১৩ মার্চ, ২০২৫
সুধী পাঠক পাঠিকাগণ ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। লেখাটা কিঞ্চিৎ বড় হয়ে গেল। কাল দোল। দোল মানেই কিছু মানুষজনের কাছে দেদার মধুপান এর লাইসেন্স। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ দিয়েই শুরু করি। উত্তর কলকাতার শহরতলীর ছোট্ট সরকারি হাসপাতালে কাজ করার সময়ে আমার সবচেয়ে কাছের লোক ছিল বাল্মীকি। পদবীটাই বললাম। নামটা থাক। হাসপাতালের জমাদার মানে সুইপার। আর দুটো অতিরিক্ত পয়সা রোজগারের জন্য মাঝে মধ্যেই নেমে পড়তো ঠিকাদার এর কথায় ম্যানহোল পরিষ্কারের কাজে।
রোজ সকালবেলায় আমার ডিউটি রুমে আসতো। ঝাঁটপাট দিয়ে পরিষ্কার করতো। বিছানার চাদর বালিশ ঝেড়ে টানটান করে পেতে দিতো। কাজ শেষ করে এসে দাঁড়াতো। চারটে টাকা দিতাম। দুটাকা এর ডিম টোস্ট আর দুটাকা হল সন্ধ্যের পরে এক বোতল চোলাই এর দাম। জানতাম বাল্মীকি টাকাটা নিয়ে কি করবে। তবুও দিতাম। বিরাট অনুগত ছিল। কোনোদিন কোনও কাজে না করে নি। সিস্টাররা ঠাট্টা করে বলতেন, ডাঃ সেনগুপ্তর “পোষা হনুমান”।
এই হনুমান প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ সাফাই দেওয়া দরকার নইলে আবার ভক্তরা রিপোর্ট মেরে প্রোফাইল এর বারোটা বাজাবে। বাল্মীকি রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডের ৬১ – ৬২ সর্গ তে আছে হনুমান সীতাকে খুঁজে পাওয়ার পরে বানররা সেলিব্রেট করবেই বলে ঠিক করল। একখান “মধুবন” খুঁজে বার করে অঙ্গদের কাছ থেকে পারমিশন চাইল, “আজ একটু হয়ে যাক বস!” অঙ্গদ বড়দের জিজ্ঞেস করে পারমিশন দিলেন। তারপর – রাজশেখর বসু এর ভাষায় “অতঃপর বানরকুল মধুপান করিবার অনুমতি লাভ করিয়া যারপরনাই প্রীত হইলো। তাহারপর সেই উত্তেজিত বানরকুল আনন্দিত হইয়া নৃত্য শুরু করিল। কেহ গান করিতে লাগিল, কেহ আবার অভিবাদন জানাইতে লাগিল। কেহ নৃত্য করিতেছে। কেহ অট্টহাসি জুড়িল। কেহ লুটাইযা পরিল। কেহ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি জুড়িল। কেহ লাফঝাঁপ করিতেছে। কেহ বা আবার অসংলগ অবিশ্রাম বাক্যালাপে ব্যস্ত।”
ফল স্বরূপ যা হওয়ার তাই হল। “অত্যাধিক মধুপানান্তে বানর সেনার দল প্রচন্ড উত্তেজিত হইয়া পরিল। এমন কেহ আর অবশিষ্ট নাই যাহারা মদগ্রস্ত নহে। সৈনিককুলের এমন কেহ নাই যাহারা আকণ্ঠ পান করিয়াছে।” মুশকিল হল যে নিরিবিলিতে এট্টু মধুপান করবেন তার যো নেই বস। একপিস খচো পাবলিক ঠিক জুটে যাবে। ওই বাগানের কেয়ারটেকার দধিমুখ এই ফুর্তি দেখে চুলকাতে গেল। এসব করা নাকি চলবে না। তাই শুনে বানরকুল যা করলো -“ঐসকল বানরসেনার সহিত ধস্তাধস্তির পরে তাহাদের অবশ অবস্থাজনিত কারণে উৎপন্ন অসংযত আবেগের তাড়নায় বানরসেনাগণ দধিমুখকে বলপ্রয়োগে পরাস্ত করিয়া টানিতে টানিতে লইয়া গেল। তাহারা তখন নিজ কার্য্যের কুপরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন।”
বানরদের কাছে ক্যাল খেয়ে দধিমুখ ছুটলো তার বস কাম ভাগ্নে সুগ্রীবের কাছে কমপ্লেন করতে। ওসব দেখে ওখানে উপস্হিত লক্ষণ সুগ্রীবের কাছে জানতে চাইলেন যে কেস টা কি। তখন সুগ্রীব বললেন -“যখন বানরকুল মধুবন দখল করিয়াছে উন্মত্তের মতো, তাহার অর্থ হইল আমাদিগের কার্য সম্পন্ন হইয়াছে। সীতার সন্ধান প্রাপ্তি হইয়াছে ইহাতে সন্দেহ এর অবকাশ নাই। হনুমান নিশ্চিত সীতার দর্শন লাভ করিয়াছে।” এরপর রাজশেখর বসু লিখছেন- সুগ্রীবের কথায় রাম-লক্ষণ অতিশয় হৃষ্ট হলেন। দধিমুখকে সুগ্রীব বললেন, বানররা কৃতকার্য হয়ে ফিরে এসে মধুবনে পানভোজন আর উপদ্রব করছে তাতে আমি প্রীত হয়েছি। তুমি শীঘ্র ফিরে গিয়ে মধুবন রক্ষা করো ও হনুমানপ্রমুখদের এখানে পাঠিয়ে দাও।”
তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন পাঠক পাঠিকা গণ যে কেবল সমুদ্র সেনগুপ্ত নন, মহাবীর সুগ্রীব ও মধুপানে কিঞ্চিৎ প্রশয় দিতেন। মহাকাব্য ছেড়ে আবার ফিরে আসি সেই হাসপাতালে। নাইট ডিউটিতে সময়ে আমার হনুমান খাওয়া দাওয়া সেরে ঠিক টাইমে চলে আসতো ডিউটি রুমে। রাত দশটার পরে দরজার কাছে আলো নিভিয়ে বসত। একটা ছোট রেডিও ছিল। তাতে চালিয়ে শুনতো পুরানো দিনের হিন্দিগান। বিনাকা গীতমালা। অনেক সুখ দুঃখের কথা হতো। জানতে চাইতাম রোজ নেশা করে কেন। বাল্মীকির উত্তর ছিল সারা দিন গন্ধা কাম কাজ করার পরে চান সেরে ওই এক বোতল সাবাড় করার পরে ওর নিজেকে মনে হত একজন মানুষ। আস্ত মানুষ। সাফাইকর্মী নয়। আশ্চর্য বিষয় হল, অন্যান্য দিন মধূপান করলেও ও কিন্তু দোল এর দিন নিজেকে সংযত করতো পান করত না, দোল খেলত না, কারণ জানতো যে ওই মধূপান করে ইমার্জেন্সিতে আসা লোকজন এর সংখ্যা ওইদিন একটু বেড়ে যেত।
বাল্মীকি এর মতো সেই সাফাইকর্মীদের স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে একটু ভাবা যাক আজকে। আজ হটাৎ কেন সে প্রশ্নের উত্তর পরে। বিষয়টাকে প্রথমে নিছক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা হিসেবে দেখা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর অকূপেশোনাল একসিডেন্ট এ ১০০ মিলিয়ান মজুর আহত হন আর মারা যান ২,০০,০০০ মজুর। ক্ষতিকারক পদার্থ বা পদ্ধতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য ১৫৬ মিলিয়ান নতুন করে অসুস্থ হন। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ অকূপেশোনাল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন এর হিসেবে ভারতে আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন সাফাইকর্মী আছেন। গত শতাব্দী জুড়ে এদের কাজের পরিবেশ কার্যত একই রকম আছে।
রাজনারায়ন তিওয়ারি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ এর মতে সামাজিক নিপীড়ন ছাড়াও পেশাগত কারণে এদের যে সব স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো হল, দুর্ঘটনা, ক্ষতিকারক গ্যাস এর সংস্পর্শে আসা যার মধ্যে রয়েছে মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড; হৃৎপিণ্ড-রক্ত সংবহন তন্ত্রের অসুখ; অস্টিও অর্থারিটিস, ভার্টিব্রা ডিস্ক হার্নিয়া সহ মাংসপেশি অস্থিকাঠামোর বিভিন্ন অসুখ; হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, টিটেনাস, লেপ্টস্পাইরোসিস, হেলিকোব্যাক্টর সহ বিভিন্ন সংক্রমণ ত্বকের সমস্যা, শ্বাস যন্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি।
গ্লোবাল ওয়াটার স্যানিটেশন এন্ড হাইজিন কর্মসূচির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুবিখ্যাত সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসি আটলানটা কয়েকটি নিদান দিয়েছেন। সেগুলি হল, সাফাইকর্মীদের বেসিক হাইজিন প্র্যাকটিস, তাদের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট যেমন মাস্ক, গ্লাভস, গামবুট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা, ও ভ্যাকসিন বা টিকাকরণ এর ব্যবস্থা করা (হেপাটাইটিস, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে)।
এবার দ্বিতীয় ভাগ। এটা কি কেবল নিছক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা ? রিচার্ডসন প্রমুখ জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে এই সমস্যা মোকাবিলায় তিনটি আঙ্গিকে সমাধান করতে হবে – জনস্বাস্থ্য, কারিগরি-প্রকৌশল এবং রাজনৈতিক।
দি এমপ্লয়েন্ট অফ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজিং এন্ড কনস্ট্রাকশন অফ ড্রাই ল্যাট্রিন প্রহিবিশন আইন পাশ করা হয় ১৯৯৩ সালে। স্বাধীনতা পর এতগুলো বছর কেটে যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের যে এরকম একটা আইন দরকারি তা ভাবতে। এর কুড়ি বছর বাদে ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন ক’রে নর্দমা ও সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার জন্য মনুষ্য কে নিয়োগ বা আয়োগ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
