উনিশে এপ্রিল – কম করে মনে হয় উনিশ বার দেখেছি সিনেমাটা… প্রথম যে কবে দেখেছি, মনেও পড়ে না… খুব ছোটো বয়েসেই হবে, যখন তেমন কিছুই বুঝতাম না, তখন থেকেই বোধহয় আমার মনে কিছু ছাপ ফেলে গেছে সিনেমাটা….
মা আর মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা একটা পাহাড় সমান দূরত্ব… মা যেখানে শুধুই মা নয়, একজন সফল মানুষ, নৃত্যশিল্পী, বিখ্যাত পুরস্কারপ্রাপ্ত… শুরুতেই এই মহিলার সাফল্য মেনে নিতে পারেন নি তাঁর স্বামী, নাচ ছেড়ে দিয়ে, শুধু সংসার নিয়ে বাঁচতে চেয়েও মানুষটার গভীর হীনমন্যতা, ego ইত্যাদি কাটানো যায়নি… মেয়ে ছোটো থেকেই জেনেছে মা স্বার্থপর, মা সংসারে সময় দেয় না, মা নিজেকেই শুধু ভালোবাসে, মা খুব খারাপ…. বাবার মৃত্যুর জন্যও মেয়েটি মাকেই দায়ী করেছে, এতটাই যে কর্মরতা মায়ের মতন হবে না বলেই হয়তো ডাক্তারি পাশ করেও, প্রেমিকের মায়ের দাবী অনুযায়ী, ডাক্তারি ছেড়ে গুছিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলো……
আমাদের জেনারেশনেও কর্মরতা মাদের একটা অসম্ভব অপরাধবোধ আর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সন্তানকে সময় দেয়া বা যত্ন করা নিয়ে…. আশেপাশের সমাজ একটু সুযোগ পেলেই শিশুকে বোঝায়, ওই দেখো তোমার মায়ের কাছে কাজটাই বড়ো, তোমায় ভালোবাসে না মা, মা স্বার্থপর… আমাদের মাদের সময় এই জিনিস আরো ভয়ঙ্কর রূপে ছিলো… অথচ বাবাও তো কাজ করে, কই বাবাকে নিয়ে তো এসব বোঝানো হয় না…. মায়ের কাজটা শখের নয়, মা কাজ করে, কারণ মায়ের উপার্জনের টাকাও সংসারেই লাগে… এই সিনেমাতেই কিন্তু মেয়েটির বাবা মারা যাওয়ার পরে, মেয়েটিকে মানুষ করা, ডাক্তারি পড়ানো সবটাই মায়ের করা… অথচ এভাবে মেয়েটা ভাবেনি কোনোদিন… অভিমানে দূরে সরে গিয়েছে, মা সেভাবে বুঝে উঠে কাছে টেনে নিতে পারেন নি….!
ভাগ্যিস আমার মা পেরেছিলেন…. আমার বহু জন্মদিনে মা-কে স্কুলে যেতে হতো, আমার পরীক্ষার সময় আমার মা বাকিদের মতন স্কুলের বাইরে বসে থাকতে পারতো না… কিন্তু মা ছিলো… মা এর স্কুলে যাওয়ার আগে আমাদের একসাথে ভাত খাওয়া ছিলো, বিকেলে আবার পড়তে বসানো ছিলো, আজকাল মাঝেমাঝে মনে হয় মা বেশি করেছে… নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে… শুধু balance করার জন্য… কোথাও না কোথাও ওই সমাজের conditioned একটা অপরাধবোধ ছিলো…..
অথচ বিশেষ করে একটা মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে একজন কর্মজীবি মায়ের উদাহরণ নিয়ে বড়ো হওয়া যে কতো বড়ো একটা inspiration, কতো বড়ো মনের জোর সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না…. মা শুধু আমার মা নয়, মা একজন সফল মানুষ, মাকে মায়ের নামে কতো মানুষ চেনে, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, এমন একজন রোল মডেলকে সামনে দেখে বড়ো হওয়া তো প্রাপ্তি….
আর তারপরে সে মেয়ে নিজে যখন মা হয়, তার কিন্তু ওই “অপরাধবোধ”, ওই সময় না দিতে না পারার যন্ত্রণা, ওই টানাপোড়েন ভোগ করতে হয় না বিশেষ … নিজের মায়ের উদাহরণ উজ্জ্বল হয়ে থাকে চোখের সামনে…..
আজ মনে হয় ভাগ্যিস আমার মা সারাদিন লেপ্টে থাকতো না গায়ের সাথে, ভাগ্যিস আমার মা শুধু আমার মা হওয়া ছাড়াও আরো অনেককিছু হয়েছে, হতে চেষ্টা করেছে, হতে পেরেছে – এইটুকুই তো আমাকে এগিয়ে দেয় অনেকখানি!!! শুধু আমার মা হওয়া ছাড়াও আমার মায়ের নিজের পরিচিতি আছে, আমাকে মানুষ আমার বাবার পরিচয়ে যেমন চেনেন, তেমন আমার মায়ের পরিচয়েও বহু মানুষ চেনেন, এই বিষয়টা আসলে গর্বের – এর জন্য মাকে একটু miss করাই যায়…. সন্তান-কে এটুকু বোঝাতে পারলেই বোধহয় সমাজ আর ভুল বোঝানোর সুযোগ-টা পায় না!