
দিনে দিনে পূর্ণগর্ভা হয়ে উঠছেন মায়া। রাজজ্যোতিষী গণনা করে জানিয়েছেন স্বপ্নের অতি শুভ লক্ষণের কথা – “নবজাতক হবেন এক দিব্যপুরুষ। এই সময়ের সমস্ত প্রচল নিয়মের বেড়া ভেঙে তিনি জগতের মানুষকে নব জীবন দর্শনের মন্ত্রে দীক্ষা দেবেন ।” মায়ার কাছে এই কথাগুলো কেমন যেন হেঁয়ালি বলে মনে হয়। সাংসারিক জীবন তাঁকে সেভাবে আসক্ত করতে পারেনি। তরাইয়ের হরিয়ালি সবসময় তাঁর মনকে ভীষণ ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে। একান্ত মুহূর্তে তিনি ভাবেন, তাঁর অনাগত সন্তান যেন প্রকৃতির নিবিড় ঘন মায়ায় অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে থাকে সারা জীবন। মায়ের এই আকুল প্রার্থনা গর্ভস্থ সন্তানকে কি আলোড়িত করেছিল? সময়ই হয়তো তার উত্তর দিতে পারবে।
আরও কিছুকাল অতিক্রান্ত। মায়া চলেছেন পিতৃগৃহে, দেবদহে। সেকালের এমনটাই দস্তুর , কন্যার প্রথম সন্তান পিতৃগৃহেই ভূমিষ্ঠ হবে। সেই উদ্দেশ্যেই মায়াদেবীর দেবদহ যাত্রা। সঙ্গে চলেছে বিস্তর লোকজন। শিবিকা বাহকেরা আজ অতি সতর্ক। খুব সন্তর্পনে পথ চলছে তারা। অনেকটা পথ,তাই সময়ে সময়ে বাহক বদল হচ্ছে।তবে সকলেই খুব সজাগ। তারা জানে যে রাজমহিষী মায়াদেবী স্বয়ম্ আজ তাদের শিবিকার যাত্রী। তবে তিনি তো একা নন, মহান শাক্য রাজবংশের ভাবী উত্তরপুরুষও যে চলেছেন মায়ের সঙ্গে, মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে।
কপিলাবস্তু থেকে খানিকটা দূরেই লুম্বিনী উদ্যান। মায়া দেবীর অত্যন্ত প্রিয় পছন্দের জায়গা এই প্রমোদ উদ্যানটি। শিবিকার পর্দা ফাঁক করে মাঝেমাঝেই তিনি অপরূপ বনশোভা প্রত্যক্ষ করছেন। কত বিচিত্র বৃক্ষরাজি! শিংশপা, চম্পক, নীপ,ন্যগ্রোধ, অশোক,শাখোটক, শাল্মলী, শাল, বিল্ব… আরও কতো কি! সব বৃক্ষের সাথে তাঁর হয়তো পরিচয় নেই, তবে তাদের নিবিড় সান্নিধ্য নিয়তই অনুভব করেন তিনি। এসব ভাবতে ভাবতে চলেছেন,এমন সময় নিজের শরীরের ভিতরে এক আশ্চর্য দৈব আলোড়ন অনুভব করেন মায়াদেবী। তবে কি শুভক্ষণ সমাগত যার জন্য দীর্ঘ দশমাস কাল সকলে অপেক্ষা করে আছেন? হাতের ইশারায় শিবিকা বাহকদের থামতে বলেন মায়া। ইঙ্গিত পেয়ে বাহকেরা ধীরে ধীরে শিবিকাটিকে মাটিতে নামায়। পিছনের শিবিকাতেই ছিলেন রাজধাত্রী। বরিষ্ঠ মহিলা। দ্রুত পায়ে তিনি উপস্থিত হলেন মহারাণী সকাশে। অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার নজর দিয়েই বুঝতে পারেন মায়াদেবীর প্রসবকাল সমাগত।