(১)
মাউন্টেন গরিলা বা পার্বত্য গরিলা। আফ্রিকার রাওয়ান্ডা, উগান্ডা আর কঙ্গোর পাহাড়ী এলাকায় বাস করা বিলুপ্তপ্রায় এক প্রজাতি। আমেরিকান প্রাইমাটোলজিস্ট ডিয়ান ফসিই (Dian Fossey) ১৯৬৬ সাল থেকে গরিলাদের নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি ও তার মত অনেকে দেখালেন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরিলারা অনেক সময়ে শিশুদের মেরে ফেলে। নৃশংস ব্যাপার।
কেন পুরুষ গরিলা শিশুদের মেরে ফেলে? এই প্রশ্নের চটজলদি জবাব পাওয়া শক্ত।
গরিলারা দলবদ্ধ প্রাণী আর এদের দলকে বলে ‘ট্রুপ’। বছর বারো বয়সে পুরুষ গরিলা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের ঘাড়ের লোম সাদা হয়, এদের বলে ‘সিলভারব্যাক’। পুরুষ গরিলা স্ত্রী গরিলার চাইতে অনেক বড় আর বলশালী। কিছু ট্রুপ-এ একটিমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক দলপতি ‘সিলভারব্যাক’ পুরুষ থাকে, আর কিছু ট্রুপ-এ একাধিক প্রাপ্তবয়স্ক গরিলা থাকলেও দলপতি বা ‘আলফা মেল’ একটিই। দলপতির অনেক দায়িত্ব—অন্য জন্তুর আক্রমণ দলকে বাঁচানো, ট্রুপের মধ্যে ঝগড়া মেটানো, আর খাদ্যের খোঁজ রেখে দল নিয়ে নতুন জায়গায় যাওয়া।
কিন্তু দলপতি হবার সুবিধে আছে। ট্রুপের সমস্ত স্ত্রী গরিলার ওপর দলপতির একছত্র দখল। দলপতির সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য স্ত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। দলে যত বাচ্চা হয় তার (প্রায়) প্রত্যেকটির বাবা হল দলপতি। তারা দলপতির জিনগত উত্তরাধিকার বহন করে।
দলপতির মৃত্যু বা অসুস্থতার পরে ট্রুপ-এর অন্যান্য পুরুষদের মধ্যে কেউ দলপতি হয়, বা ট্রুপের বাইরে থেকে নতুন সিলভারব্যাক এসে দলপতি হয়ে বসে। অন্যথায় ট্রুপ ভেঙ্গে যায় ও স্ত্রী গরিলারা অন্য ট্রুপ-এ যোগ দেয়।
নতুন ট্রুপ-এ স্ত্রী গরিলারা স্বাগত, কিন্তু তাদের বাচ্চারা একেবারেই স্বাগত নয়। নতুন দলের দলপতি নবাগত স্ত্রীদের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতে পারে। স্ত্রী গরিলারা নতুন ট্রুপ-এ সিলভারব্যাকের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখার সবরকম চেষ্টা করে—সেটা তার বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টাও। কিন্তু শারীরিকভাবে সে এতই দুর্বল যে দলপতি মারতে চাইলে বাচ্চাকে বাঁচানোর ক্ষমতা তার নেই। (ফিচার চিত্র)
গরিলা শিশুরা তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ খায়। ততদিন গরিলা-মায়ের শরীরে ডিম্বাণু নিঃসরণ হয় না। এক কথায় ততদিন পর্যন্ত সেই স্ত্রী গরিলার গর্ভে নতুন দলপতি নিজের সন্তান উৎপাদন করতে পারে না। এর একটাই সহজ সমাধান আছে—বাচ্চাটি যেন মায়ের দুধ না খায়। তাহলেই মা গরিলা ডিম্বাণু উৎপাদন করবে। মায়ের দুধ বন্ধ করার সহজ উপায় বাচ্চাটাকে মেরে ফেলা। এতে নতুন দলের দলপতি দুটো সুবিধা পায়। এক, সে দ্রুত স্ত্রী গরিলার শরীরে নিজের সন্তান উৎপাদন করতে পারে। দুই, অন্য পুরুষের সন্তানদের সঙ্গে তার সন্তানকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না।
নৃশংস আচরণ। এর জিন-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা ঠিক হোক বা বেঠিক, তা বেশ আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই।
এইরকম আচরণ যদি অনেকাংশে জিন-নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে শিশুহত্যা-জিন গরিলা পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়ার কথা। শিশুহত্যা করে না যে ‘দয়ালু’ দলপতি তার বাচ্চা কম হবে, আর ‘শিশুহত্যাকারী’ দলপতির বাচ্চা তুলনায় বেশি হবে। পরের প্রজন্মের গরিলাদের মধ্যে ‘দয়ালু’ জিন কমবে আর ‘শিশুহত্যাকারী’ জিন বাড়বে।
