অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও দুষ্টু জিন
এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘নেচার’ পত্রিকায় ‘অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এফেক্ট’ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে (তথ্যসূত্র ১)। বিজ্ঞানের গবেষণায় হঠাৎ অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এফেক্ট কেন? আমরা ফিজিক্সে রামন এফেক্ট, বায়োকেমেস্ট্রিতে পাস্তুর এফেক্ট, এমনকি বিবর্তন বিজ্ঞানে গ্রিন বিয়ার্ড এফেক্ট শুনেছি, কিন্তু অ্যাঞ্জেলিনা জোলির এফেক্ট তো হলিউডেই সীমাবদ্ধ বলে জানতাম। বিজ্ঞানের ব্যাপারে তার প্রভাব এল কি স্রেফ ‘সুন্দর মুখের জয়’ বলে?
১৪ মে ২০১৩। হলিউডের নায়িকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি জানালেন, তিনি তার দুটি স্তন অপারেশন করে বাদ দিয়েছেন। কেন? তার শরীরে এমন জিন ছিল যা স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অ্যাঞ্জেলিনার মা ৫৭ বছর বয়সে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে মারা যান। মায়ের শরীরের সেই দুষ্টু জিন মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনার শরীরেও এসেছে।
চিকিৎসকদের সঙ্গে বহু আলোচনার পরে অ্যাঞ্জেলিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, ক্যানসার হবার আগেই নিজের স্তন দুটি বাদ দেবেন। প্লাস্টিক সার্জারি করে কৃত্রিম স্তন স্থাপন করার পরে তিনি সেই খবর মিডিয়াকে জানালেন (তথ্যসূত্র ২)।
অ্যাঞ্জেলিনা লিখলেন, “আমার ডাক্তাররা অনুমান করেছেন যে, আমার স্তন ক্যান্সারের ৮৭ শতাংশ এবং ওভারির (ডিম্বাশয়) ক্যান্সারের ৫০ শতাংশ ঝুঁকি ছিল”, সুতরাং “আমি সক্রিয় হয়ে যতটা সম্ভব ঝুঁকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রোগ প্রতিরোধের জন্য দুটি স্তন কেটে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। … আমার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি আমার ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকির চেয়ে বেশি, এবং [ডিম্বাশয় বাদ দেবার] অস্ত্রোপচারটি বেশি জটিল। … এখন এটা নিয়ে লিখছি কারণ আশা করি অন্যান্য নারীরা আমার অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হতে পারবেন।”
‘অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এফেক্ট’ হল এই শেষ লাইনটার বাস্তব ফল। ‘নেচার’-এর গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ক্যানসার হবার আগেই স্তন বাদ দেবার হার কয়েকগুণ বেড়েছে।
অধিকাংশ স্তন ক্যানসার জিনগত নয়, বা বংশানুক্রমিক নয়। তবে যাদের বিআরসিএ১ (BRCA1) জিনের বিশেষ মিউটেশন আছে, তাদের নিজেদের ও তাদের কন্যাসন্তানের বংশানুক্রমিক স্তন ক্যানসার হবার সম্ভাবনা মোটামুটি ৬৫ শতাংশ।
জিন হল বংশগতি বা হেরেডিটি-র একক। তা বংশানুক্রমে নানা বৈশিষ্ট্য বহন করে। টিকালো বা খ্যাঁদা নাক, বেঁটে বা লম্বা গড়ন, কালো বা ফরসা রং, এগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্য। তবে টিকালো নাককে ঘুঁষি মেরে থ্যাবড়া করা যায় আর খ্যাঁদা নাকে প্লাস্টিক সার্জারি করে টিকালো করা যায়—সে সব কথা এখানে ধরছি না।
মানুষ বা যে কোনও জীবের বিবর্তনে যে সমস্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য সুবিধা দেয় সেগুলো টিকে থাকে। জিরাফের লম্বা গলা মগডালের পাতা খেতে সাহায্য করে, তাই লম্বা-গলার জিরাফের বংশবৃদ্ধি হয় বেশি। লম্বা-গলার জিরাফের বংশধররাও লম্বা হবে। আর বেঁটে গলার জিরাফরা পাতা না খেতে পেয়ে বংশধর রক্ষা করতে পারবে না। ধীরে ধীরে ওরা লুপ্ত হয়ে যাবে। এই লম্বা-গলা বা বেঁটে-গলা বৈশিষ্ট্য বহন করে শরীরের ভিতরে কোষের মধ্যে থাকা জিন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জিরাফের লম্বা-গলা জিনের কপি বাড়ে, আর বেঁটে-গলা জিনের কপি কমে। শুধু লম্বা গলা নয়, যে কোনও সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য বহনকারী জিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাড়ে, অসুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য বহনকারী জিনের কপি কমে। এটাই হল জিন-স্তরে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’।
এখানেই ‘ক্যানসার জিন’ নিয়ে আমাদের মহা সমস্যা। বিআরসিএ১ (BRCA1) জিনের যে বিশেষ মিউটেশন ক্যানসার ঘটায়, তা অ্যাঞ্জেলিনার শরীরের এসেছিল তার মায়ের কাছ থেকে, আর মায়ের কাছে এসেছিল দিদিমার কাছ থেকে, দিদিমার কাছে এসেছিল তার মায়ের কাছ থেকে। ক্যানসার যে অসুবিধাজনক, এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই। তাহলে ক্যানসার জিন প্রজন্মান্তরে যায় কেমন করে, কেমন করে তা বংশ-পরম্পরায় টিকে থাকে? প্রাকৃতিক নির্বাচন তাকে বাদ দিচ্ছে না কেন?