আর বিলম্ব নয়। সঙ্গের সহচরীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মায়াকে আশ্বস্ত করেন তিনি। এক লোহিত বর্ণের পুষ্পশোভায় শোভিত অশোক বৃক্ষচ্ছায়ায় প্রসব সজ্জা রচনার নির্দেশ দেন ধাত্রীমা। অশোক বৃক্ষকে ঘিরে খুব দ্রুত অন্তরাল নির্মাণ করে সঙ্গের পার্শ্বচরেরা। ধীর পায়ে শিবিকা থেকে অবতরণ করেন মায়াদেবী। সুবিশাল অশোক বৃক্ষের নির্মল বৃক্ষচ্ছায়া এক অনাবিল আনন্দে আপ্লুত করে মায়াদেবীকে। গভীর আবেগে তিনি অশোক বৃক্ষের সুবিশাল গুঁড়িটিকে আলিঙ্গন করেন। ঐ দন্ডায়মান অবস্থাতেই প্রসব করেন এক সুদর্শন দেবশিশু। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হন এক আশ্চর্য মানবক,যার প্রতীক্ষায় সমগ্র কপিলাবস্তুবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। মায়াদেবীর শরীরের দক্ষিণভাগ থেকে স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে আসেন সেই দেবশিশু। আনন্দের শিহরণ জাগে লুম্বিনীর সকল গুল্ম,লতা বৃক্ষ,তরু,মহাদ্রুমরাজির অবয়বে। পরম খুশিতে বন প্রান্তর আমোদিত হয় স্খলিত পত্র,পল্লব,পুষ্প শোভায়। দখিনা পবন বয়ে নিয়ে আসে অপার্থিব খুশির সুবাস। আকাশ থেকে ঝরে পড়া ঝিরঝির বৃষ্টি এসে ধুইয়ে দেয় নবজাতকের দৈব তনুখানি। ক্লান্ত শরীরে, তাঁকে এবং তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে পরম যত্নে ঘিরে থাকা বৃক্ষরাজিকে উদ্দেশ্য করে মায়াদেবী বলেন – “হে বনদেবতা ,হে মঙ্গলময় বৃক্ষ তরু গুল্মরাজি আপনাদের প্রণাম। আপনারা আশীর্বাদ করুন,আমাদের সন্তান যেন উচ্চশির বৃক্ষের মতো মাথা উঁচিয়ে সারা জীবন কাটাতে পারে। তাঁর ছায়ায় যেন জগতের আপামর মানুষ শান্তি স্বস্তি সুখ অনুভব করে।”
গাছেরা নিজেদের শাখা প্রশাখা আন্দোলিত করে সায় দেয় পুত্র গরবে গরবিনী এক মায়ের আকুল প্রার্থনায়। গাছেরা পুষ্প পল্লব ঝরিয়ে বরণ করে নেয় নবজাতককে। মৃদু ক্লান্ত কন্ঠে মায়াদেবী পুত্রের নামকরণ করেন – “আমি আমার পুত্রের নাম রাখলাম সিদ্ধার্থ। ও যেন ওঁর জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।”এই ঘটনার সূত্র ধরেই লুম্বিনী উদ্যান এক ঐতিহাসিক মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে রইলো। আর অশোক বৃক্ষের সঙ্গে জুড়ে গেলো তথাগত বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দর্শন।
মানুষের দৈনন্দিন যাপন ও অন্তর্লীন জীবনবোধের সঙ্গে বৃক্ষ তথা গাছের সম্পর্ক, বিশেষত এই দেশে, সুপ্রাচীন। ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেও এমন সম্পৃক্ততার অজস্র প্রমাণ লক্ষ করা যায়। ভারতীয় মননে বৃক্ষ আদৃত হয়েছে শক্তি ও পরাক্রমের অনন্য প্রতীক হিসেবে। ধরিত্রীর বুকে হেঁটে চলে বেড়ানো অন্যান্য জীবনের
