এই রোগ কি? এর উপসর্গ কি?
সম্প্রতি কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচ বছরের নীচে, তাদের এক ধরণের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তাদের প্রথমে অল্প জ্বর, সাথে সর্দি বা হাল্কা কাশি দিয়ে শুরু হচ্ছে। তার সঙ্গে থাকছে গলা ব্যথা, গা হাত পা ব্যথা, মাথা ধরা, অস্বস্তি।
একেবারে ছোট শিশুরা হয় খাবার খেতে চাইছে না, কিংবা একেবারে খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। তারা কিছু বলতে পারে না, কোন অসুবিধা হলে শুধু কেঁদেই তাদের অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করে। তাই তারা কাঁদছে।
জ্বরের দু’তিন দিন পর থেকে শুরু হচ্ছে দুই পায়ে, হাতের কনুইতে বা সারা হাতে-পায়ে লাল লাল গুটি ওঠা। শুধু হাতে পায়ে নয়, মুখের চারপাশে, এমনকি মুখের মধ্যেও এই গুটি উঠছে। কারও অল্প, কারও বেশি। কারো আবার পাছায়, সারা হাতে, সারা পায়ে এমনকি পিঠেও হচ্ছে।
ত্বকের এই গুটি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কখনও কখনও ত্বকের উপরে লাল লাল ঘামাছির মত হয়, কখনও আবার একটু বড় হয়, আবার আরও বড় ফোস্কা পড়ার মত হতে পারে। তার মধ্যে ঘোলাটে তরল থাকে। দেখে আপাতদৃষ্টিতে চিকেন পক্স বলে ভুল হতে পারে।
মুখের মধ্যে হলে শুরু হয় গলা ব্যথা। মুখ হা করলে দেখা যায় উপরের দিকে হার্ড প্যালেটে বা আলজিভের পাশে লাল লাল গুটি, এমনকি ঘা ও হতে পারে। ছোট শিশুরা কথা বলতে পারে না। গলা ব্যথা বলতে পারে না। তারা খেতে পারে না, তাই খাওয়া ছেড়ে দেয় বা শুধু মাত্র তরল খাবার খেতে চায়।
এ ছাড়াও হাতের তালুতে এবং পায়ের তালুতেও কিছুটা ফোস্কার মত উঠতে পারে বা লাল লাল হয়ে যায় । সেখানে অস্বস্তি বা চুলকাতে থাকে।
চুলকানির জন্যে বড় শিশুদের তো বটেই, ছোট শিশুদের আরও অস্বস্তি হয়। তারা সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। তাদের মুখ দিয়ে লালা পড়ে।
এই রোগ যেহেতু হাত,পা ও মুখে হয়, তাই এর ডাক্তরী নাম “হাত-পা-মুখের” রোগ। ইংরেজিতে “Hand Foot Mouth disease”.
এটি একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। বর্তমান সময়ে মানুষের বেশিরভাগ রোগই ভাইরাস ঘটিত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীবাণু মানুষের বর্তমান সবচেয়ে বড় শত্রু। কিছুদিন আগে করোনা সারা পৃথিবীর মানুষকে নাকানি চোবানি খাইয়ে দিয়েছে। এখন সে হয়ত সাময়িক বিশ্রাম নিচ্ছে, এগিয়ে এসেছে অন্য ভাইরাস।
এই ভাইরাস অতটা মারাত্মক নয়, কিন্তু তীব্র ভাবে ছোঁয়াচে। একজনের হলে তার সংস্পর্শে যে সব শিশুরা আসে, তাদেরই হয়। এই জন্য স্কুলে একজনের হলে প্রায় সব শিশুই আক্রান্ত হচ্ছে।
কি ভাবে রোগ ছড়ায়?
এই রোগের কারণ এনটেরোভাইরাস গোত্রের কক্সাকি-এ , কক্সাকি-বি ও এনটেরোভাইরাস ১৭ । এর মধ্যে কক্সাকি-এ ই প্রধান ভাইরাস। এনটেরোভাইরাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের অন্ত্রে থাকে এবং মলের সাথে নির্গত হয় এবং মলের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। হাত ভালভাবে না ধুয়ে নিলে কিংবা কোনও ভাবে মলের সাথে কোনও কিছুর সংস্পর্শ ঘটলে তবে এই রোগ সংক্রামিত হতে পারে। ছোঁয়াছুঁয়ির মাধ্যমে, এ ছাড়া লালা, সর্দি-কাসি, গুটির রস ইত্যাদির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
ভাইরাস শরীরে ঢোকার তিন থেকে ছয় দিন পর রেগের উপসর্গ দেখা দেয়। এই সময়কে বলে ইনকিউবেশন পিরিয়ড। জ্বর শুরু হওয়ার ১-২ দিনের মধ্যে র্যাস দেখা দেয়। তবে জ্বরের মাত্রা খুব বেশি হয় না।
কাদের বেশি হয়?