(২)
জিন দয়ালু নয়। জিন নৃশংস বা শিশুহত্যাকারী নয়। সত্যি কথা বলতে কি, ‘শিশুহত্যাকারী জিন’ বলে কোনও জিন থাকা সম্ভবই নয়। শিশুকে মারতে গেলে লাগে গায়ের জোর, নখ-দাঁত, লাগে দলের মধ্যে নিজের শিশুদের মধ্য থেকে অন্য শিশুকে খুঁজে নেবার ক্ষমতা। একটি জিন, এমনকি একই সাথে কাজ করে এমন একটি জিন-গুচ্ছ, এত কিছু বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে পারেই না। পেশি তৈরি করা, নখ-দাঁত বানানো, বিভিন্ন পশুকে মারার কায়দা মনে রাখা, গরিলাদের দলের লোক ও বাইরের লোকের হিসেব রাখা, কোন স্ত্রী গরিলা গর্ভবাতী হতে পারে আর কোনটা তা হতে পারে না তার হিসেব রাখা—এটা কোনও একটি জিন বা একটা জিনগুচ্ছের কাজ হতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে ‘দয়ালু জিন’ বা ‘শিশুহত্যাকারী জিন’ বলতে এ সমস্ত কিছু করার জিনকে বোঝানো হচ্ছে না।
দলপতির গায়ের জোর, নখ-দাঁত, দলের বিভিন্ন সদস্যকে চেনার ক্ষমতা এমনিতেই আছে। সে এমনিতেই বাইরে থেকে আসা গরিলা বা অন্য প্রাণীকে হত্যা করতে পারে। সে এমনিতেই নতুন স্ত্রী গরিলাকে আলাদা করে চেনে। সে এমনিতেই জানে কখন স্ত্রী গরিলাটির গর্ভে বাচ্চা আসতে পারে বা পারে না। এসবের জন্য তার শরীরে যেমন দেহ তৈরির জিন আছে, তেমনই আছে বিশেষ আচরণের জিন—যেমন নতুন স্ত্রী-গরিলাকে দলে স্থান দেবার আচরণ।
‘দয়ালু জিন’ হয়তো তাকে নবাগত শিশু গরিলার প্রতি নিজের বাচ্চার মত আচরণ করার প্রবণতা বাড়ানোর জিন, ওটুকুই তার আচরণ-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। আর ‘শিশুঘাতক জিন’ হয়তো সেই শিশুর প্রতি শত্রুর মত আচরণ করার প্রবণতা বাড়ানোর জিন, ওটুকুই তার আচরণ-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। গরিলার ট্রুপ যেভাবে প্রজনন করে তাতে ‘দয়ালু জিন’ দলপতি পরের প্রজন্মে কম বংশধর রাখে, আর ‘শিশুঘাতক জিন’ দলপতি রাখে বেশি বংশধর। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ‘শিশুঘাতক জিন’ বেড়ে গেছে।
এখন মাউন্টেন গরিলা লুপ্তপ্রায় প্রজাতি। তাদের শিশুরা তাদের দলের পক্ষে খুব মূল্যবান। কিন্তু প্রজাতির এমন বিপদের দিনেও শিশুহত্যা চলছে। ‘শিশুঘাতক জিন’ প্রজাতির বিপদের কথা জানে না। সে কিছুই ‘জানে’ না। যে শরীরে সেই জিন বসে আছে, অন্যদের চাইতে সেই শরীর বেশি সন্তানের জন্ম দিলে সেই জিনের কপি পরের প্রজন্মে বেশি যায়। এই অন্ধ অযুক্তিতে ‘শিশুঘাতক জিন’ বেড়ে ওঠে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যায়। এবং একদিন তার প্রজন্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়, ‘শিশুঘাতক জিন’ ততদিন তার কাজ করে চলে।
(৩)
ডিয়ান ফসিইকে কে বা কারা তার অরণ্যকুটিরে হত্যা করে। সম্ভবত তারা চোরাশিকারি, ডিয়ান (চিত্র ২) তাদের কাজের বিস্তর অসুবিধা ঘটাচ্ছিলেন। হত্যারহস্যের অফিশিয়াল মীমাংসা আজও হয়নি।
ডিয়ানের ডায়েরির শেষ এন্ট্রি ছিলঃ
আপনি যখন সমস্ত জীবনের মূল্য বুঝতে পারবেন, তখন আপনি অতীতে যা ঘটে সে বিষয়ে কম চিন্তা করে ভবিষ্যতের সংরক্ষণে আরও মনোনিবেশ করবেন।
মানুষ কেমন জীব? সে কি মাউন্টেন গরিলাদের মত? নাকি সে ডিয়ান ফসিই-এর মত?
“সমস্ত জীবনের মূল্য” বোঝার ক্ষমতা কি হোমো সেপিয়েনস সেপিয়েনস প্রজাতিটির হবে? নাকি সে যুদ্ধ করবে, পুরনো প্রতিহিংসা আর নতুন সভ্যতার নামে ধ্বংস করে চলবে তার একমাত্র আবাস এই সবুজ গ্রহটিকে?
দারুণ।