগীর মতো খিঁচুনি, স্মৃতিভ্রংশ, প্যারালিসিস, কথা-বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এধরণের ‘ভূতে ধরা’ সবই হতে পারে।
দুঃখের বিষয় এই যে, শুধু ওষুধ দিয়ে, কিংবা একেকটা লক্ষণের চিকিৎসা করে এই রোগে তেমন কোনও উন্নতি হয় না। বরং কেন রোগী বারবার এইরকম খেই হারাচ্ছে সেটা বুঝে, তার ভিতরকার মানসিক কারণগুলো ঠিক করতে পারলে তবেই এই রোগের সুরাহা হয়। তার জন্য বেশ অনেক সময় ধরে রোগীর সাথে কথাবার্তা বলা, তার মনের গভীরে চলা দ্বন্দ্ব- দোটানাগুলো মেটানো আর দরকার মনে হলে অল্প কিছু ওষুধ দিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগকে শান্ত রাখাই এই অসুখের মূল চিকিৎসা। সেইসবের সাথে দরকার লাগে পরিবারের সহযোগিতা- রোগীকে এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত মনোযোগ না দেওয়া, এই খেই হারানোতে ভয় না পেয়ে সেটাকে একটা স্বাভাবিক উদ্বিগ্ন হওয়ার লক্ষণ হিসেবে বুঝে উদ্বেগ কম করা এবং রোগীকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে শক্ত করে তোলাতে পরিবারের বিশেষ ভুমিকা আছে।
রিগ্ধার চিকিৎসা চলছে। তার মা-বাবা বুঝতে পেরেছেন যে ছোটবেলার মাথার চোটের কারণে মেয়ের এমন অসুখ হয়নি। তারাও চেষ্টা করছেন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী নিজেদের ব্যবহার বদলাতে। খিঁচুনি, ভূতে ধরা, মাথাব্যথা ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও এই কয়েকমাসেই বেশ খানিকটা কমেছে। বেড়েছে রিগ্ধার আত্মবিশ্বাস। সে চায় লকডাউন খুললে আবার কলেজ যেতে- নিশ্চই এবার আর সে খেই হারিয়ে ফেলবে না!