স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু যে নিধিরাম সর্দার তার একটা গল্প কদিন আগেই বলেছি। আজ ঐ নিধিরাম সর্দারদের আর একটা দিক নিয়ে কিছু বলি। গ্রামের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুদের যে কতো বিচিত্র কাজ করতে হয়, সাধারণ মানুষ কেন, অসাধারণ কিছু কিছু মানুষও তার খবর রাখেন না।
জেলা শহরের হাসপাতাল, এমনকি মহকুমা হাসপাতালেও বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের থাকার কথা। কিন্তু দু’একটা ব্যতিক্রমী জায়গা ছাড়া ব্লকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ থাকেন না। বিশেষ রুগীর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে জেলা বা অন্য বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়। রুগীর বাড়ীর লোকেরা সেটা বুঝতেও পারেন। কিন্তু কয়েকটি আইনি জটিলতার ডাক্তারী পরীক্ষা ঐ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুকেই করতে হয়। আর যেহেতু এই ব্লকের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থানার কাছেই থাকে, পুলিশও ওসব কেস ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই আনে। বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে বোধহয় সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে; সবথেকে কাছের হাসপাতালে যে ডাক্তারবাবুই থাকুন, তাঁকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতেই হবে।
এমন এক দুটি কেস দু চার মাসে এসেই পড়ে। সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তারী পড়ার সময় ধর্ষণ নিয়ে কয়েকটা ক্লাশে পড়ানোও হয়। এ এমন একটা বিষয় যেখানে রুগী দেখে শেখার সুযোগ প্রায় নেই। আর ডাক্তারী বইতে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা লেখা আছে, তার মূল কথাটাই হল, “অনিচ্ছা সত্বেও জোর করে যৌন সংসর্গ”। এবার মুশকিল হল , পরীক্ষা করে যৌন মিলন হয়েছে কিনা বলা যায়, কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত না জো্র করে, সেটা বলাটা প্রায় অসম্ভব।
সে গেল একটা দিক। এবার ধর্ষণের শিকার মহিলার বয়স কত ছিল, ঐ দিন, সেটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিকাঠামো দিয়ে বলা যায় না। তার জন্য উচ্চতর হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর আছে, দুজনের সম্মতিতে যৌনমিলনের পর, মহিলা যদি বলেন, ভুল বুঝিয়ে কাজটা করা হয়েছে, সেটা ডাক্তারী পরীক্ষা বা বুদ্ধিতে কি করে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায়, আমার অন্তত জানা নেই।
আজকাল একটা মেডিক্যাল কলেজে কাজ করার সুবাদে এই সব সমস্যায় আর পড়তে হয় না। পুলিশ প্রায়ই এসব কেস নিয়ে আসে। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে সব রকমের বিশেষজ্ঞ থাকেন, তাই তাঁদের কাজটা তাঁরাই করেন। তাছাড়া রিপোর্ট লেখার জন্য নির্দিষ্ট ছাপানো ফর্ম আছে। জানি না এখনও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওসব ছাপানো ফর্ম এসেছে কি না। একই বিচারকের কাছে আজ একটা সুন্দর ছাপানো ফর্মে, একজন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক বা বিশেষজ্ঞ-এর লেখা রিপোর্ট নিয়ে বিচার হল। কালই যদি একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাদা কাগজে লেখা একটা রিপোর্ট নিয়ে একজন মেডিক্যাল অফিসার হাজির হন, বিচারক বিরক্ত হতেই পারেন।
এবার এক নিধিরাম সর্দার-এর অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাত দশটার পর পুলিশ একটি ছেলের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এল। একই গাড়িতে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকেও। আমাদের সেই স্পেশাল এক্সামিনেশন রুম, মানে ডেলিভারীর ঘরে মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন সিস্টার। সিস্টারের কাছে , আমি যাওয়ার আগেই মেয়েটি বলেছে যে, যৌনমিলন হয়েছে। পুলিশের অনুরোধে, আমাদের একটা জীবাণুমক্ত ইনজেকশনের ভায়ালে, ভেজাইনাল সোয়াব নিয়ে, লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে বন্ধ করে, পুলিশকেই দিলাম। ঐ মহার্ঘ বস্তুটি ওনারা কোথায় পাঠাবেন, বা কি করলেন সে সব নিয়ে কোন চিন্তা মাথায়ই আসেনি। আজকাল ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে একটা করে ল্যাবরেটরি হয়েছে, তখন ওসব আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। অবশ্য এখনও ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে ঐ বিশেষ সোয়াবটি পরীক্ষা করা সম্ভব কিনা আমি জানি না।
