ডাক্তারবাবু কোর্টে গিয়েছেন। এমন দু়ঃসংবাদ মাঝে মাঝে শুনতে হয়, জেলা মহকুমা বা ষ্টেট জেনারেল হাসপাতালে দেখাতে আসা অসহায় মানুষগুলিকে।
অসহায় কেন বললাম? আজকাল শহুরে ভদ্রলোকরা একটা নতুন ফ্যাসান চালু করেছেন। এনারা সরকারী হাসপাতালে আসা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরীব মানুষদের ঠিক ভদ্রলোক ভাবতেই পারেন না। একজন বিদেশ ফেরৎ বিদুষী যখন বলেন, “আজকাল তো সরকারী হাসপাতালে ভদ্রলোকেরা যায় না”, তখন মনে দু়ঃখের থেকে রাগ বেশী হয়।
কদিন আগে এমনই এক সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগের একটা ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ চালাচালি হল। কয়েকশ লোক হাতে একটা করে দু টাকার টিকিট নিয়ে একটা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল। ধাক্কাধাক্কিতে কাঁচের দরজা ভেঙ্গেছিল। একজন জুনিয়ার ডাক্তার পদপিষ্ট হওয়ার ভয়ে চেয়ারটা দেওয়ালের দিকে সরিয়ে নিয়ে তাতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এই ভিডিও দেখে কয়েকজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু জানিয়েছেন, এ ওদের দৈনন্দিন কাজের ধারা।
আমি নিজে, বছর দশেক আগেই, একটি ষ্টেট জেনারেল হাসপাতালে চোখের বহির্বিভাগে সপ্তাহে তিনদিন রুগী দেখতাম। ওসব হাসপাতালে সাধারণত চোখ, নাক কান গলা, চর্মরোগ, সার্জারী এসব বিভাগে একজনই ডাক্তারের পদ থাকে। আমি যে তিনদিন বহির্বিভাগে রুগী দেখতাম, প্রতিদিনই প্রায় চল্লিশজন লোক ঐটুকু ঘরে ঢুকে পড়লে, তখন আর রুগী দেখা সম্ভব হত না, টর্চ হাতে বাইরে বেরিয়ে আসতাম। ভেতরের লোকগুলি বাইরে না বেরনো পর্যন্ত দরজার বাইরে দাঁড়ানো রুগীদের দেখতে শুরু করতাম। বাইরেও তখনো হয়তো একশজন মত লোকের লাইন। ভেতরের লোকগুলি একটু একটু করে বাইরে বেরলে,আবার ভেতরে গিয়ে বসতাম। এক একদিন দু বারও এভাবে উঠে আসতে হত। পরের দিনগুলিতে পাঁচ সাতজন করে ভর্তি রুগীর অপারেশন করতাম। আমি চলে আসার দিনও বোধহয় জনা তিরিশ লোকের নাম লেখা ছিল, অপারেশনের প্রতীক্ষা তালিকায়।
দশ বছরে, এ রাজ্যের প্রায় সব হাসপাতালেই রুগীর চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। এবার যদি ঐরকম একটি বহির্বিভাগের দিনে, ঐরকম শ দুই লোক হাসপাতালে এসে শোনে, আজ চোখের ডাক্তারবাবু বসবে না; ওদের রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর যদি দু মাস আগে তালিকায় নাম লেখানো পাঁচজন এসে শোনে, আজ ভর্তি হবে না, কাল ডাক্তারবাবু কোর্টে সাক্ষী দিতে যাবেন, গালাগালটা কাকে করে?