সাধারণতঃ ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগ দেখা যায়। যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যেতে শুরু করে, সেই বয়সই এই ভাইরাসের খুব পছন্দ। একেবারে ছোট ছয় মাসের শিশুরও হতে পারে, কিন্তু দশ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের হয় না বা খুব কম হয়।
একবার রোগ হয়ে গেলে ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়, আর রোগ হয় না, কিন্তু শিশুর যদি কোনও ইমিউনিটি সংক্রান্ত রোগ থাকে তবে আবারও হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা সহজেই শুনে, শিশুকে পরীক্ষা করে এই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। যেহেতু এই রোগে তেমন মারাত্মক কিছু হয় না, তাই তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করে নির্দিষ্ট চিকিৎসার কিছু নেই।
কিন্তু দরকারে মল এবং ত্বকের র্যাস থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করে ভাইরাস পাওয়া যেতে পারে।
চিকিৎসা
কোনও চিকিৎসা না করলেও এই রোগ ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু এই রোগের নানান উপসর্গ আছে, এবং যে কোনও ভাইরাস ঘঠিত রোগ অন্য রোগকে টেনে আনে, তাই প্রয়োজন হয় কিছু চিকিৎসা দেবার। যেমন
- জ্বরের জন্যে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ।
- র্যাস যাতে ত্বকের ক্ষতি না করে, সেই জন্যে ত্বককে নরম রাখার জন্যে কিছু মলম বা লোশান।
- গলা ব্যাথার জন্যে ঔষধ। যদি গলায় সেকেন্ডারি ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ঘটে, তবে এন্টিবায়োটিক।
- কাশি বেশি হলে কাশি কমানোর ঔষধ। তবে সব চিকিৎসাই চিকিৎসকের নির্দেশ অনুসারে করতে হবে।
- উষ্ণ নুন-জল মুখের মধ্যে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে বা গার্গল করলে গলার ব্যথায় আরাম হতে পারে।
- এ ছাড়া ত্বকে ঠান্ডা বরফ দিলে ত্বকের অস্বস্তি কমতে পারে। গলায় অন্য কোনও সমস্যা না থাকলে ঠান্ডা জল খেলে বা ঠান্ডা পানীয়, আইস্ক্রিম মুখের ভিতরের র্যাসের অস্বস্তি কমাতে পারে।
- কোনও রকম এসপিরিন জাতীয় ঔষধ দেওয়া যাবে না- এতে শিশুদের মারাত্মক Reye’s syndrome হতে পারে।
- টক বা সোডা জাতীয় কোনও খাদ্য দেওয়া যাবে না।
- বেশি নুন যুক্ত বা মশলা যুক্ত খাবার দেওয়া যাবে না।
ভবিষ্যৎ
অগেই বলা হয়েছে, সাধারন্তঃ ৭-১০ দিনের মধ্যে রোগ সেরে যায়। কিন্তু কোনও কারণে ১০ দিনের মধ্যে না সারলে বা অন্য উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রোগ হলে যে সব সমস্যা হতে পারে-
- ডিহাইড্রেশান বা জল কমে যাওয়া। এই জন্যে এই রোগ হলে শিশুকে বেশি জল খাওয়াতে হবে।
- হাত-পায়ের নখ উঠে যাওয়া।
- ভাইরাল মেনিঞ্জাইটিস ও এনকেফালাইটিস- যা ভাইরাসের মাথায় বা ব্রেনে সংক্রমণ। খুবই কম হয়, কিন্তু হলে বিপদ হতে পারে।
- প্যারালিসিস- হাত পায়ে জোর কমে যাওয়া বা নাড়াতে না পারা। খুবই কম রোগীর হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। নিজে থেকেই সেরে যায়, দরকারে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে।
- হার্টের মায়োকার্ডাইটিস। এটিও যে কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রে হতে পারে।
কি করলে রোগ হবে না?
- যাদের রোগ হয়নি তাদের অন্য রোগগ্রস্ত শিশুদের থেকে দূরে রাখতে হবে।
- হাত বার বার ভাল করে সাবান ও গরম জল দিয়ে ধুতে হবে।
- আক্রান্ত শিশুর মল যেন কোন অবস্থাতেই অন্যের সংস্পর্শে না আসে তা নিশ্চিত করতে হবে।
- শিশুরা যেন তাদের হাত মুখে না দেয়, তা দেখতে হবে।
- বাড়ির যে সব স্থানে শিশুদের হাত পড়তে পারে, সেই সব স্থান পরিষ্কার রাখতে হবে।
এই রোগ খুব মারাত্মক কিছু নয়, তবে সাময়িক ভাবে ভোগাতে পারে। তাই শিশুর দিকে খেয়াল রাখতে হবে ও শিশুর যত্ন নিতে হবে।
উপকৃত হলাম। ধন্যবাদ