মেয়েটির রিপোর্টে তো লেখা হল, যৌনমিলন হয়েছে। কিন্তু ছেলেটিকে নিয়ে কি করতে হবে, আমার অন্তত জানা ছিল না তখন। যতো দূর মনে পড়ছে, ছেলেটি যৌনমিলনে সক্ষম কিনা সেটাই পুলিশ জানতে চেয়েছিল।
এখানেই শুরু হল, ডাক্তারী ছেড়ে গোয়েন্দাগিরি। না, ঠিক বললাম না। কাজটা করতে হয়েছিল, সমাজবিজ্ঞানীর।
ছেলেটির বয়স বাইশ-তেইশ বছর হবে। ওর সামনেই পুলিশের সাথে কথা বলছিলাম। আমরা কি জানতে চাই, ছেলেটি ভালই বুঝেছে। আমার বসার ঘরে ওকে রেখে পুলিশকে একটু বাইরে দাঁড়াতে বললাম। এবার ছেলেটি বলল, “আমাদের মধ্যে এমন যৌনমিলন মাঝে মাঝেই হয়। মেয়েটি নিজেই আমাকে দরজা খুলে গোপনে ঘরে ঢুকিয়ে নেয়। আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা কিছুদিন থেকেই চলছে। আমার শ্বশুর লোকটা ভালো নয়। আমার বাবাকে বলেছে, মেয়ের নামে দু’বিঘা জমি লিখে দিতে হবে। আমার বাবা রাজী না হওয়ায়, আজ আমাকে এভাবে ফাঁসালো।“ এ তো খুবই সহজ অংক। আমার লেখার কথা, ছেলেটি যৌনমিলনে সক্ষম কি না। লিখে দিলাম। আমার কাজ শেষ।
না, এসব কাজ এত সহজে শেষ হয়ে যায় না। কথায় বলে, পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। আমি তো একদিন পূর্ব জন্মের পুণ্য ফলে, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের থেকে জেলা হাসপাতালে উঠে এলাম। তারপর আরও কত নিধিরামসর্দার এসব ঝক্কি সামলে চলেছে।
আমার “ডাক্তারবাবু কোর্টে গিয়েছেন” আর “আদালতে ডাক্তারবাবু” নিবন্ধ দুটিতে একটু আভাস দিয়েছি। ঐ ঘটনার বছর ছয়-সাত পরে, আমার ডাক পড়ল, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার। আমার চোখের আউটডোর একদিন বন্ধ রেখে (শ’খানেক লোকের শাপ শাপান্ত তো ডাক্তার পাবেই), একদিন জনা পাঁচেক রুগীর চোখের অপারেশন বাতিল করে, চললাম চারশো কিলোমিটার দূরের আদালতে সাক্ষী দিতে। নিজের কাজ, নিজের টাকায় রাত জেগে ট্রেনের স্লিপার ক্লাশে যাওয়া, এসব বলতে নেই। সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তোমার ওসব প্যানপ্যানানি বাবার ডোবা পুকুরে ছুঁড়ে দিয়ে আসতে হবে।
নিমন্ত্রণ পত্রে যেমন লেখা থাকে, ঠিক সকাল দশটায় আদালতে হাজির হয়ে, সরকারী উকিল বাবুকে খুঁজে বের করে, এক তাড়া কাগজের ভেতর, ছয় বছর আগে নিজের হাতে লেখা মহার্ঘ কাগজ চোখে দেখে, এটুকু অন্তত বুঝলাম; আমার প্রারব্ধ ফল ভোগ করার জন্য এসেছি। চারশ কি মি রাত জেগে গিয়ে অন্তত শুনে আসতে হবে না, “সেকি, আপনি এ রুগী দেখেন নি?” মারামারি,হাতাহাতি রুগীর মামলায় সাক্ষী দিতে আগে কয়েকবার গেলেও, এরকম, যাকে বলে ” রেপ কেসে” সাক্ষী দিতে কোনদিন যাইনি। আমার কি কাজ করা উচিত ছিল, কি করতে পারিনি, এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি আমাদের পুরাতন সুপার স্যারও কোর্টে এসেছেন। বস্তুত জেলা হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ঐ সুপার স্যার বিগত বছর কুড়ি ধরে এত অসংখ্য শব ব্যবচ্ছেদ করেছেন যে, আমৃত্যু প্রতিদিনই আদালতে আসতে হত ওনাকে। স্যারকে দেখেই কুশল বিনিময় করার পরই জানতে চাইলাম, ঐ “রেপ কেসে” ছেলেটির ক্ষেত্রে আমার কি কি করণীয় ছিল, এবং ইত্যাদি।
ঐদিন তো আমি “লাষ্ট মিনিট সাজেশান” দেওয়ার লোক পেয়ে গেলাম। কিন্তু আজও, এ রাজ্যের কোন না কোন আদালতে, এরকম কোন না কোন নিধিরাম সর্দার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছেন। আমার ঐ প্রত্যন্ত জেলা হাসপাতালেও মাসে তিন –চারটি “বিরিয়ানী সেমিনার” হত। কত বড় বড় অসুখ নিয়ে কত বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা হত। একদিনও কারও মাথায় আসেনি, সুপার স্যারকে বক্তা করে, ওনার বিপুল অভিজ্ঞতার কথা শোনা হোক।
