কথাটা শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেছিল শুভ-র। বার বার একই উত্তর। রাগে শরীরের মধ্যে রক্ত তখন ফুটছে। আর থাকতে না পেরে সিধে ইউনিয়ন রুমে নিয়োগীজির সামনে গিয়ে কথাটা বলেই ফেলেছিল। আমি কি খালি ডাক্তারি করবার জন্য এখানে পড়ে আছি? কী মনে হয় আপনার? উত্তেজনায় গলার সুর চড়েছিল বই কি। নিয়োগীজি শান্ত ভাবে জানতে চেয়েছিল উত্তেজনার কারণ কী? এখন ভাবলে একটু লজ্জা করে। সেদিন হয়তো এতটা উত্তেজিত না হলেও তার কাজটা হয়েই যেত। শুভ-র পরিকল্পনা বুঝতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমা-আটায় যে সম্মেলন হয়েছিল তাতে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যের কথা বলা হয়েছিল। সেই সম্মেলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। সেখানে বলা হল স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। সেই অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই দরকার। লড়াইটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক। পশ্চিমবঙ্গেও এই লড়াই শুরু হয়েছিল, ছোটখাটো বিভিন্ন দাবী দাওয়ার মাধ্যমে। তারপর জোরদার হয় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন — ১৯৮৩ এবং ১৯৮৬ সালে। এই দশকেই পশ্চিমবঙ্গে দু’টি সংগঠন গড়ে উঠেছিল যারা চেয়েছিল মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত সচেতন করতে। এক ‘নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’। সুখময় ভট্টাচার্য এবং জ্ঞানব্রত শীল, এই দুই ডাক্তার ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সাধারণ অসুখবিসুখ কী ভাবে বিনা পয়সায় বা কম পয়সায় সারানো যায়, তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পুস্তিকা বের করা হয়েছিল। আর একটি সংগঠন চাইছিল ওষুধ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে— তার নাম ‘ড্রাগ অ্যাকশন ফোরাম’। ড: সুজিত দাশ ও ড: পীযুষকান্তি সরকার ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড: স্মরজিৎ জানা প্রমুখ। ওষুধের যুক্তি সংগত ব্যবহারের আঁতুর ঘর বলা চলে শহীদ হাসপাতালকে। এখন শুভ চায় ছোট ছোট পুস্তিকার মাধ্যমে দল্লিরাজহরার শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে বিভিন্ন সচেতনামূলক বিষয়কে পৌঁছে দিতে। পুস্তিকা ছাপাবার জন্য টাকা চাইতে গেলেই হেলথ ওয়ার্কার যাঁরা টাকার দায়িত্বে আছেন তারা এককথায় টাকার অসুবিধা আছে বলে শুভ-র প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এক দু’বার এই ঘটনা ঘটার পর শুভ সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি। নিয়োগীজির সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য ইউনিয়ন রুমে ছুটে গেছিল সে। এখন মনে হয় অতটা উত্তেজিত না হলেও চলত। নিয়োগীজি স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই খুব শান্তস্বরে জানতে চাইলেন কি ঘটেছে। শুভ সবটা খুলে বলল।
কত লাগবে আপনার?
প্রাথমিকভাবে হাজার দুয়েক হলেই চলবে। তারপর বই বেচার টাকাতেই আগামী সংখ্যাগুলো করে নিতে পারব। শুভ বলে উঠেছিল। ব্যস হয়ে গেল টাকার জোগাড়। সেই থেকে একা হাতে প্রকাশনার কাজ সামলাচ্ছে শুভ। লোক সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশ হয়েছে “ফাগুরাম যাদব কে চুনে হুয়ে গীত”।
নিয়োগীজির বিশেষ আগ্রহ ছিল এই বইটার ব্যাপারে। ফাগুকে কাছ থেকে দেখছে শুভ। প্রতিদিন ছেঁড়া হাফ প্যান্ট আর লাল মাটির ধুলোয় রাঙা গেঞ্জি পরে খাদানে যায়। ফিরে এসে ঘরের কাজ বা ইউনিয়নের কাজ করে। আর সময়ে সময়ে কবিতা বাঁধে। নদীর তির তির বয়ে যাওয়া স্রোতের মতোই স্বছন্দ তার কবিতা। মানুষটাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না।
দু’মাস ছাড়া বেরোচ্ছে স্বাস্থ্যের সাধারণ সমস্যাগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য-পুস্তিকা। সিরিজের নাম দেওয়া হল লোকস্বাস্থ্য শিক্ষামালা। প্রথম পুস্তিকা ছিল “রক্তদান কে বারে মে সহী জানকারি”। অন্যান্য জায়গার মতো দল্লিরাজহরার মানুষের মধ্যে রক্ত দান করা নিয়ে অনেক ভয় ভীতি কুসংস্কার কাজ করত। সেই ভয় দূর করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহন করা হল শহীদ হাসপাতালের পক্ষ থেকে। মানুষের ভুল ভাঙাতে হাসপাতালের ডাক্তার কর্মীরা, ইউনিয়নের নেতারা রক্তদান করতে লাগলেন। তাই দেখে সাধারণ মানুষ বুঝলেন রক্ত দিলে কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়ে তারা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে লাগলেন। রক্তের প্রয়োজনে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যেত। যাতে দরকার পড়লে রক্তের অভাবে কোনও রোগী মারা না যান।
হাসপাতালের প্রচার আন্দোলনে আরও একটা বিষয় গুরুত্ব পেয়েছিল। ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। ডায়রিয়ার প্রধান কারণ হল দূষিত জল পান করা। কাজেই ডায়রিয়ার প্রতিরোধে পরিস্কার পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা প্রচারের মাধ্যমে এলাকার মানুষকে জানানো জরুরী হয়ে পড়েছিল। তাই ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা সচেতন মানুষদের নিয়ে পানীয় জলে দাবীতে আন্দোলনে নামে। তার ফলস্বরূপ গত বছর রাজ্য প্রশাসন ও ভিলাই ইস্পাত কারখানা দল্লী-রাজহরা ও তার আশে-পাশের গ্রামগুলিতে ১৭৯টি নলকূপ বসাতে বাধ্য হয়।
শংকর আজকাল পরিবেশ নিয়েও বেশ চিন্তিত। এখানকার নদীগুলো খনি এবং কারখানার জন্য ক্রমশ: দূষিত হচ্ছে। বনদপ্তরের অন্যায় নিয়ম কানুন এবং বায়ুমণ্ডল ও জলকে যারা দূষিত করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পরিবেশ বিষয়ে তার ভাবনা চিন্তাগুলো নিবন্ধে লিখতে শুরু করেছেন। নিজের জীবনী লেখায় তার বড় অনীহা। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন। হাতে যেন বেশি সময় নেই। আজকাল এমন মনে হয় প্রায়ই। অনেক কাজ করে যেতে হবে। শংকরের কলম চলতে থাকে…..
“আমাদের পৃথিবী এবং আমাদের গ্রহকে রক্ষা করতে হবে। গাছ, গাছপালা, বিশুদ্ধ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বাতাস, পাখি এবং প্রাণী এবং মানুষ – আমরা সবাই মিলে এই পৃথিবীর অংশ। কাজেই সংবেদনশীল এবং নমনীয় কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রকৃতি এবং বিজ্ঞানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে।”
ক্রমশ…