তুলনায় ধরিত্রী পৃষ্ঠে গাছের আস্থান ভঙ্গিমা সততই অনবদ্য। বসুন্ধরার নমনীয় মৃৎ আবরণীর ওপর সটান ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে গাছেরা। আর এভাবেই একটি গাছের মাধ্যমে ধরিত্রী গর্ভ, ধরিত্রী পৃষ্ঠ ও ঊর্দ্ধ নভোমন্ডলের মধ্যে এক অতুলনীয় সংযোগ স্থাপিত হয়। যে সংযোগ এক ঐশী সম্পর্কের আধার হিসেবে মান্যতা পেয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্যও যে তেমনই – জড় জাগতিক জীবনের মোহ মায়াকে হেলায় তুচ্ছ করে মন ও কর্মকে ঊর্দ্ধে বিকশিত করা । তাই মায়াদেবী যখন পুত্রের ভাবী জীবনকে আভাসিত করেন মনের একান্তে, তখনই বুঝি সন্তানের আগামীর কর্মজীবনের ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মায়ের আকুল আকুতি তথাগত বুদ্ধের জীবনপঞ্জিতে অমলিন আখর হয়ে খোদিত হয়ে যায়। গাছ, প্রকৃতি, বুদ্ধত্ব সব একাকার হয়ে যায় তথাগতর অনন্ত জীবনে।
প্রকৃতি পরিবেশ গাছপালার সাহচর্য সিদ্ধার্থর উপলব্ধির স্তরে বড়ো রকমের পরিবর্তন এনেছে। তিনি নিজেও তা উপলব্ধি করতে পারেন। সঙ্গের অনুচরদের সাথে পাড়ি দেন নানান জনপদ , নানান দেশে। দিব্যকান্তি সন্ন্যাসীকে দেখে বিমুগ্ধ মানুষেরা দল বেঁধে তাঁকে ঘিরে ভিড় জমায়। তাঁদের সুখ দুঃখের কথা ভাগ করে নেয় নবীন সন্ন্যাসীর সঙ্গে কোনো এক গাছের নিবিড়ঘন ছায়ায় বসে। আজও তেমনই এক দিন। সিদ্ধার্থ এসে হাজির হয়েছেন নীরাঞ্জনা নদীর তীরে গয়ায়। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধার্থ জানেন সেই কথা। সুবিস্তৃত নদী তথাপি নীরাঞ্জনা অন্তঃসলিলা। সামান্য কিছু অংশ জুড়ে কেবল ক্ষীণ জলের রেখা। দিগন্ত প্রসারিত ধু ধু বালির চর তাঁকে মনে মনে পীড়িত করে। মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষের জীবন কি তাহলে এমনই বিবর্ণ ? জীবন কি নিষ্প্রবাহী বদ্ধ জলাশয়ের মতোই স্থির হয়ে থাকবে? নিজের ভেতরে এক শিহরণ জাগে? কী করছি আমি? আমার চিন্তন কি একজায়গায় থমকে আছে? অস্থিরতা গ্রাস করে সিদ্ধার্থর শরীর মন সবকিছু। প্রভুর এমন ভাবান্তর দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে তাঁর পার্শ্বচরেরা। সিদ্ধার্থ তাঁদের বলেন, “তোমরা চিন্তা করোনা। আমি এক নতুন বোধের স্তরে উন্নীত হতে চাই। আর এরজন্য আমাকে কঠোর সাধনায় বসতে হবে। যে উদ্দিষ্ট পূরণের জন্য পথে নেমেছি, তাকে অর্জন করাই আমার পরম লক্ষ্য হয়ে উঠুক।”
