অর্বাচীন দু’টি নিরীহ প্রশ্ন করি।
ক্যাসিয়াস ক্লে আর সিস্টার নিবেদিতার মধ্যে মিল কোথায়? কোথায়ই বা মিলে গেছেন আমাদের মধুকবি আর অম্বরীশ দাস?
প্রথমে ক্যাসিয়াস ক্লের নামটাই বিবেচনা করা যাক।
আফ্রিকার মাটি থেকে উপড়ে আনা তাঁর কালো রঙের পূর্বপুরুষ খ্রিস্টান ছিলেন না নিঃসন্দেহে। নামও নিশ্চয়ই আফ্রিকার কোনও নাম ছিল। দাস-জীবনে তাঁদের সেই আগের নাম পালটে গেল। কেন না তাঁরা মালিকের ধর্মে দীক্ষিত হলেন। মালিকদের মত খ্রিস্টান নামের মালিক হলেন। অর্থাৎ ধর্ম পালটানোর সাথে নাম পালটানো হল। এই প্রথাটাই আসলে সাম্রাজ্যবাদের চিহ্ন। নাম পাল্টাবে… সংস্কৃতি পাল্টাবে। মানুষকে তাঁবে রাখতে সাম্রাজ্যবাদ যুগে যুগে এ’টি করেছে। সেই খ্রিস্টান ক্যাসিয়াস ক্লে যখন ব্যক্তিগত কারণে (ধরে নিই ভক্তিরই কারণে) মুসলমান হলেন সেই সাম্রাজ্যবাদী প্রথার কারণে তিনি হলেন আরবি নামের মহম্মদ আলি। আরব থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে তবু ধর্মের দোহাই দিয়ে আরবি নাম।
অথচ কী আশ্চর্য দেড় হাজার বছর আগে যখন হজরত মহম্মদ কিম্বা তাঁর অনুসারী পুরুষ মহিলারা মুসলমান হলেন, যাঁদের নিয়ে ইসলামের যাত্রা শুরু হল, তাঁরা নিজেরা কিন্তু নিজেদের নাম ধর্মের দোহাই দিয়ে আদৌ পাল্টাননি। দরকারই হয়নি। কারণ তাঁদের প্রত্যেকেরই ছিল আরবি নাম। আর ইসলাম ধর্মটা যেহেতু ছদ্মবেশের আড়ালে আরব সাম্রাজ্যবাদ কাজেই তাঁদের নাম পাল্টানোর দরকারই পড়েনি।
কিন্তু অন্যরা যে কেউ ইসলাম ধর্মে নতুন করে আসবেন তাদেরকে আরবি নাম নিতেই হবে নিজের নাম ছেড়ে।
ঠিক যে রকম মার্গারেট যখন খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে (ছেড়েছিলেন কি?) হিন্দু সন্ন্যাসিনী হলেন তাঁর নাম সিস্টার মার্গারেট রাখা যাবে না। তাঁকে নিবেদিতা হতে হবে। কিছু বাদে অন্য এক অ্যাগ্নেস কিন্তু খ্রিস্টানই থেকে গেলেন বলে সন্ন্যাসিনী টেরেসা হবেন। যদিও তাঁর সন্ন্যাস জীবন শুরু হবে এই বাংলাতেই। তখন তিনি নিজেও এ’দেশেই কাজ করবেন বলে বাংলাভাষা শিখেছেন যত্ন করে। তাঁকে এখানের কোনও নাম দেওয়া হবে না।
আর বাঙালি মধুসূদনকে খ্রিশ্চান হবার লোভে নামের ডগায় বসাতে হয় মাইকেল শব্দটি। অর্থাৎ নামের নিয়মের আড়ালে ধর্মের ছদ্মবেশে এক ধরণের সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী কায়দা।
এই প্রথা এমনকি আপাত নিরীহ কৃষ্ণভক্তদের মাঝেও। নইলে কেনই বা কর্পোরেট টাইকুন আলফ্রেড ফোর্ডকে ইসকন দখলে রাখার জন্য বৈষ্ণব ঘরানার অম্বরীশ দাস সাজতে হয়?
আর একটি প্রাসঙ্গিক এই রকম আচরণ দেখি তথাকথিত কিছু যুক্তিবাদীর মধ্যেও। বন্ধু বা সাথীকে কমরেড বলে ডাকার মধ্যে এই জাতীয় একটি আধিপত্যবাদী আর অনুসরণকারী কট্টর মনোভাবই কাজ করে। কী, না অন্য কোনওখানে এই ডাকাটা ছিল দস্তুর। তাই এ’খানেও কমরেড বলতে হবে। বন্ধু বা সাথী না। এই কমরেডের উল্লেখটা বোধহয় গোমাংস বা হারাম ভক্ষণের মত অপরাধ হয়ে গেল। বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চাইছি।
অবশ্য এই আধিপত্যবাদ, অন্য ক্ষেত্রেও কিছু বিরল নয়। তার প্রেরণাতেই ঠাকুরবাড়ির একতলা থেকে দোতলায় উঠবার সময় ভবতারিণীর নাম হয়ে যায় মৃণালিনী।
এ’দেশীয় মুসলিমদের প্রায় শতকরা একশ’ ভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত, মানে কনভার্টেড। তাদের প্রত্যেককেই মুসলমান হবার পর পুরোনো নাম ছেড়ে আরবি নাম নিতে হয়েছে সে’ কালে। শিখতে হয়েছে আরবি কায়দাকানুন।
যাতে মূল শেকড়টি উপড়ে যায়। যাতে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। আর তার তাড়নাতে আজও ভোট ভিখারিকে তথাকথিত ইসলামি কায়দায় মাথায় চাদর জড়িয়ে দু’হাতের তালু সামনে মেলে নিখুঁত ইসলামি অভিনয়ের ছবি তুলে ফ্লেক্সে ফ্লেক্সে টাঙাতে হয়। মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ যদিও।
এখন অবধিও সেই ধারাই চলছে। বিখ্যাতদের মধ্যে ইসলাম অনুসারী হয়ে নাম পাল্টেছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করা যায়, প্রয়াত পতৌদির নবাবের স্ত্রী, এ আর রহমান বা গায়ক সুমনের কথা।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন ইত্যাদি ধর্মের আধিপত্যবাদ আপাতত ম্রিয়মান। দুনিয়াজোড়া ইসলাম ধর্মের নামে আরব সাম্রাজ্যবাদ মানে দার-উল-ইসলাম ধারণাটি নানা কুযুক্তি ও অযুক্তির পথ বেয়ে টিঁকে রয়েছে।
আদতে ধর্ম ব্যাপারটাই অবলুপ্ত না হলে নানান কিসিমের এই আধিপত্যবাদের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই।
সর্ব-ধর্ম-সমন্বয় নয়, চাই সর্ব ধর্ম বিলুপ্তি।