ডাক্তারের ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা, জ্বর পেট খারাপ বাদ দিলেও, আরও নানান সরকারী কাজেই, মাঝে মধ্যে এক আধদিন বহির্বিভাগে না বসে হয়তো কোন চক্ষু অপারেশন শিবিরে চলে যেতাম। সেদিনের রুগীদের অর্ধেক লোক পরদিন আসতো। জেলাস্তরের বা মহকুমা হাসপাতালের ক্ষেত্রে হয়তো দুজন করে বিশেষজ্ঞ থাকেন। সেক্ষেত্রে একজন যেদিন বহির্বিভাগে বসেন, অন্যজন সেদিন অপারেশন করেন। এছাড়া এসব দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতালের সব ডাক্তারবাবুকেই নাইট ডিউটি করতে হয়। যেদিন নাইট করলেন, পরদিন বাড়ী ফিরতেই হয়তো নটা দশটা বেজে যায়। আমিতো একদিন নাইট করলে পরদিন সন্ধ্যে পর্যন্তই একটা ঘোরের ভেতর থাকতাম। তাও অনেকদিন, হাসপাতালের ভেতরের কোয়ার্টারে গিয়ে সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আবার অপারেশন করতে ঢুকতাম।
এছাড়া আর একটি বিরক্তিকর কাজও হয়তো মাসে একদিন করতে হত। এটি হল পোষ্টমর্টেম করা। এই শেষ কাজটিই সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর পর ডাক্তারবাবুদের কোর্টে যেতে বাধ্য করে।
এছাড়া আরও কত তুচ্ছ কারণে, একজন ডাক্তারবাবুকে হাসপাতালের কাজ ফেলে কোর্টে গিয়ে বসে থাকতে হয়, জানলে অবাক হবেন।
আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কয়েক বছর চাকরি করেছি। হয়তো কারও ছাগল পাশের বাড়ীর সব্জির বাগানে ঢুকেছিল ; তাই নিয়ে দুই বাড়ীর ঝগড়া। কারো হয়তো কপালে একটা কঞ্চির বাড়ী লেগেছিল। ব্যাস, হাসপাতাল অর্থাৎ গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু দলই দৌড়ে এল। প্রায়ই কোন বাড়ীর একজন হয়তো দৌড়ে পার্টি অফিসে গিয়ে, নেতাকে দিয়ে ফোন করাল। “ডাক্তারবাবু, আমাদের পার্টির লোক, ভালো করে রিপোর্ট লিখে দেবেন।” বেশ বোঝা যায়, এরকমের ফোন থানাতেও যায়।
ঐসময় তো চারপাঁচজন লোকের সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা করা হল। কিন্তু কপালে একটু কালশিটে পড়া লোকটিকে তখনই “ইনজুরী রিপোর্ট” নামক মহার্ঘ কাগজটি তৈরী করে দিতে হবে। এমন কি লোকাল পার্টি আপিস থেকে দু একজন চ্যাংড়া আনি দু- আনি নেতাও এসে হাজির হতে পারে। তখন বহির্বিভাগে দুশো লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক, কিংবা ভেতরের ডেলিভারি রুম থেকে কোন প্রসূতি মায়ের আর্ত চিৎকার ভেসেই আসুক; এদের রিপোর্ট তৈরীটাই তখন সবথেকে জরুরী কাজ। এক ঘন্টা পরে এসে নিয়ে যাবেন, বললে হয়তো দু চার ঘা বসিয়েও দিতে পারে। ঐ কপালের সামান্য কালশিটেই যে ডাক্তারের কপালে কি লিখে গেল, স্বয়ং চিত্রগুপ্তও বোধহয় জানেন না।
এই রকম এক কপালে কালশিটে আমার কপালে কি লিখেছিল, সে কথাই আপনাদের জানাই। উত্তরবঙ্গের ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরে জেলা হাসপাতাল, তারপর দক্ষিণবঙ্গের এক মহকুমা হাসপাতালের পর এক স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, সেখান থেকে কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে এসে চাকরি করছি। ঐ কপালের লিখনের সময় আমার মেয়ে একটা কে জি স্কুলে পড়ত। সেই মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। ঘোর গ্রীষ্মকালে, আর দু চারজন বাবা মায়ের মত আমিও গাছের ছায়ায় বসেছিলাম, পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে। হেনকালে, আমার সেই পুরনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বর্তমান ডাক্তারবাবু ভাইটির ফোন এল। কোনরকম ভণিতা না করে ভাইটি যা জানাল, একেবারে, কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো! তখনও মেয়ের গোটাদুই পরীক্ষা বাকি। পাশে বসা স্ত্রীকে জানালাম, কালই রায়গঞ্জের ট্রেন ধরতে হবে। মানে? স্ত্রী তো আকাশ থেকে পড়ল। সংবাদটি ওকে খোলসা করা হল।
তো, আপনাদেরও জানাই। ঐ বছর আট দশেক আগের কোন মারপিট রুগীর জন্য কোর্টের নিমন্ত্রণ! আমরা নিমন্ত্রণপত্রই বলি। কোর্টের ঐ কাগজটিকে “সামন” বলে। সে তো হল; কিন্তু কি এমন জরুরি মামলা যে, মেয়ের পরীক্ষার মধ্যেই ছুটতে হবে? ভুক্তভোগীরা সবাই জানেন। ঐ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মহোদয়ের আপিস। সেখান থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলা আপিস। তারও পর বর্তমান হাসপাতালের আপিস। এই লম্বা সফরের ফেরে, আমার ঐ মহার্ঘ নিমন্ত্রণ পত্রটি, আমার হাতে পৌছনোর আগেই বার তিনেক পথভ্রষ্ট হয়েছে।
আইনের চোখে আমি অপরাধী। আমার জন্য মহামান্য আদালতের বিচার প্রক্রিয়া বারবার ব্যাহত হয়েছে। অতএব! এবারও না পৌছলে, রাজ পেয়াদা আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে, এমনই ফরমান জারী হয়েছে। থানা থেকে সৌজন্যমূলক একটি ফোন করে, আমার ঐ ডাক্তার ভাইটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিমন্ত্রণ পত্রগুলি কার বদান্যতায় বাববার পথ হারিয়েছে, সেসব বোঝার দায় বা দায়িত্ব আদালতের নয়।
তখনও আজকের মত বাড়ী বসে বা মোবাইলে ট্রেনের টিকিট কাটার ব্যবস্থা চালু হয়নি; বা আমি জানতাম না। সৌভাগ্যক্রমে লাইনে দাঁড়িয়ে, যাওয়া আসার টিকিট কেটে ফেললাম। সন্ধ্যের ট্রেনে চেপে পরদিন সকালে রায়গঞ্জে পৌছে, সোজাই কোর্টের চত্তরে গেলাম। সরকারী আইনজীবী আমাকে আঙুল তুলে একটা কোর্টের ঘর দেখিয়ে দিলেন। ওখানে গিয়ে বেঞ্চে বসে রইলাম। একাই। বোকার মত। এক সময় দেখলাম জজসাহেবের পাশে, নিচে একজন এসে বসে চুপচাপ কাগজপত্র গোছাচ্ছেন। ওনাকে বোধহয় পেশকার বলা হয়। চুপচাপ বসে না থেকে, আমিও আমার ব্রিফকেশ খুলে, সন্ধ্যের ফেরার টিকিটটা ঠিকমত আছে কিনা, বা ওরকম কোন কাজে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।
পেশকার বাবু কাকে যেন কি একটা বললেন। বাক্স বন্ধ করে ওপরে মুখ তোলার সময় পাইনি; দেখি জজসাহেব চেয়ারে বসেই আমাকে একেবারে পেড়ে ফেলার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন।
তখন আমার বছর পয়তাল্লিশ বয়স হবে। তের চোদ্দ বছর সরকারী চাকরী হয়ে গেছে। মুহূর্তে বুঝেছিলাম,একটা ভয়ানক অপরাধ করেছি। হাত জোড় করে বার বার ক্ষমা চাওয়ার পর, জজসাহেব ঠান্ডা হলেন।
অপরাধ কি করেছি? আসলে ঐ যে পেশকার বাবু কী একটা বললেন; ওটাই আমি বুঝিনি। উনি বলেছিলেন, “হুজুর আসছেন!” এটা শুনে উপস্থিত সকলের উঠে দাঁড়িয়ে, জজসাহেবকে সম্মান জানানোই দস্তুর। আমি রাতের ট্রেনে স্লিপার ক্লাশে চড়ে গিয়েছি, শরীর ক্লান্ত ছিল। ঐ টিকিট খোঁজা বা কোন কারণে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। ওদিকে জজসাহেবের এজলাসে একটা লোক বসে বসে বাক্স গোছাচ্ছে দেখেই, সাহেবের মেজাজ চড়ে গেছে।
এরপর একে একে উকিলবাবুরা পদার্পণ করলেন। আদালতের কাজ শুরু হল। সে গল্প আর একদিন বলব।