নীরাঞ্জনা নদীর জলে স্নান সেরে নেন সিদ্ধার্থ গৌতম, আর তারপর নদীর তীরে আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশালাকৃতির পিপুল গাছের নিচে বসে শুরু করলেন কঠোর সাধনা। তখন তাঁর বয়স মাত্র পয়ত্রিশ। দিনরাত এক করে চললো তাঁর কঠোর তপস্যা। একটানা ৪৯ দিন। কোনো কষ্টকেই এখন আর কষ্ট বলে মনে হচ্ছেনা শাক্যমুণির। নানান প্রলোভনের ফাঁদ এড়িয়ে আজ তিনি পরম প্রেয়র যেন সন্ধান পেলেন। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একদিন ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন তিনি, আজ এই নীরাঞ্জনা নদীর তীরে, এই সুবিশাল পিপুল বৃক্ষ তলে তপস্যা করে তিনি সেই পরম বোধের স্তরে নিজেকে উত্তীর্ণ করলেন । আজ থেকে সিদ্ধার্থ থেকে তিনি হলেন পরম বোধি বোধিসত্ত্ব। এইক্ষণে আনন্দের শিহরণ জাগে নীরাঞ্জনার তীরবর্তী বনরাজিতে। পত্র পুষ্প পল্লবে সতত শোভিত হয় সমস্ত অঞ্চল। প্রকৃতিই যেন বরণ করে নেয় তাঁর বোধিজ্ঞানী সন্তানকে।
আজ তাঁকে ঘিরে রেখেছে অগণিত মুমুক্ষু মানুষ। সবারই এক প্রশ্ন, এক জিজ্ঞাসা – “হে শ্রমণপ্রবর,
হে মহাতপা , হে শাক্যকুলতিলক বোধিসত্ত্ব! আপনি বলুন আমরা কীভাবে নিজেদের জীবনকে গড়বো? কোন পথেই বা মিলবে মুক্তি?” সমবেত মানুষের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসেন অমিতাভ। তারপর ধ্যানাসন থেকে উঠে দাঁড়ান। দীর্ঘ উপবাসে তাঁর দিব্যতনু আজ অশক্ত, ক্ষীণকায়। তবুও উঠে দাঁড়িয়ে তিনি সেই দিব্য বোধি পিপুল বৃক্ষটিকে আলিঙ্গন করে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। তারপর কম্প্রকন্ঠে বলেন – আপনাদের দর্শন করে খুব শান্তি পেয়েছি। আপনারা সমস্ত জীবের প্রতি
সমানভাবে দয়াপরবশ হবেন। ভোগের পথ ছেড়ে সহজ জীবন পথের পথিক হোন। এই পথেই মিলবে শান্তি মুক্তি প্রসন্নতা। আপনারা এই বোধিবৃক্ষটিকে দেখুন। কি অনির্বচনীয় নির্মল প্রশান্তি উপলব্ধি করছি এর সুনিবিড় ছায়ায় ! গাছের দেহতন্তু আমাদের ধৈর্যশীল হবার শিক্ষা দেয়, গাছের ফুল হলো বিচিত্র গুণের প্রতীক, মানুষ যত গুণের আধার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে ততই বাড়বে তাঁর মান, মান্যতা ; গাছের ঐ আন্দোলিত শাখাপ্রশাখা আমাদের সতর্ক হবার, চেতনা সম্পন্ন হবার, প্রজ্ঞাবান হবার শিক্ষা দেয় ; আর মাটির গভীরে প্রসারিত মূল যেন বলে – তোমরা তোমাদের জীবনবোধকে ধম্মরূপ বিশ্বাসভূমির গভীরে সঞ্চালিত করো। তাতেই পরিপূর্ণ হবে তোমরা গাছের কথা, বনরাজির কথা শুনতে পেলেই দেখবে তোমরা সবাই মুক্তির পথও খুঁজে পাচ্ছো।”
এই কথা শুনে ভিড়ের মধ্য থেকে জনৈক ভক্ত তাঁকে প্রশ্ন করলেন – ভগবন্ , আপনি গাছের থেকে শিক্ষা নেবার কথা বলছেন, অথচ গাছ তো নড়াচড়া করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। তাহলে ….?
