আমাদের সঙ্গে একজন পড়ত।
নামটা খটোমটো। সে নিজেও বলত পরমগর্বে (আর সেই মত আমরাও বলতাম) তার নাম, এস এস পি সিং। পুরো নাম শরদিন্দু শেখর প্রসাদ সিং। মুঙ্গের না মজঃফরপুরের একদা জমিদারবাড়ির ছেলে। জমিজমা সম্পত্তির ইয়ত্তা নেই। বিহার কোটায় পড়তে এসেছে সখ করে। তখন এই সব কোটাটোটা ছিল।
অত্যন্ত সরল আর দিলখোলা ছেলে। আমাদের সঙ্গে, শুধু আমাদের সঙ্গে নয় সবার সঙ্গেই তার ভারি ভাব ছিল। শত্রু মিত্র ভেদাভেদ ছিল না মনে।
সেই সময় মানে আমরা যখন পরীক্ষা পেছোনোর জাঁতাকলে পড়ে দু বছরের প্রি ক্লিনিক্যাল চার বছরে পড়তে বাধ্য হচ্ছি। ক্বচিৎ কদাচিৎ বাজারে পরীক্ষার গুজব ভাসে আবার থিতিয়েও যায়। সেই সময়ে আমরা অনেকেই চুটিয়ে রাজনীতি করতাম।
আমরা যারা নামকাটা সেপাই। কেউ এসএফআই, কেউ ছাত্র পরিষদ আবার কেউ বা অতি বাম নকশাল। তাতেই সরগরম থাকত আমাদের হোস্টেল আর কলেজ চত্বর। ছাত্র পরিষদেরা ছিল কংগ্রেস অনুগামী। তাদের মূল শত্রু অন্যরা। আবার তাদের নিজেদের মধ্যে কলহও কম নয়। প্রিয়-সুব্রতর অনুগামীরা ছিল ছা.প. (মহাজাতি সদন) আর সোমেন মিত্তিরের আন্ডারে ছিল ছা.প.(শিক্ষা বাঁচাও কমিটি)।
বাম ছাত্রদের মধ্যে এসএফআইরা এখনের মতন তখনও প্রবল সিপিআই(এম) অনুগামী। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে দুটি কথা। এক দলটার নাম নেহাতই বাজারি (পড়ুন আনন্দবাজারি) চক্রান্তে সিপিএম হয়ে গেছে। আর দুই, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ দেশের মত ভারতেও বিপ্লব সমাসন্ন। যদিও সেই বিপ্লব খায় না মাথায় দেয় অধিকাংশই তা নিয়ে সম্যক জানত না কিছু। নকশালদের অজস্র স্রোতধারা। সেই বিভাগবিভাজন অধিগত করাই ছিল এক অতি দুর্নিরীক্ষ্য বিপ্লব বিজ্ঞান।
তো এই ছাত্র রাজনীতির একটা বড় অংশই ছিল, এখনের মতনই দখলের রাজনীতি। কী দখল, কেন দখল সেই উদ্দেশ্যের চাইতেও বড় ছিল দখল করতে হবে এই উন্মাদনা। যদিও সহজবোধ্য কারণেই বাইরের রাজনীতি যাদের দখলে, কলেজের রাজনীতিও তাদের দখলেই থাকবে এটা সহজ সত্য। আর তাইই ছিল।
ছাত্র পরিষদের অখন্ড প্রতাপ। আর তাদের নিজস্ব অন্তর্গত লড়াইয়ের খেলা। মাঝে মধ্যে এসএফআই আর নকশালেরা জোট বেঁধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বাধাতাম তাদের সঙ্গে।
এসএসপির কথা বলতে গিয়ে এই এত কথা বলতে হল এক মজার ঘটনা বলতে গিয়ে। এখন মজার বলছি বটে, সেই কালে প্রায় প্রাণঘাতী। সন ঊনিশশো ছিয়াত্তরের এক উত্তাল দুপুরে ছাত্র পরিষদের সঙ্গে বাম ছাত্রদের এক চূড়ান্ত লড়াই (অন্তত তখন তাই ভাবা হয়েছিল)। সাতে পাঁচে মাথা না গলানো ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণরত।
শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এই থিয়োরিতে এসএফআই আর নকশাল এক দিকে। কলেজে বিরাট মিছিল (মানে যতখানি বিশালত্ব জোগাড় করা যায়) বার করেছে তারা। সামনের সারিতে বাম ছাত্র নেতৃবৃন্দ। যারা পরবর্তীকালে কেউ যাবে ভিয়েনায় ডলার কামাতে, কেউ বা পরে নিজেরাই অবাক হয়ে ভাববে সিপিএম করতাম কেন?
এহ বাহ্য, ঘন ঘন বিপ্লবস্রাবী শ্লোগানে ফেটে পড়ছে চত্বর। বলা ভালো, শ্লোগানের সঙ্গে অধুনা চালু হাততালি দেবার ফ্যাশন আসতে আরও অনেক বছর দেরি।
সেই শ্লোগানের একটা ছিল, – আরে ছাত্র পরিষদকে চিনে নাও, এই মাটিতে কবর দাও।
শরদিন্দু শেখর প্রসাদ, সেও বামেদের এই মিছিলে সামিল। অধিকাংশেরই মতন, আদর্শসূত্রে নয় বন্ধুত্বসূত্রে।
যদিও বাংলায় কাটিয়ে ফেলেছে গোটা তিন চার বছর, এই সব শ্লোগানের প্যাঁচঘোচ সে তখনও শিখে ওঠেনি। শ্লোগান দিতে দিতে সে পার্শ্ববর্তী আমাকে জিজ্ঞেস করল, – এ ভাইয়া, কিসকো খবর দেগা? পুলিশ কো?