বিরিয়ানী সেমিনারটা কি জিনিস? এই “বিরিয়ানী সেমিনার” নামটি আমি শুনেছিলাম, ভেলোরের একটা কর্মশালা থেকে ফেরার পথে, বাংলা দেশের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, মোহাম্মদ আবুল ফৈজ স্যারের কাছে। আসলে সুপার স্যারের মত বিপুল অভিজ্ঞ মানুষদের সেমিনারে বলতে না বলার কারণটাও কিন্তু ঐ “বিরিয়ানী” নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। অলমতি বিস্তারেন! আমরা সাপের কামড় নিয়ে আয়োজিত বেশ কয়েকটা কর্মশালায়, ডাক্তারী শিক্ষার এই বিশেষ বিষয়ের প্রখ্যাত শিক্ষকদের বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রণ করেছি। তাতে করে ঐসব কর্মশালায় যোগ দেওয়া লোকজন একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝেছি; “সাপের বিষে মৃত্যু আর সাপের কামড়ে মৃত্যু” কথা দুটি এক নয়। এসব নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। আজ শুধু ঐ একটি দিনের কথাই বলি।
আদালতের দর্শকাসনের বেঞ্চে আমি আর সুপার স্যার পাশাপাশি বসে নিচু গলয় কথা বলছিলাম। চোখ ছিল বিচারক আর সাক্ষীর কাঠগড়ার দিকে। বিচারক বেশ বয়স্ক, রাশভারী চেহারার মানুষ। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটি লুঙ্গিপরা লোক দাঁত বের করে ফাজিলের মত কি যেন বলছে। ওখানে দাঁড়িয়ে কেউ ওভাবে দাঁত বের করে কথা বলতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলনা। তাই এবার ওদিকে কান খাড়া করলাম। লোকটি বলল, “কি যে আপনারা বিচার কইরছেন, আর আমাদেরকেই বা শুধুমুধু ডেইকে আইনছেন। ওদের বিয়া হইয়ে গ্যাছে, দুটা বাচ্চা হইছে। আর কি কইরবেন?” ওর পরেই আমাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হল।
আমার ঠিক আগেই ওরকম একটা সাক্ষীকে দেখার পর জজ সাহেবের মেজাজ যে বিগড়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। ডাক্তারের সাক্ষী ব্যাপারটা নিয়ম মেনে, নাম কি? বাবার নাম কি? এখন কোথায় আছেন? ঘটনার তারিখ বলে, ঐ দিন কোথায় কি পদে ছিলেন? এসব দিয়েই শুরু হল। তারপর, কি দেখেছিলেন? একেবারেই মাছিমারা কেরানীর মত, নিজের লেখা রিপোর্ট পড়ে যাওয়া; এই তো কাজ। সেই যে কাঁচের ভায়ালে সোয়াব নেওয়া; সেই কথাটি শুনেই জজ সাহেব জানতে চাইলেন, তারপর ওটা কি করলেন? পুলিশকে দিয়েছি বলতেই, ধমকে উঠলেন! কিন্তু ওটা নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিধিরাম সর্দার মশাইয়ের কি করা উচিত, বা ওটার গন্তব্য কি, এসব নিয়ে কিছু বললেন না।
সেই বছর বাইশ -তেইশ আগে একবারই ঐ দায়িত্বটি পালন করতে হয়েছিল। আর জজ সাহেবের ধমক খাওয়ার পরও ষোল আঠার বছর কেটে গেছে। সেদিন, সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর আর সুপার স্যারের সাথে দেখাও হয় নি। ঐ মহার্ঘ কাঁচের শিশিটি নিয়ে কি করা উচিত, আর জানা হয় নি। আজকের নিধিরাম সর্দারদের কেউ জানেন কি না আমি জানি না।
আমি এই বিষয়ে লিখছি জেনে আমার এক বন্ধু বলেছে, রায় কি হল সেটা জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন। না, রায় কি হল আর জানা হয়নি। কিন্তু আমার মত যে কজন লোক ঐ মামলার সাথে যুক্ত হয়েছি, সকলেই ঐ দিনই জেনে গেলাম, “মিয়া বিবি রাজী”! কিন্তু কাজী কেয়া করেগা? তাতো দেশের আইন মেনেই হবে। ওরকম ডজন ডজন নিধিরাম সর্দার রোজ রোজ আদালতের ধমক খেয়ে আসছে। এদিকে ওদের হাসপাতালে এসে যে শত শত রুগী, গ্রাম গঞ্জের থেকে এসে ডাক্তার নেই শুনে, শাপ শাপান্ত করে ফিরে গেল, তাদের কথাও কেউ কোনদিন ভাবেন নি।
টেকনোলজির এত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। করোনা অতিমারীর সময় এত জরুরী কাজ “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করে করা যাচ্ছে। জাতীয় স্তরের, আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে, কত বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; চারশ পাঁচশ মাইল দূরের হাসপাতালের ডাক্তারদের সাক্ষ্য গ্রহণ কি ভিডিও কনফারেন্সিং করে নেওয়া যায় না? সব বড় হাসপাতালে আর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের আপিসে এখন অনলাইন মিটিং এর ব্যবস্থা আছে। নীতি নির্ধারকরা এবার একটু ভাবুন।