সামান্যতম উত্তেজিত না হয়ে বুদ্ধদেব মৃদু হেসে বললেন – “বৎস তোমার চিন্তা ভাবনাকে আরও পরিশোধনের প্রয়োজন আছে। তবে আমরা সবাই এমন বিভ্রান্তির শিকার। আমাদের মানুষের মতো প্রকৃতিরও নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষাকে বুঝতে হলে আমাদের তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে হবে। গাছ আমাদের বিপুল বৈভবে সম্পন্ন করে , আর তাই আমাদের উচিত তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকা। আমরা যেন কখনোই এই সত্যোপলব্ধি থেকে বিচ্যুত না হই।” এই কথা বলে বুদ্ধদেব সকলকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের পথে মাধুকরী সংগ্রহে রওনা দিলেন।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে বোধি বৃক্ষ নিছকই একটা গাছ মাত্র নয় , এই গাছটি তাঁদের কাছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো যা জীবনের সকল গভীর জাগতিক অন্ধকার থেকে নির্বাণের আনন্দ আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। মানুষের জীবনে শান্তি ও আনন্দকে খুঁজে পাওয়ার প্রেরণার উৎস হলো এই গাছ। বোধি বৃক্ষের পাতার আকৃতি হৃদয়ের মতো । একজন সমানুভূতি, সহানুভূতি সম্পন্ন হৃদয়বান মানুষ হয়ে ওঠার পথ দেখায় বোধিপত্র। এই শিক্ষা যে বুদ্ধ ভগবানের শিক্ষা, প্রকৃতির শিক্ষা। লোক হিতে নীরব নিঃস্বার্থ সেবার যে বাণী বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি তা যে প্রকৃতি পরিবেশ থেকেই উৎসারিত। আর তাই ভগবান বুদ্ধ বলেছেন – “বৃক্ষ তথা বনভূমি হলো এমনই এক প্রাণদ উপাদান যা কোনোরকম প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই তার অপার করুণা আর অকৃপণ দানের সম্ভারে নিরবচ্ছিন্ন কাল ধরে আমাদের পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ কুঠার হাতে বৃক্ষ সংহার করে তাকেও সযতনে সুশীতল ছায়া আর নানান উপকরণ দিয়ে সাহায্য করে বৃক্ষ তথা বনভূমি” । এই সত্যকে আজ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে।
জন্ম থেকে বোধি বা পরম জ্ঞান অর্জনের যে পর্ব তাতে দুটি বৃক্ষের ভূমিকা – অশোক ও পিপুল – অনন্য। ভগবান বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার জন্য এই দুটি গাছ তাঁর অনুগামীদের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধা ও মান্যতা পায়। অমিতাভ বুদ্ধের জীবনের অন্তিম পর্বের সঙ্গেও ঘটনাচক্রে জড়িয়ে আছে আরও একটি গাছ – শাল। বোধিত্ব অর্জনের পর বুদ্ধদেব ধম্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গাঙ্গেয় সমভূমির নানা প্রান্তে ব্যাপক পরিভ্রমণ করেন। তবে তাঁর প্রথম উপদেশের জন্য বেছে নিয়েছিলেন বারানসীর সমীপবর্তী সারনাথকে। এখানে মৃগদাবে তিনি শিষ্যদের কাছে তাঁর গভীর উপলব্ধির কথা সর্বপ্রথম জানান। এই কাজের মধ্যেও তাঁর প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরক্তি প্রকাশ পায়।
নরদেহে বুদ্ধদেব বেঁচে ছিলেন আশি বছর। নিঃসন্দেহে অনেকটাই দীর্ঘ সময়। কৃচ্ছতা ও অন্তহীন দীর্ঘ পথে পরিভ্রমণ শরীরের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি মনে মনে বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর অন্তিম কাল সমাগত। তাই
পাটলিপুত্র বৈশালী হয়ে পাবা, কুশীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। দীর্ঘ পথ। মাঝেমাঝেই পথপ্রান্তের বৃক্ষচ্ছায়ায় উপবেশন করে যন্ত্রণাক্লিষ্ট ক্লান্ত শরীরকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন বুদ্ধদেব। শরীরের সমস্ত ক্লেশ উপেক্ষা করে অবশেষে পাবাপুরীতে পৌঁছলেন তিনি। বিশ্বস্ত সহচর শিষ্য
আনন্দকে অনুরোধ করলেন উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একটু বিশ্রামের আয়োজন করতে। আনন্দ জানতেন যে কোনো নির্মিত আবাস প্রভুর পছন্দ হবেনা, তাই বিশাল এক শাল বৃক্ষের তলায় তৈরি করা হলো প্রভুর অন্তিম সজ্জা। ভগবান বুদ্ধ ধীর পায়ে সেই আসনে উপবিষ্ট হলেন। চোখ মেলে অবলোকন করলেন সেই সুবৃহৎ দ্রুমটিকে, চোখ বন্ধ করেই মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সেই গাছের প্রতি, অনন্ত প্রকৃতির প্রতি। তারপর শুয়ে পড়লেন অন্তিম সজ্জায়। পরিব্রাজক বুদ্ধ পরিনির্বানের পথে মাধুকরী সংগ্রহে যাত্রা করলেন। জীবনের শেষ দিনটিতেও সাক্ষী থাকলো একটি গাছ তাঁর কর্মমুখর জীবনের অন্তিম স্মারক হিসেবে।
**তথ্যসূত্র
১) Our Tree Neighbours Chakravarti S.Venkatesh, National Council of Research and Training.