ক্যানসার জিন তার বহনকারীর মৃত্যু ডেকে আনছে, কিন্তু তা নিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন বিন্দুমাত্র ‘চিন্তিত’ নয়। অ্যাঞ্জেলিনা জোলির শরীরে ক্যানসার ঘটানো জিনটি (BRCA1 জিনের মিউট্যান্ট অ্যালিল) ক্যানসার ঘটায়, তবে ক্যানসার হয় বেশি বয়সে। ততদিনে নারীর সন্তানধারণ ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। ক্যানসারের রোগিণী যখন মারা যান তখন তার সন্তান-সংখ্যা কিন্তু অন্য কারও চাইতে কম নয়। ফলে পরের প্রজন্মে ক্যানসার জিনের বাহক সংখ্যা কমে না।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অন্য নানা জিনের সঙ্গে ক্যানসার জিনও প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে যায়। জননকোষ তৈরির সময়ে সে অন্য সব জিনের সঙ্গে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে ও পরের প্রজন্মে যায়। জীবনের একটা সময়ে এই জিন অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ঘটায়, শুরু হয় ক্যানসার। এতে নারীটি মারা যান, কিন্তু ততদিনে নারীর সব কয়টি সন্তান হয়ে গেছে ও ক্যানসার-জিন তার নিজের কপি পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পুরোমাত্রায় সফল হয়েছে।
জিরাফের লম্বা-গলার জিনের চেনা উদাহরণ থেকে আমাদের ধারণা হয়, জিন কেবলমাত্র জীবের উপকার করে, আর সেভাবেই নিজে টিকে থাকে। আসলে জিন কেবল নিজের কপি বাড়াতে চায়। তার একটা উপায় হল, জীবের উপকার করা। তাহলে জিন বহন করা জীবের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু সেটা জিনের প্রাথমিক কাজ নয়। জিনের ওপর যদি মানুষের মত উদ্দেশ্য আরোপ করি, তাহলে বলতে হয়, বাহকের স্বার্থ নিয়ে জিন ‘চিন্তিত’ নয়, তার প্রাথমিক কাজ হল যে কোনোভাবে নিজের কপি বা প্রতিলিপি-সংখ্যা বাড়ানো।
যে জিনের প্রতিলিপি বেশি, সেই জিন তত বেশি থাকে। সেটাই জিন-স্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচন। কিন্তু জীবের ওপরে তার ফল একরকম হয় না। কোনও জিন তার বাহক জীবকে বেশিদিন বাঁচায়। কোনও জিন তার বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কোনও জিন কিছুই না করে ক্রোমোজোমের মধ্যে নিজের জায়গাটুকু বজায় রাখে। আবার কোনও জিন যে দেহে বসে আছে তার ক্ষতি করে। এদের কাজের মধ্যে মিল এইটুকুই যে এরা যেন তেন প্রকারেণ নিজের কপি বাড়াতে পারে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন কেবল ‘ভাল জিন’ বেছে নেয় না। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভালমন্দ দেখার ক্ষমতা নেই। প্রাকৃতিক নির্বাচনের দেখার ক্ষমতাই নেই, সে অন্ধ। তবু প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, সেরা কারিগর। তারই হাতে শুরু হল চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন। তার লীলায় বাঘিনীর দাঁতে এল ছুরির ধার, বিছুটির পাতায় এল বিষ, বটের গায়ে ঝুরি, ধানগাছের শীষে পাকা ধান, ডলফিনের বুদ্ধি, হাতির নাক, জেব্রার ডোরা।
এবং তার হাতেই গড়ে উঠল অ্যাঞ্জেলিনার বা ব্র্যাড পিটের রূপ, আর সেই রূপসাগরে ডুব দেবার চোখ।
চিত্র পরিচিতি
১) অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
২) BRCA1 / 2 জিনের প্রভাবে ক্যানসার হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি
তথ্যসূত্র
১) Basu NN, Hodson J, Chatterjee S. et al. The Angelina Jolie effect: Contralateral risk-reducing mastectomy trends in patients at increased risk of breast cancer. Sci Rep 11, 2847 (2021).
২) The New York Times, OP-ED CONTRIBUTOR, “My Medical Choice” By Angelina Jolie, 14 May 2013,