দমকা বৃষ্টিতে ভিজে গেছি সেদিন। চেম্বারে ঢুকে খানিক শুকিয়ে নিয়ে তারপর শুরু করবো ভাবছি। এমনসময় বছর ষাটের এক প্রৌঢ় দরজা খুলে একরকম জোর করেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বিব্রত চোখে বিস্রস্ত জামা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম -কি ব্যাপার?
সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করেই ভদ্রলোক অনুযোগের সুরে বলতে শুরু করলেন, গত কয়েক হপ্তা ধরেই মাঝে মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। পাড়ার কোয়াক চিকিৎসকের কাছে যেতে বললো- প্রেসার কমে গেছে, তাই নাকি এই–ই অবস্থা। কি সব ইঞ্জেকশন দিন কতেক দিয়েছে। কিছুই লাভ হয়নি। অবশেষে এ হপ্তায় দু দুবার মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার পর যখন আবার কোয়াক চিকিৎসকের কাছে গেলাম তখন বললো মাথায় গ্যাস উঠে গিয়ে এই বিপত্তি। সেই মর্মে ব্রেনের সি টি স্ক্যান করা হলো। রক্তের সোডিয়াম পটাসিয়াম রিপোর্ট করা হলো। সব নরমাল। কোয়াক চিকিৎসক ঊর্ধ্বগামী গ্যাসকে লাগাম পরিয়ে নিম্নমুখী করার জন্য দিনে দুবেলা গ্যাসের ইঞ্জেকশন আর অ্যান্টাসিড সিরাপ দিয়ে চলেছেন। অবশেষে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রস্রাব করতে যাবার সময় পুনরায় মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে যাই। চোট ঈষৎ লাগলেও কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানি না। অনেক পরে জ্ঞান ফিরলে অন্য একজন কোয়াক চিকিৎসককে ডেকে আনা হলো। তিনিও বললেন ব্রেনে গ্যাস জমে নাকি এই দশা। এম আর আই করে নাকি ব্রেনের কোথায় গ্যাস জমেছে তা আঁতিপাঁতি খুঁজে নিচে নামাতে হবে। এবার আর ওদের কথা বিশ্বাস হলো না। তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
সব কথা শুনে বললাম, ইসিজি করেছেন?
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ইসিজি তো করিনি।
ভদ্রলোকের হাতের রিপোর্টগুলোয় চটজলদি চোখ বুলিয়ে দেখলাম দরকারি অদরকারী সব টেষ্ট করেছেন। কিন্তু অতি সামান্য খরচের ইসিজি রিপোর্ট করেননি।
হাতের কব্জি টেনে নাড়ি দেখতে গিয়ে দেখলাম ছন্ধহীন তালে ধীরলয়ে চলেছে নাড়ি। মাঝেমধ্যে আলটপকা কিছুমুহূর্ত বন্ধ হয়ে থেকে আবার ছন্দহীন ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে।
চটজলদি ইসিজি করা হলো। প্রথমত হার্ট রেট বেশ কম। তার ওপর অলিন্দের সাথে নিলয়ের ছন্দের কোনও সামঞ্জস্য নেই। অর্থাৎ কিনা থার্ড ডিগ্রি হার্ট ব্লক। ইমিডিয়েট পেসমেকার বসানো ছাড়া প্রাণঘাতী বিপদের সম্ভাবনা।
প্রয়োজনীয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন দিয়ে কার্ডিওলজিষ্ট বন্ধুর কাছে ফোন করে ভদ্রলোককে রেফার করা হলো।
প্রাথমিকভাবে কিছুটা অবিশ্বাসের সাথেই সেদিন চেম্বার ছেড়েছিলেন ভদ্রলোক।
ফিরে এলেন দিন পনেরো পরে। সাথে স্ত্রী ও পুত্র। চোখে কৃতজ্ঞতার চাহনি।
আপনাকে দেখিয়েই কার্ডিওলজিষ্টের কাছে গেছিলাম স্যার। উনি দেখে সেদিনই সব রিপোর্ট করে রাত্রে পারমানেন্ট পেসমেকার বসিয়ে দিয়েছেন। এখন আর কোনও অসুবিধা হচ্ছে না স্যার। বেশ ভালো আছি এখন। কিন্তু কি হয়েছিলো সেটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন..
ভদ্রলোকের বাড়ি কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টের ঘেরাটোপে। তাই সেইমতই বলতে শুরু করলাম। ধরে নিন কোলাঘাটের অলিন্দে থাকা সাইনোয়্যাট্রিয়াল নোড থেকে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন হয়ে তিনটি (ব্যাকম্যান, থোরেল, উইংকিব্যাক) তারের মাধ্যমে হাওড়া ব্রীজ (অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার নোড) পেরিয়ে ব্র্যাবোর্ন রোড (বান্ডল অফ হিস) ধরে কিছুটা যাবার পর তারপর আলাদা আলাদা দুটো রাস্তা (পারকিনজি ফাইবার) ধরে উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতায় (বাম ও ডান নিলয়) ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছায়।
এবার কোনো কারণে হাওড়া ব্রীজে জ্যাম হয়ে কোলাঘাট থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে দেরি হলে তাকে আমরা ফার্স্ট ডিগ্রি হার্ট ব্লক বলি। কোলাঘাট থেকে হাওড়া পৌঁছাতে তিনরাস্তার মধ্যে উইংকিব্যাকের রাস্তায় গড়বড় থাকলে সেকেন্ড ডিগ্রির (টাইপ ওয়ান) হার্ট ব্লক বলি। এবার ধরুন কোলাঘাট থেকে হাওড়া পৌঁছাতে গিয়ে নির্দিষ্ট কোনও ছন্দ মেনে যদি রাস্তায় গড়বড়ের কারণে একবার ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছাতে পারলো আর একবার পারলো না, সেক্ষেত্রে তাকে সেকেন্ড ডিগ্রির (টাইপ টু) হার্ট ব্লক বলি। আবার এই রাস্তায় যদি ছন্দহীন ভাবে ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছাতে গন্ডগোল হয়, তাকে আমরা থার্ড ডিগ্রি হার্ট ব্লক বলি। শেষ ক্ষেত্রে কোলাঘাট ও কলকাতা যে যার নিজের মর্জিমতো চলতে থাকে ।
প্রতিটি হার্ট ব্লকই সামান্য খরচের ইসিজি করেই নির্ণয় করা যায়। হার্টব্লকের সাথে মাথা ঘুরিয়ে যাওয়া বা সিনকোপ থাকলে কিছুক্ষেত্রে পেসমেকার বাধ্যতামূলক। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে যেমন জেনারেটরের ব্যবহার করি আমরা, ঠিক তেমনি ভাবে পেসমেকার কৃত্রিমভাবে ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে, যাতে কিনা অবশেষে কলকাতায় ইলেক্ট্রিসিটির ব্যাঘাত না ঘটে।
সব শুনে ভদ্রলোকের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে গোল গোল চোখ করে অবাক বিস্ময়ে স্বগোতক্তি করলেন- কোথায় হার্ট ব্লক, আর কোথায় মাথায় গ্যাস! হা হতোস্মি!