২) Tree and Serpent Worship Fergusson.J
৩) The Cult of Trees and Tree Worship in Buddhist – Hindu Sculptures. Randhwa. M.S
৪) Ashoka Tree Dictionary of Buddhism Nichiren Buddhism Library.
৫) Under What Tree Was The Buddha Born? discourse. suttacentral.net
৬) Buddha and His Dhamma Ambedkar. B.R
**
আলোচ্য প্রবন্ধটি ঋদ্ধি সাহিত্য পত্রিকার একবিংশ বর্ষ সাহিত্য সংখ্যা – বুদ্ধ কথা , পৌষ ১৪৩১, জানুয়ারি ২০২৫ থেকে সংগৃহীত।












আসাামে যেখানে আমার এখন সাময়িক বাস, তার দুটো বারী পরেই এক বৌদ্ধ মঠ…আজ বুদ্ধ পুর্নিমার দিনে সেখান থেকে ভেসে আসছে প্রার্থনার সুর, তার সাথে এই লেখা…গায়ে কাঁটা দিল…
এই টালমাটাল সংক্ষোভের সময়ে মনকে শান্ত রাখা বড়ই কঠিন। এই লেখাটি পড়ার পর যদি ক্ষুব্ধ মনে সামান্য প্রশান্তির ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে হয় তাহলে তাকে ভগবান বুদ্ধের পরম আশীর্বাদ বলেই মানতে হবে। লেখাটা ছড়িয়ে পড়ুক বৌদ্ধ বাণীর মতো।
DURDANTO. ETO KICHU SOTTI JANTAM NA. APNAR LEKHA TA PORE SOMRIDDHO HOLAM. APEKKHAY ROILAM ARO EK SUNDOR LEKHANI R.
জেন – যা সত্য, তাই সুন্দর। যা সুন্দর তাই সত্য। নতুন কিছু জানার মধ্যে যে আনন্দ মিশে আছে, সেই আনন্দ পরিপূর্ণ করুক হৃদয় ও মনকে। জানা এবং জানানো দুইই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনকে শান্ত স্নিগ্ধ উন্মুখ করে রাখলে আনন্দে অবগাহনের অবকাশ বারবার মিলবে।
বুদ্ধপূর্ণিমাতে বুদ্ধদেব ও প্রকৃতির সংযোগের এক মিষ্টি, সুখপাঠ্য লেখা।পড়ার পর ভালো লাগা জড়িয়ে আছে মনে।
সুজাতা থাকলে ব্যক্তিগত ভাবে আরো একটু ভালো লাগত।সত্যি মিথ্যা যাই হোক সুজাতার প্রতি দুর্বলতা আছে।মঝঝিম পন্থার সঙ্গে পায়েস খাওয়া মানান সইও বটে।
শেষ হয়েও যেন শেষ হলোনা, কিছু রেশ রয়ে গেল — এই অনুভূতিটা খুব বড়ো পাওয়া। একবার সেই রসে মন মজলে অন্য কিছুরই আর প্রয়োজন নেই। এও এক বোধি লাভ।
ভগবান বুদ্ধের জীবনের তিনটি প্রধান ঘটনা — জন্ম , বোধি লাভ ও নির্বাণকে নিয়ে এমন মনোগ্রাহী, তথ্যবহুল ও প্রাণবন্ত আলোচনা পড়ে সত্যিই আপ্লুত হলাম। ভাবতে কষ্ট হয় ভগবান তথাগতর জন্ম হয়েছিল এই দেশের মাটিতে। খুব ভালো লাগলো লেখাটি।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে লেখাটা পড়ে মনটা ভরে গেল
An excellent write up on presence of mother nature in Gautama Buddha’s life! The importance of trees and tree planting has always been stressed upon in our religion and culture. We are supposed to celebrate every major event of our lives by planting trees as per our ancient culture and tradition. Here, the Pipal tree has literally been shown as knowledge personified!