আমি তার এই গোলমেলে প্রশ্নের বিশদ উত্তর দিতে পারছি না। সত্যিই তো, চিতায় না দিয়ে কবরে দেওয়া হবে কেন?
এই জটিলতার উত্তর আমারও জানা নেই। যেমন আজও জানি না কাঠকয়লা গাত্রবর্ণের আমি কেন খামোকাই চেঁচাতাম, কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই, কলেজের দুনম্বর গেট দিয়ে হইহই করে স্রোতের মত ছাত্র পরিষদ বাহিনী ঢুকল। তারা প্রায় কেউই আমাদের কলেজের নয়। এখনকার পরিভাষায় বহিরাগত। এবং তারা কেউই আমাদের কাউকে দূরের কথা, নিজেদেরকেও সম্যক চেনে না। এইখানে একটা উপকাহিনি বলে নিই।
হঠাৎই অনুভব করলাম পলায়নপর অগ্রবর্তী বাহিনীর বন্ধুদের কেউই পাশে নেই। আত্মরক্ষার্থে দ্রুত পদচালনা করে ছনম্বর গেটের আগেই, আই ডিপার্টমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাত্রে হোস্টেলে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফেরত গিয়ে টের পেলাম আমাদের আশিস নিখোঁজ।
সেই আশিস ফিরল দুদিন বাদে। অক্ষত দেহে।
সেই কালে এমসিএইচ বিল্ডিংয়ের সামনে বিরাট বিরাট দোতলা বাসের সমান গোটা তিনচার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। সেই গাড়িতে চেপে গ্রামে গিয়ে তৎকালীন রুরাল সার্ভিসের কোটা পূরণ করত কর্তাভজা কিছু এম.ও। আশিস ডামাডোলের বাজারে এক বহিরাগতকে সেই গাড়িগুলোর আড়ালে টেনে নিয়ে ব্যাপক পিটিয়ে পাটপাট করেছিল। কেউ কাউকে চিনত না বলে, বাকি বহিরাগতরা ভেবেছিল আশিস তাদেরই নিজের লোক। আর মার যে খাচ্ছে সে শত্রুশিবিরের মানে আমাদের। বহিরাগতরা ছিল ছোড়দার ছেলে। আশিস সেই সোল্লাস বিজেতাদের সঙ্গেই তাদের ডেরায় ফেরে, কিছুটা প্রাণভয়েই।
– এই দুদিন থাকলি কোথায়? জিজ্ঞাসার উত্তরে গর্বিত আশিস জানাল, কেন, ছোড়দার হোটেলে! শালা ব্যাপক খাওয়া দাওয়া!
তো এই মহাজটিল রাজনৈতিক চিত্রনাট্য সহজ সরল এসএসপির বোঝা সাধ্যাতীত।
কিন্তু সেও এই যুদ্ধশেষে ফিরেছিল বিজয়ীর মতই। দিনশুরুর ছাত্রপরিষদ নিপাত যাক শ্লোগানটা তার মুখে দিনশেষে ছাত্র পরিষদ জিন্দাবাদ হয়ে গেছিল বিনা অসুবিধেয়। আসলে সবাইই তো তার বন্ধু। সকালের দখলকামী আমরা আর বিকেলের বিজয়ী তারাও।
অ্যানাটমি পরীক্ষার এক পর্যায়ে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ বিরাট ছড়ির ডগা দিয়ে ছুঁয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করা হত। প্রায় কুড়িটা আইটেম। শোনা যায়, এসএসপি প্রত্যেকটিরই নাম বলেছিল সুরাল নার্ভ। এবং ধার্য নম্বর চল্লিশের মধ্যে দুই পেয়েছিল কেন না সেটিও ছোঁয়া হয়েছিল একবার।
এর ফলে সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল এবং হতেই থাকল। তার সঙ্গে অনিবার্য বিচ্ছেদ ঘটে গেল আমার মত বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষের।
এবং আমরা যখন পাশ করলাম, জানলাম সে উধাও। শুনলাম নাকি দেশে ফিরে গেছে।
তার সঙ্গে দেখা হল বহু পরে। আমার বউ ইডেনে ভর্তি হয়েছে। পুত্র জন্ম নেবে। দেখি এসএসপি সিং লেবাররুমে ডিউটিরত। পুরোনো অন্তরঙ্গতায়, আবার দেখা যদি হল সখা…
দুজনে দুজনের খোঁজ নিলাম। আমি অধোমুখ সরকারি চাকর। আর সে?
দেশে ফিরে গিয়েছিল কিন্তু বসে ছিল না। রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ভোটে জিতে এমপি হয়েছে। মানে হয়েছিল।
পরের ভোটে হেরে গিয়ে আবার কলকাতা ফিরে কেঁচে গণ্ডুষ করে পরীক্ষা দিয়েটিয়ে সে এখন ইন্টার্নশিপ করছে।
আমাদের অদম্য শরদিন্দু শেখর প্রসাদ সিং।
তারপর আর কোনও খবর পাইনি তার।
এত দিনে হয় তো অনেক বড় মাপের ডাক্তার বা নেতা হয়েছে সে।
বিহারে আবার ভোটের বাজনা বাজতে আমার হারানো বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল।