আমার লেখার প্রতি একটা পরিচিত অভিযোগ থাকে- বড্ড একঘেয়ে। সেই একই রোগী, একই হাসপাতাল, একই চিকিৎসা আর চিকিৎসকের রোজনামচা। বলাই বাহুল্য, এ অভিযোগ একশোভাগ সত্যি। ব্যক্তিগত জীবনেও আমি মানুষটা নিতান্ত বোরিং। প্যাশন বলতে যা বোঝায় তাতে ডাক্তারিটাই প্রথম, ডাক্তারিটাই শেষ। তাই, এর বাইরে কিছু ভেবে বা বলে ফেলা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অগত্যা.. সেই চর্বিতচর্বণ।
**
– ইবারে একটু ভাল কর্যা দ্যাখঅ না ডাক্তারবাবু..
সকালবেলায় এরকম কথা শুনলে মেজাজটা বিগড়ে যাওয়ারই কথা।
– কেন? আগের বার কি খারাপ করে দেখা হয়েছিল নাকি?
– না গো ডাক্তারবাবু, ইরকম বলব কেন? তমরা ভাল কর্যা দও বল্যা ত বারবার ঘুর্যা ঘুর্যা আসি।
– তাহলে?
– কী আর বলব বাবু.. সব মোদের কপালের দোষ..
– যাঃ! আবার আমাকে ছেড়ে কপালকে ধরলে কেন? কী হয়েছে বলো..
– তমরা ত তিনদিন ভাল দেখ্যা ছাড়ল। ঘরেও আরঅ তিনদিন ভাল ছিল। তারপরে আবার কী খিঁচনি বাবু! বাচ্চাটাকে মোর ঘরে রাখতে পারিনি..
– দ্যাখো মা, তোমাকে আগেই বলেছিলাম- তোমার বাচ্চার রোগটাই এরকম। ওর কোন ওষুধের কত মাত্রায় গিয়ে খিঁচুনি ঠিক হবে সেটা কেউ জানে না। আমাদের ধীরে ধীরে ওষুধ দিয়ে দিয়ে দেখতে হবে। ওই ধরো, সিঁড়ির ধাপের মতো। আবার এমনও হতে পারে হয়তো খিঁচুনি কোনোদিনই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বলা খুব মুশকিল..
– ওউ জন্য ত বললি বাবু, মোর কপালের দোষ। চার ঘন্টার রাস্তা। গাড়িভাড়া ছাব্বিশ’শ টাকা লেয়। অর বাবা বাইরে খাটাখাটনির কাজ করত। এখন করনার জন্য সব বন্দ। জায়গা-জমি নাই। কী কর্যা সংসার চালাই আর বাচ্চাকে দেখি বলত?
উত্তর নেই। উত্তর থাকে না। আমি মুখ নিচু করে পালাই..
**
– কী গো.. আবার ঘুরে এলে যে?
– তমরা বলে দিলে ওই হাসপাতালে অপ্রেশন হবে। উখানে গেলি, গিয়্যা দেখি বেড নাই। কবে পাবা যাবে বলতে পারল নি। মোর বাচ্চাটার কী হবে বাবু?
– হুঁ.. ওখানে তো অনেক চাপ.. সবাই এসব রোগে ওখানেই রেফার করে। এছাড়া তো আর সরকারি জায়গা সেরকম নেই..
– তমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করে দাও না গো.. মোরা আর কথাও যেতে পারব নি। রাস্তাঘাট চিনি নি। কত খুঁজ্যা খুঁজ্যা গিয়্যা তবু ভত্তি করতে পারলি নি..
আমি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকি। অকারণে পেনের ছিপিটা বার কয়েক খুলে-লাগিয়ে নিই। এসবের কোনও চটজলদি সমাধান হয়না। বেশ জানি, ওই হাসপাতালেও রোগী উপচে পড়ছে। বাইরেও অপেক্ষার লম্বা লাইন। এদিকে বাচ্চাটার অপারেশনটা হওয়া দরকার। এই পরিবারের পক্ষে খরচ করে বাইরে অপারেশন করা অসম্ভব। আমাকে আবার পালানোর রাস্তা ধরতে হয়। ‘রিগ্রেট, নো বেড ভ্যাকেন্ট’ লেখা কাগজ বিদ্রুপের হাসি হাসতে থাকে..
আমি বারবার এসব প্রশ্ন এড়াতে পালিয়ে বেড়াই। প্রশ্নের তীক্ষ্ণ আওয়াজ আমাকে ধাওয়া করে। দু’হাতে কান চাপা দিই তবু প্রশ্ন ছাড়িয়ে বেরোতে পারি না। তাই আমার লেখায় একই কথা, একই অনুষঙ্গ।
**
পরপর দু’দিন চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটির ক্লান্তিতে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। বাঙালির সম্ভবত শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্র চলে গেলেন। দুঃখ করার সময়টুকুও পাইনি। দিন কেটেছে অবসন্ন, রাত কেটেছে নির্ঘুম। আজ সন্ধ্যেয় এসে ভাবনার ফুরসৎ মিলেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে সম্ভবত বাঙালির আভিজাত্যের দিন শেষ হয়ে গেল। না, ‘আভিজাত্য’ মানে অর্থগরিমা নয়। বাঙালির মননের আভিজাত্য, জ্ঞানের আভিজাত্য, সংবেদনশীলতার আভিজাত্য। যে বাঙালি ঘেমো জামাটা ছুঁড়ে ফেলে বাঁশিতে সুর তুলতে পারে। যে বাঙালি পকেটের গান্ধীছাপ কাগজের থেকে ভেতরের প্রতিভাকে বেশি দাম দেয়। যে বাঙালি উন্মুক্ত সবুজে দু’কলি রবীন্দ্রনাথ মেশায়। নক্ষত্র নিভে যাওয়ার পর বাকি পড়ে রইল মধ্যমেধার দাপট আর পানসে হেঁটে যাওয়া.. উদ্দেশ্যহীন..
**
শহুরে আলোর বৃত্তের বাইরে মানোয়ারা বিবি আর সুনীল মান্নাদের পৃথিবী আছে। অন্ধকারের পৃথিবী। তাদের প্রশ্ন আছে, অসহায়তা আছে, যন্ত্রণা আছে। শুধু তার শেষ কোথায় তারা জানে না। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই.. একঝাঁক তরুণ-তরুণীর মুখ। গলায় স্টেথোস্কোপ। তারা উত্তর না থাকা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। ছটফট করে। মানোয়ারা-সুনীল সংকোচ ভরা গলায় জানতে চায়..- তোমরা কে?
তারা একচিলতে হেসে বলে– আমরা? আমরা বন্ধু..
তারপর ধুঁকতে থাকা মারীর দেশের উত্তর না মেলা প্রশ্নের বোঝা কাঁধে নিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যায়..
আপনি কি বলতে চাইছেন সেটা বুঝতে পারলে কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। ভালো থাকবেন, লিখবেন।