জীবনের প্রথম ছোটগল্পটি লিখেছিলাম স্কুল ম্যাগাজ়িনে, সতের বছর বয়সে।
রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত একটি শিশুর শেষ কয়েকদিনের হাসপাতালবাসের গল্প। নাম, ‘অসমাপ্ত’।
সেই কৈশোরের চৌকাঠ পেরিয়ে তারুণ্যের বারান্দায় পা রাখার দিনটিতে কল্পনাও করিনি, এই রোগাক্রান্ত বাচ্চাদের সঞ্জীবনী সুধারক্তের জোগানের কুশীলব হতে হবে আমাকে একদিন।
গল্প পড়ে বাংলার মিস বলেছিলেন, ‘সুন্দর লিখেছ — তবে তোমার লেখায় বড্ড অন্ধকার’।
আমি অবাক হয়েছিলাম — অন্ধকারও তাহলে সুন্দর হয়!
তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর। নিজের সঙ্গে নিজের পরিচয় গাঢ় হয়েছে, আর গাঢ়তর হয়েছে আঁধার। ভিতরে, বাইরেও।
রঙের উৎসব আমাকে টানেনি কখনো। আমি জীবনে কোনওদিন দোল ‘খেলিনি’। বয়সকালে বাড়িতে/হোস্টেলে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। এখন শেষ বয়সে এসে পায়ের পাতার উপর কিছু গুঁড়ো আবিরের স্পর্শ অনুভব করি কেবল — এভাবেই কেটে যায় দোল।
রঙিন উদযাপন নয়, উচ্ছ্বাস নয়, প্রাণোচ্ছ্বলতা নয় — আমারই সৃষ্ট গল্পের সেই লিউকিমিয়া আক্রান্ত আট বছরের বালক প্রবলভাবে আমার আঁচল টেনে ধরে। আমি পিছন ফিরে দেখি নিঃশব্দে দল ভারি করে ফেলছে সে।
বলিরেখা কুঞ্চিত মুখ নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফিলোমিনা গ্র্যানি আর সারা আন্টিদের মতো রেনবো ব্রিজ পার হবার অপেক্ষায় থাকা প্রাচীন মানুষেরা, যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল লরেন্স ডি’সুজা হোমে। তাঁদের পিছন থেকে উঁকি মারে আমার ভালবাসার কালিয়াগঞ্জের অসংখ্য সরল, উদার, গ্রাম্য, ভাগ্যহত মানুষের মুখ — যত রাজ্যের অখ্যাত গুণ্ডু বর্মণ, লালু পাটোয়ারি, খোদেজা খাতুন, শঙ্কর হরিদের মুখ।
তারও পরে আসে সেইসব রক্তাল্প, দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে চলা যুদ্ধবাজ মানুষগুলোর ক্লান্ত, বেদনার্ত, হাল ছেড়ে দেওয়া পরিজনদের হেরে যাওয়া মুখের মিছিল — ‘এক ইউনিট রক্ত, যেখান থেকে পারেন, জোগাড় করে দিন না ম্যাডাম — আজ তিনদিন ধরে ঘুরছি, কোত্থাও পাচ্ছি না’ —
এই মুখেদের ভিড়ে রয়েছে হাওড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল মাজুর থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত দোয়েলও — তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাবার প্রায় একক চেষ্টায় গড়ে তোলা রক্তদান আন্দোলনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় যে মেয়ে জীবনের তৃতীয় দশকে পা রেখেছে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে। বিয়েও করেছে সে। কিন্তু সন্তানের মনস্কামনা পূর্ণ হয়নি এখনো।
সারাজীবন এইসব হা-ক্লান্ত, পিছনের সারির, নিচের মহলের হেরোদের পৃষ্ঠপোষকতা করেই কেটে গেল আমার, আমি নিজেও যে ওদেরই একজন।
ক্ষণিক বসন্তের রসাভাস শুকিয়ে আসবে শিগগিরই — তারপরেই আসবে রুদ্র, নিষ্ঠুর গ্রীষ্ম — তীব্র তার ক্ষুধা, প্রচণ্ড তার দহন। আরো স্বল্প হবে রক্তদান শিবির, আরো আরো নীরক্ত হবে ব্লাডব্যাঙ্কের ভাঁড়ার।
আমার প্রিয় ফুল রুদ্রপলাশ। তার রঙ লাল — সিঁদুরের মতো, রক্তের মতো লাল।
কিন্তু সেপিয়া রঙের অতীত আর ফ্যাকাশে বর্তমান সম্বল করেই কেটে যাচ্ছে আমার ধূসর, ধোঁয়াটে দিনগুলি।
রঙিন মুহূর্তকে বন্দি করায় সিদ্ধহস্ত আমার মুঠোফোনটারও প্রিয় রঙ এখন শুধুই ‘গ্রে স্কেল’!
হ্যাপি হোলি!