রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় ঠেলে এগোনোই মুশকিল।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা, কি হয়েছে?”
তিনি উত্তর দিলেন, “পকেটমার ধরা পড়েছে। গণধোলাই চলছে।”
আরেকজন বললেন, “না, না, দাদা। চিড়িয়াখানা থেকে একটা ওরাং ওটাং পালিয়ে এসেছে। তাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে মানুষরা এমন অঙ্গভঙ্গি করছে যে সে বেচারা লজ্জায় ঘাপটি মেরে রয়েছে।”
এর মধ্যে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “এত ভিড় কেন?”
বললাম, “এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ফ্রিতে জাঙিয়া দিচ্ছে।”
“ওমা…তাই নাকি…” বলতে বলতে তিনি ভিড়ের দিকে হাঁটা লাগালেন।
কিন্তু বিষয়টা কি সেটাও তো জানার দরকার। আরেক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, “আকাশ থেকে একটা উল্কা এসে পড়েছে। সেটা ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। একেবারে মহাজাগতিক ব্যাপার।”
অবশেষে একজনের কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পেলাম, হিমালয় থেকে একজন সাধু এসেছেন। তিনি নাকি মাটি ছুঁলে সেই মাটি সোনা হয়ে যাচ্ছে। জল ছুঁলে জল হুইস্কি হয়ে যাচ্ছে। সেই মহাপুরুষের দর্শন পাওয়ার জন্যই এত ভিড়।
ভিড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলাম। সে কি সহজ কাজ? নানা বয়সের নারী পুরুষ জড়ো হয়েছে। সবাই সেই মহাপুরুষকে একবার দেখতে চায়। তাঁর কাছে মনের আকাংখা জানাতে চায়। পুরুষদের ঠেলে যদিবা এগোনো যায়, নারীদের ঠেলে এগোনো আমার কর্ম নয়। বরঞ্চ দুজন তরুণী, “আনসিভিলাইজড্, ইডিয়ট, ঘরেতে মা বোন নেই।” এই সব বলে আমাকে ছিটকে দিয়ে এগিয়ে গেল।
অবশেষে বাঙালির কৌতূহলের জয় হল। আমি ভিড়ের কেন্দ্রে পৌছালাম। দেখলাম একটা ন্যাড়া তেঁতুলগাছের তলায় একজন জটাজুটোধারী নেংটি পরা মহাপুরুষ বসে আছেন। বিড়বিড় করে কি সব বলছেন আর মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। মাঝে মাঝে একেবারে চুপ হয়ে যাচ্ছেন।
একজন ভদ্রলোক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞসা করলেন, “বাবা আপনি কোথা থেকে এসেছেন?”
“আমি ম্যানহোল থেকে উঠে এসেছিরে শালা। এই দেখ হারামজাদা আমার সারা গায়ে বিষ্ঠা লেগে আছে।”
ভদ্রলোকের মুখ চোখ ভক্তিতে গদ গদ হয়ে গেল। তিনি বললেন, “আহা, বাবার কি মহিমা। ম্যানহোলকে উনি তুলনা করলেন ব্ল্যাকহোলের সাথে। ব্ল্যাকহোলের মতই কোনও অসীম সময়ের ওপার থেকে উনি এসেছেন। আর ধারণ করেছেন সমাজের সব পাপ রূপ বিষ্ঠা।”
যদিও আমার মনে হল মহাপুরুষের গায়ে যে নোংরা লেগে আছে সেটা বিষ্ঠা হওয়াই স্বাভাবিক। এতদূর থেকেও আমি যেন বিষ্ঠার গন্ধ পাচ্ছিলাম। তবে বিষ্ঠা মেখে যিনি এত নির্বিকার ভাবে বসে থাকতে পারেন তিনি নিশ্চিৎ একজন মহাপুরুষ।
আরেকজন জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, আপনি কে?”
মহাপুরূষটি একটি উচ্চাঙ্গের হাসি দিলেন। তারপর বললেন, “আমি হলাম ঢ্যামনা হরেন, আমিই আবার অমিতাভ বচ্চন।”
“আহা, একই অঙ্গে কত রূপ! আচ্ছা বাবা, এই কলিকালে আপনি হঠাৎ আবির্ভূত হলেন কেন?”
“ভূতের মত তোদের ঘাড়ে চাপব, আর তারপর তোদের ঘাড় মটকে খাব বলে।”
আমার পাশের ভদ্রলোক বললেন, “ উপমাটা বুঝলেন? শ্রী চৈতন্য যেমন হরিনামের ভূত সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, আজও তা বাঙালি ঘাড় থেকে নামাতে পারেনি, ইনিও তেমন আমাদেরকে প্রেম রসে ভাসিয়ে দেবেন।”
আমি ঘাড় নাড়লাম। জলের মত বুঝেছি।তারপর মহাপুরুষকে বললাম, “বাবা, আমাদের মত পাপী তাপী মানুষদের উদ্দেশ্যে একটা বাণী দিন।”
মহাপুরুষ বললেন,
“ইকিড় মিকিড় ফন্দি ফিকিড়
ভীতু শেয়ালের ছা,
দাঁত খিঁচিয়ে, থাবা উঁচিয়ে
বেড়াল মেরে খা।”
আমি এবার সত্যি সত্যি ভাবাবেগে আপ্লুত হলাম। আহা, কি বলিষ্ঠ বাণী।
একজন মাঝ বয়সী মহিলা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, “বাবা, আমাকে রক্ষা কোরো। আমি নিঃসন্তান। আমাকে একটা সন্তান দাও।”
মহাপুরুষটি একটি চোখ মটকে বললেন, “আমাকে বিয়ে করতে পারবি?”
মহিলাটি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। একজন পাশ থেকে বললেন, “আহা মা, উনি সে বিয়ের কথা বলেননি। উনি বলেছেন স্বামীজী হিসাবে ওনাকে মেনে নিয়ে ওনার কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করতে। তাই না বাবা?”
মহাপুরুষটি বললেন,
“তাই না, তাই না, তাই না…
আমি হনুমান খাই না।”
একজন অত্যুৎসাহী ভক্ত মাইক টানিয়ে ফেলেছেন। মাইকে ভজন গাইতে আরম্ভ করেছেন,
“কলিকালে বাবার খেলা বুঝবে কেরে মন,
হিন্দু আয়, মুসলিম আয় আয়রে হরি জন।
অন্ধ হেথায় দৃষ্টি পাবে
খোঁড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে
দেখে বাবার ভেলকি বাজি জাগবে শিহরন।”
হঠাৎ একটা এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা গেল। ভিড়ের কাছে এসে সেটা থামল। এ্যাম্বুলেন্সের থেকে তিনজন তাগড়া লোক নামল। তাদের দেখে মহাপুরুষ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
তিনজন মহাপুরুষকে টানতে টানতে এ্যাম্বুলেন্সে তুলল। তাদের কাছ থেকে জানা গেল স্থানীয় একটি পাগলা গারদ থেকে ইনি সকালে পালিয়েছিলেন।