নিট ফল হল এই যে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক এক প্রশ্নের উত্তরে লোকসভায় জানায় যে ২০১৭ সালে মোট ৩০০ জন সাফাই কর্মী সেপটিক ট্যাংক সাফ করতে গিয়ে দমবন্ধ (এসফেক্সিয়া) হয়ে মারা গেছেন। জয়তী ঘোষ তার লেখায় দেখিয়েছিলেন যে ২০১৭ সালের শুরু থেকে প্রতি পাঁচদিনে একজন সাফাইকর্মীর মৃত্যু হয় এদেশে। এটা পেশা হিসেবে সেনাবাহিনীর থেকেও বিপদজনক এবং জাতি বৈষম্য এর সবচেয়ে দেশি উদাহরণ।
বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন যে এই সাফাইকর্মীরা মূলত ঠিকাকর্মী। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য এদের নিয়োগকর্তারা দেশের কোনও নিয়মকানুন মানার তোয়াক্কা করেন না। নজরদারির জন্য নিয়োজিত পুরসভার স্তরে প্রচুর গাফিলতি। ইত্যাদির নিটফল হল ওপরে বর্ণিত সিডিসির সুরক্ষবিধি স্রেফ খাতায় কলমে।
ব্যক্তিমালিকানায় ছোট সংস্থায় তো চূড়ান্ত অবহেলা। আমার কাজের জায়গা উত্তর ২৪ পরগনার কাগজ কল এর নর্দমার বিষাক্ত বাষ্পে ডুবে মারা গিয়েছিলেন ৬ জন মজুর: অশোক বড়াল, বিজয় বর্মা, অমিত যাদব, উদয় রাজ, মিঠুন এবং মহঃ নাজিম। মাত্র ১৮০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করা এই মজুরদের কাছে চিরাচরিত ভাবেই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন গ্যাস মাস্ক ইত্যাদি ছিল না। লক্ষ্যনীয় এদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম। কেউ বাঙালি কেউ আবার অবাঙালি। আবার নতুন করে প্রমাণ হয়েছিল খেটে খাওয়া মানুষদের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই। তাদের একটাই পরিচয় যে তারা বঞ্চিত।
কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম ছবি দেখেছিলাম যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন সাফাইকর্মীর পা ধুয়ে দিচ্ছেন। সেই দেখে আমার পুরানো সহচর বাল্মীকির কথা মনে পড়লো। উত্তর শহরতলীর সেই ছোট্ট সরকারি হাসপাতালটা আজও আছে। বাল্মীকি আর বেঁচে নেই। থাকার কথাও ছিল না। সিরোসিস অফ লিভার। এলকোহল কে দিনের পর দিন অন্যাসথেসিয়া হিসেবে ব্যবহার করতো, ডিওডোরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতো লোকটা। অন্য মানুষের মল মূত্র দু হাত ভরে ঘেঁটে গেছে সারা জীবন। সমাজটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদে অঞ্জলি ভরে হলাহল।
আজ তারই জাতভাইদের পা ধুইয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেও আমি সেই রাজনেতাদের ক্ষমা করতে রাজি নই। সত্যিকারের প্রায়শ্চিত্ত সেদিন হবে যেদিন দেখতে পাবো আমার দেশের সংবিধানের ৪৭ তম পরিচ্ছেদ এ লেখা এই শব্দগুলি বাস্তবায়ন হচ্ছে। “the State shall regard raising the standard of living of its people and the improvement of public health as among its primary duties”
দোল এর আনন্দ উৎসব সফল হোক সবার। সবাই খুব আনন্দ করুন। কেবল আমার প্রিয়, মনের খুব কাছাকাছি মানুষ সেই সাফাই কর্মী এর কথাটা মনে রাখবেন। দোল এর দিন অসুস্থ মানুষের পরিচর্যার খাতিরে ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম এর সিস্টার এর পাশাপাশি রংচটা বিবর্ণ আকাশি নীল আর গাঢ় নীল ইউনিফর্ম এ উজ্জ্বল বাল্মীকি অতন্দ্র প্রহরীর মতো মধূপায়ীদের সামলাতে ব্যস্ত, যার চেহারায় আবিরের একটা ছোপ পর্যন্ত নেই। আমার নিজস্ব “হনুমান”। কেউ দোল খেলবে, কেউ ইচ্ছে থাকলেও পারবে না খেলতে। কারণ তার ডিউটি থাকবে।
অসাধারণ লেখা, মন ছুঁয়ে গেল।